জ্যাকসন হাইটস-এর কবুতরদের মাঝে
অক্টোবরের প্রায়-দুপুরে জ্যাকসন হাইটস-এর
ত্রিভুজের মতো এক জায়গায় দাঁড়ালাম এক ঝাঁক
ধূসর-নীল কবুতরের মাঝে। আমার হাতে ছোট পলিথিনের
থলিতে কিছু চাল। আমাকে দেখেই
কবুতগুলো ডানায় শব্দ তরঙ্গ তুলে উড়ে গেল
অদূরে। থলি থেকে চাল ছিটোই
পাথুরে চত্বরে, সঙ্গে সঙ্গে কবুতরদের অনেকেই ফিরে
আসে আমার কাছ ঘেঁষে। চত্বরে ছড়ানো
বিস্কুট আর পাউরুটির টুকরোগুলোকে আপাতত উপেক্ষার ছায়ায় রেখে
ওরা আগ্রহে চঞ্চু দিয়ে খুঁটে খেতে থাকে সরু চাল।
আমি গভীর তন্ময়তায় দেখি ওদের
চঞ্চল আহার; মাঝে-মাঝে কবুতরদের
সরে যাওয়া, আবার আমার খুব কাছে ফিরে আসা
চাল কুড়ানোর আশায়। হঠাৎ বিপরীত দিক থেকে কালো
চামড়ার জ্যাকেট-পরা দীর্ঘকায় এক লোক
হেঁটে আসার সঙ্গে সঙ্গে কবুতরগুলো ভীত-সন্ত্রস্ত
ওড়ে আমার মাথার উপর। লোকটা চলে গেলে আমি আবার
চাল ছিটোই। কবুতরের ঝাঁক নেমে আসে ত্রিকোণ চত্বরে।
জ্যাকসন হাইটস-এর কবুতরগুলো জানে না বিশ্বের
এক মহান চিত্রকর পিকাসো শান্তির শপক্ষে
এঁকেছিলেন ভুবনবিজয়ী এক পায়রা, ওরা জানে না
দেশে-দেশে আজ শান্তি কপোত নিষাদের শরাঘাতে ভীষণ কাতরাচ্ছে।
জ্যাকসন হাইটস-এর ত্রিকোণ চত্বরে দাঁড়িয়ে দেখছি কবুতরগুলোকে
গাঢ় মমতায়। ইতিমধ্যে ওরা জেনে গেছে আমি কোনো হন্তারক নিষাদ নই।
নিইয়র্ক, ৯ অক্টোবর ৯৫
তার উদ্দেশে নিয়ে যাই
ষাটোর্ধ বয়স তবু হঠাৎ উদয় শঙ্করের
শিবশঙ্করের রূপে হাওয়ায় তরঙ্গ
তুলে প্রিয়তমা
গৌরীকে বুকের কাছে নিয়ে
নতুন মুদ্রায় সীমাহীন রুক্ষতায়
অকাল বসন্ত সৃষ্টি করবার সাধ জাগে আর
কী সহজে হয়ে যাই বড়ো গোলাম আলীর মালকোশ
নিশীথের দ্বিতীয় প্রহরে।
যে আমার গৌরী, সে আমাকে প্রতিদিন প্রতিরাত
স্বপ্নের খেয়ায়
কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে যায় কী উদ্দাম,
সমুদ্রের নীল জলে ভিজে যাই ক্ষণে ক্ষণে, মাথার উপর
অপূর্ব পাখিরা ওড়ে, তাদের ডানায়
দুপুরের আনন্দাশ্রু, সন্ধ্যার বিষাদ-বিন্দু কাঁপে।
মুহূর্তে মুহূর্তে সে আমাকে
প্রেমের প্রভায় টেনে করে দান তরুণের সতেজ আঙ্গিক।
সে পাতালকন্যা হয়ে অনেক গভীরে ডুব দিয়ে
ভেসে ওঠে পুনরায়, আমার বয়েসী শীর্ণ হাতের তালুতে
তুলে দেয় অপরূপ মণিরত্ন; নিঃস্ব আমি, তাকে
কোনো পরিচ্ছদ
কোনো অলঙ্কার কিংবা অনুরূপ কিছু
নয়, তার উদ্দেশে কেবলি কিছু হৃদয়-নিংড়ানো পদাবলী নিয়ে যাই।
নিউইয়র্ক, ১৩ সেপ্টেম্বর ৯৫
তোমার জন্মদিনের তীরে
যেদিন তুমি জন্ম নিলে
এক মধ্যবিত্ত ঘরে সেদিন বাংলার সবচেয়ে সুকান্ত মোরগ
ডেকে এনেছিল সর্বাধিক প্রসন্ন প্রত্যুষ। সেদিন
গাছের পাতাদের ভিড়ে ধ্বনিত হয়েছিল
অর্ফিয়ুসের বংশীধ্বনি, রঙ বেরঙের ফুলগুলো এরকম
হেসে উঠেছিল যা আগে
কেউ দ্যাখেনি। সেদিন রোদ অনিন্দ্য আবীর হ’য়ে
ঝরেছিল শহরে আর একজন জ্বলজ্বলে তরুণ কবি
তার সবচেয়ে সেরা কবিতাটি রচনা করেছিল। সেই কবিতা
সে তোমাকেই উৎসর্গ করেছিল তোমার অস্তিত্ব বিষয়ে কিছু না জেনেই।
আজ তুমি আর অস্তিত্বহীন নও সেই কবির কাছে,
যে এখন বয়সের মার খেতে খেতে
এখন অবসন্ন, যার সত্তায় সময়ের অজস্র নখরাচিহ্ন।
সে তোমার পরিচয় জানে, সে মালা পরায় তোমার গলায়, জানে
কখন তুমি ভূমিষ্ঠ হয়েছিলে। এখন তো তার
তোমার অনেক কিছুই জানা, প্রায় মুখস্থ।
আজ সেই কবি যখন তোমার দিকে তাকিয়ে থাকে, তখন সে তোমার
ফ্রক-পরা শৈশব, প্রথম শাড়ি পরা কৈশোরকে দ্যাখে। দ্যাখে,
যৌবনের সমুদ্র থেকে প্রফুল্ল নগ্নতায় জলবিন্দু এবং
ফেনা নিয়ে উঠে আসছিলে আফ্রোদিতির মতো।
এখন সে যখন তোমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে
নিবিড় ভালোবাসায়, তখন তার আলিঙ্গনে বাঁধা পড়ে
তোমার শৈশব, কৈশোর আর থরথর পরথম যৈবন। সে ভাবে,
তার আগে কেউ তোমাকে প্রকৃত চুম্বন করেনি।
আজ তোমার জন্মদিন ফিরে এসেছে আরো একবার নিভৃতে
বিকশিত গোলাপের ঘ্রাণ হয়ে, দোয়েলের
গান হয়ে, জ্যোৎস্না স্নাত নদীর ঢেউয়ের নাও হয়ে। এসেই বাসন্তী ভোরে
কবিকে জড়িয়ে ধরল দু’হাতে। বুকে তুলে নিলো
তার কবিতার খাতা, উদ্ভিন্ন আবেগে
মুখ চুম্বন করল তার বহুকালের লেখনীর
তারপর কী মনে হলো, তোমার জন্মদিন
বলল কবিকে, ‘তোমার এই কবিতার খাতাটা
দেবে আমাকে? দুই মলাটের অন্তর্গত এই’ পাতাগুলি
সুখে আআম্র রাখবে। কবি মৃদু হেসে অক্ষরবৃত্তকে
ঈষৎ পাল্টিয়ে উচ্চারণ করে, এই খাতার আরশি নগরেই
বসত করো তুমি। তোমার অবয়বের সৌন্দর্য, তোমার
জন্মলগ্ন থেকেই। তোমার জন্মদিন জলকন্যা হ’য়ে
সাঁতরাতে থাকে কবির মানস সরোবরে।
উচ্ছৃত জলকণাসমূহ রূপান্তরিত কবিতার পংক্তিমালায়। সত্যি বলতে কী,
এই খাতা তোমাকেই অর্পণ করেছি, কবি বলে উদ্দীপ্ত স্বরে,
এর ওপর অধিকার তোমার চেয়ে বেশি আর কার?
তোমার জন্মদিন তাকে এত সঙ্গ দিচ্ছে ভেবে
কবি বিস্ময়ের মধ্যপথে থেকে দেখল,
তোমার জন্মদিন এক ঝাঁক প্রজাপতি নিয়ে
মেতে আছে খেলায়, কয়েকটি পায়রা আর বনদোয়েল
ঘিরে ধরেছে ওকে আদরের প্রত্যাশায়। তোমার জন্মদিনকে
কবি খুব কাছে টেনে নিয়ে জানায় অভিবাদন।
তুমি, হে সুপ্রিয়ার জন্মদিন, কবির কণ্ঠস্বর স্তব্ধতাকে বাঙ্ময় করে,
বার বার ফিরে আসবে। আমি যখন সবকিছু ছেড়ে ছুঁড়ে
বিদায় নেবো, তখনও তোমার সত্তায় আলোচ্ছটায়
উদ্ভাসিত হবে গাছের পত্রালি; তোমার দৃষ্টির স্পর্শে
জেগে উঠবে শূন্য, নিদ্রিত পথ। তুমি প্রতিবার
এসে দাঁড়াবে এক চিলতে বারান্দায়, হাত রাখবে সেই
জানলার গ্রিলে, যেখানে একজন দৃষ্টিকাতর কবি
খুব কষ্ট করে দেখতে চাইতো শহুরে,
কৃপণ নৈসর্গিক শোভা।
তোমার জন্মদিনের তীরে বয়সী কবি
বাঁধল তার ভাঙা নৌকো। তোমার জন্মদিন চতুর্দিকে
আনন্দের রেণু ছড়াতে ছড়াতে তার রাঙা চরণ
রাখল সিএ নায়ে। আয়ত দু’টি চোখ মেলে
বলল, ‘ও রঙিলা নায়ের মাঝি, ভাসাও তোমার নাও
অকুল দরিয়ায়। একবারও ভেবে দেখল না, আকাশময়
ঘোর আন্ধার নেমে আসতে পারে,
তলিয়ে যেতে পারে ভগ্ন তরী। অনুপ্রাণিত নাইয়া তোমার
জন্মদিনের অপরূপ সৌন্দর্যে লীন হ’য়ে অপটু
দু’হাতে বাইতে লাগল বৈঠা।
কখন যে ওরা পৌঁছে গেল অভিনব সুবর্ণ রেখার তীরে
আসমানে গোধূলি ছড়িয়ে পড়ার আগে, বুঝতেই পারল না।
তোমার জন্মদিন আর সেই সাদা চুলের নাইয়া
পারুল বিছানো মাটিতে নেমে
পুঁতে দিলো একটি নিশান। উদ্দাম হাওয়ায় পত পত উড়তে
শুরু করে পতাকা, যাতে নক্ষত্রের হরফে লেখা ‘ভালোবাসা চিরঞ্জীব।
৪/৩/৯৫