দেয়াল আমাকে বলে
দেয়াল আমাকে খুব শান্ত স্বরে বলে নানা কথা;
কিছু তার বুঝি সোজাসুজি, কিছু বা বুঝি না। তবু
কান পেতে থাকি যতক্ষণ পারি, দিই মনোযোগ,
পাছে কোনো গূঢ় কথা শ্রুতির ওপারে চলে যায়
উপেক্ষিত অতিথির মতো। দেয়াল শোনায় এক
বালকের বিষাদ কাহিনী, যে হাওয়ায় কথকের
মুদ্রা এঁকে দূর দিগন্তের কোলে মেঘে মেঘে নেচে
বেড়াবার সাধ মনে জ্বালিয়ে রাখতো অগোচরে।
মাঝে মাঝে দেয়ালের কণ্ঠস্বরে ভাসে অতিদূর
নবীন যুবক এক, যার শরীরে দেবতা কিছু
বুলিয়েছে হাত স্নেহ ভরে; সে যুবক কী সহজে
কখনো প্রবেশ করে নীল পদ্মে, কখনো দোয়েল
তার খুব কাছে এসে দেখায় গলার ক্ষত, যেন
শুশ্রূষা প্রার্থনা করে। সেই সদ্য যুবা মধ্যরাতে
অকস্মাৎ জেগে উঠে অদেখা নারীর ধ্যান করে,
রাত জেগে স্থাপত্য গড়ে তোলে নিরিবিলি
খাতার কুমারী পাতা জুড়ে। কখন যে সে যুবক
নেপথ্যে স্বপ্নের কাচ-গুঁড়ো নিয়ে খেলা তার ভোলে,
রাখে না খেয়াল কোনো যেমন বনের পাখি আর
প্রস্ফুটিত ফুল কারো তারিফের মুখাপেক্ষী নয়।
দেয়াল হাজির করে আমার সম্মুখে একজন
প্রৌঢ়কে, জীবন যাকে প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে দিয়ে
চেয়েছে নোওয়াতে খুব ঠেলে নিয়ে বার্ধক্য সীমায়,
অথচ সে, প্রায় বুড়ো, উঁচু রেখে জেদী মাথা হেঁটে
যায় তারুণ্যের দীপ্তি ছড়িয়ে সত্তায় কথা বলে
রহস্যের আঁধারের সঙ্গে, ভালোবাসে কী গভীর।
দেয়াল দেখায় তাকে বহুকাল পরে অনুপমা
গৌরীকে, যে স্নান সেরে সরোবরে উঠে আসে ঘাটে;
প্রায়-বুড়ো লোকটা তাকেই পেতে এতকাল শুধু
হেঁটেছে অধীর প্রতীক্ষায় প্লাটফর্মে দীর্ঘ পুড়ে পুড়ে।
নিউইয়র্ক, ২১ সেপ্টেম্বর ৯৫
দোষী
চাই না করুণা ক’রে তাকিয়ে থাকুক লোকজন
কখনো আমার দিকে। আমি কারো কৃপাপ্রার্থী নই,
ছিলাম না কোনদিন। মাথা নত করা, হাঁটু মুড়ে
বসা কোনো প্রতাপশালীর দরবারে অনাগ্রহী।
কবি আমি; শব্দ গড়ি, শব্দ ভাঙি, চিত্রকল্প খুঁজি
অথবা নির্মাণ করি গোলাপ এবং প্রিয়তমা
রমণীর মুখের আদলে, ভগ্নস্বাস্থ্য, ক্ষীণ দৃষ্টি
নিয়ে দিনরাত মেতে থাকি দীপ্র নিজস্ব সৃষ্টিতে।
কেউ কেউ নিদ্রূপের বাণে বিদ্ধ করে, কারো কারো
চক্ষুশূল হ’য়ে আছি দীর্ঘকাল। আমাকে নাকাল
করার ফিকিরে ঘোরে সর্বক্ষণ কিছু লোক, যদিও জানিনা
কী আমার অপরাধ। যদি সত্য-সুন্দরের ধ্যানে
মগ্ন থাকা, নারীর হৃদয়ে ঠাঁই পাওয়া কসুরের
খাতায় চিহ্নিত হয়, তাহ’লে অবশ্য দোষী আমি।
২৫/২/৯৫
নৈবেদ্য সাজাই
মাঝে মাঝে যাই, দেশ ছেড়ে বহুদূরে চলে যাই
আমন্ত্রণে, আমিতো আনাড়ি
পর্যটক, পথ হারানোর ভয় বাদুড়ের মতো
ঝুলে থাকে সর্বক্ষণ। পদপ্রদর্শক ছাড়া কোথাও বেরুনো
অসম্ভব। কোন্ দিকে যাবো?
নিরাপদ আশ্রয় কোথায়, ভেবে মরি।
তবুও বেরিয়ে পড়ি, ভূদৃশ্য দেখার লোভে? নতুনের স্বাদ
চেখে নিতে? বিচিত্র খাদ্যের আকর্ষণে? এই সব
কখনো করি না অস্বীকার। তবু সবচেয়ে বেশি
মানুষেরই টানে উড়ি, ঘুরি দেশ-দেশান্তরে।
ভিন্ন মুখ, নানা বর্ণ, ভিন্ন ভাষা নানা দেশে, একটু আধটু
বুঝি, সিংহভাগ অজানার
অন্ধকারে ডুবে থাকে। কিছু বা ইঙ্গিতে
বুঝে নিই। যখন বিকেলে একজন শ্বেতাঙ্গিনী
একটি শিশুর হাত ধ’রে হেঁটে যায় পথে,
চকিতে আমার মনে পড়ে জোবেদার কথা। কখনো বা
সাবওয়ে জুড়ে বয় বাউলের সুর। ট্রেন থেকে
বিদেশিনী নয়, যেন আমার দয়িতা নেমে পড়ে।
বহু মানুষের কদাকার মুখ আমি দেখেছি প্রত্যহ। কতবার
কতজন মানুষেই ঘরে দিয়েছে আগুন দ্বিধাহীন; হিংসা
উলঙ্গ উন্মাদ হয়ে নেচে বেড়িয়েছে
দ্বিগ্ধিদিক নাগা সন্ন্যাসীর মতো। কি ব্যাপক বোমার আঘাতে
বহু লোকালয়, হায়, হয়েছে শ্মশান। তবু আমি
নিত্যদিন মানুষেরই দিএক বাড়াই দু’হাত
কথা বলি, আলিঙ্গনে বাঁধি, বারবার প্রতারিত,
উৎপীড়িত হয়েও সমুদ্র তীরে, উন্মুক্ত প্রান্তরে
অথবা ড্রইংরুমে মেলামেশা করি, আমার আপনকার স্বপ্ন
উচ্চারণ করি অনুরাগে। অচেনাকে ভালোবাসি।
কতবার স্বপ্নভঙ্গ হলো, ইতিহাস রুদ্ররোষে
কখনো কখনো দেয় সাজা; কত না নকল রাজা দিনরাত
অগণিত মানুষের সঙ্গে আঁধারে খেলেছে পাশা
এবং করেছে প্রতারণা। কত মতাদর্শ বিভ্রান্তির ঝড়ে
সুপ্রাচীন হাবেলির মতো ধুলায় লুটায়। কিন্তু আমি
মানবতন্ত্রের পায়ে অকম্পিত সাধনার নৈবেদ্য সাজাই।
নিউইয়র্ক, ১৩ আগস্ট ৯৫
পরাগের মূর্তি
একটু আগেও মগজের সীমানায় কিছুই তো
ছিল না বস্তুত জমা, এমনকি কুয়াশা অথবা
তুলোর রোঁয়ার মতো ভেসে বেড়ায়নি কোনো কিছু।
অকস্মাৎ কী যে হয়; বলা নেই কওয়া নেই, কার
পদপাত চেতনায় আলোড়ন তোলে অন্ধকারে,
বিশীর্ণ নিষ্পত্র ডালে জন্মায় গুল্মের থলোথলো।
যে হরিণ স্বপ্নে দিয়েছিল দেখা জ্যোৎস্নারাতে, তার
দুটি চোখ কথা বলে রাধার ভাষায়, যেন আমি
বৃন্দাবনে কাজল দিঘির ধারে বাঁশি হাতে একা
বসে আছি, এখনই জাগবে সুর চারদিকে ফুঁয়ে
ফুঁয়ে; পরমুহূর্তেই ট্রাউজার আর চেক শার্ট
পরা-আমি কবিতা আবৃত্তি করি পানমত্ত ক্লাবে
ক্ল্যারিওনেটের তালে তালে। অনন্তর বাউলের
বেশে আমাকেই দেখা যায় গৈরিক প্রান্তরে নেচে
বেড়ানোর ভঙ্গিতে, আমার পাশে দেখি না কাউকে,
ডাঙায় নদীর ধ্বনি, আসমানে তারার বৈভব।
চেয়ে দেখি অগ্নিবর্ণ এক বাঘ আমার স্বপ্নের
হরিণের গ্রীবা ছিঁড়ে ফেলে জঙ্গলে মিলিয়ে যায়
নীল কুয়াশায়, আমি ফেলে-আসা পুরানো বাড়ির
পাশ দিয়ে একা হেঁটে চলে যাই, যেন সে নিবাস
ছিল না সেখানে কোনোদিন। যে আমার কবিতার
জীবন সম্প্রতি, তার পদধ্বনি জাগে বৃষ্টির শব্দের
অন্তরালে, আমি তার দিকে হাত বাড়াতেই দেখি
পরাগের অসামান্য মূর্তি এক সমুখে দাঁড়ানো।
১০/৪/৯৫