কৃষিকাজ করি না, তবুও
পিতামহ কিংবা পিতা করেন নি কৃষিকাজ, যদিও তাঁদের
চাষাদের বিষয়ে জ্ঞানের
অভাব ছিল না কোনো গ্রামীণ হওয়ার হেতু। আমি
জন্মেছি শহরে, তবু কিছু শুনে কিছু নিজে দেখে
পতিত জমিন আর চষা
ক্ষেতের ফারাক জেনে গেছি।
দেখেছি কী ক’রে রৌদ্রে পুড়ে
লাঙল চালায় ক্ষেতে কর্মঠ কৃষক, বীজ বোনে
ফসলের প্রত্যাশায়। যখন ধানের শীষ চোখ
মেলে নবজাতকের মতো,
কৃষকের চোখে ফোটে অগণিত তারা।
মেঠো ইঁদুরের উৎপাতে অথবা পঙ্গপাল
অকস্মাৎ হানা দিলে ক্ষেত্রের
কৃষকের বুক ফাটে আর
ঘোর অমাবস্যা নামে চোখে;
কৃষকের ভেতর প্রবেশ ক’রে এ-কথা জেনেছি।
কৃষিকাজ করি না, তবুও অনুরূপ কর্মে আমি নিবেদিত
বহুকাল। বর্ষণের করুণা এবং
খরার দারুণ স্বৈরাচার, ফসলের বিনষ্টির
অভিজ্ঞতা আমার অজানা নয়, যেহেতু আমিও শ্রমে ক্লিষ্ট
ভিন্নতর জমিন কর্ষণ করি, বীজ বুনি, আগাছা নিড়াই
গোলায় ফসল তুলি উদ্ভাসিত মুখে।
নিউইয়র্ক, ৯ অক্টোবর ৯৫
কেন এরকম হয়?
কেন এরকম হয়? হবে? কেন তুমি অভিমানে
স্তব্ধ হয়ে যাবে? কেন এতক্ষণ করবে না ফোন?
আমার সুবিধে নেই, টেলিফোনও কিছু বিগড়ে আছে।
এই যে মুহূর্তগুলি, ঘন্টাগুলি আমাকে চিবিয়ে
খাচ্ছে হিংস্র বিড়ালের মতো, তুমি কি বোঝো না? হায়,
এ বয়সে আমি আর কত কষ্ট পাবো? কী আমার
অপরাধ, বুঝতে অক্ষম। গাছ হ’য়ে জন্মানোই
ছিল ঢের ভালো, বিষাদের লেশমাত্র থাকতো না।
তোমাকে উপেক্ষা করি, এই মতো ভাবনায় তুমি
সম্প্রতি কাতর নাকি! অথচ আমি যে সারাক্ষণ
জপছি তোমাকে, এমন কী স্বপ্নের ঘোরেও করি
উচ্চারণ ভালোবাসা তোমার উদ্দেশে। আলিঙ্গনে
বাঁধি তোমাকেই মাঠে, নদী তীরে, পাহাড়ে, জঙ্গলে।
কীভাবে তোমার রোষ, প্রিয়তমা, অস্তমিত হবে?
১২/৪/৯৫
ক্যামেলিয়ার প্রতি
ক্যামেলিয়া, কী সুন্দর ফুটে আছো যুবতীর মতো
আমার পুরনো এই লেখার টেবিলে। কী বিশদ
নির্জনতা ঘিরে আছে তোমাকে, আবেশে চোখ বুজে
আসে, কিন্তু বারবার তোমাকেই চেয়ে দেখি, জানি,
তুমি থাকবে না বেশিক্ষণ লেখার টেবিলে। ম্লান
হতে শুরু করেছে তোমার রূপ, পরে তুমি যাবে
আবর্জনা-স্তূপে; এভাবেই সুন্দর বিষণ্ন চলে
যায়, মনে লগ্ন থাকে তার কিছু নিভৃত সুবাস।
তোমাকে সরিয়ে ফেলবার পর কেমন শূন্যতা
আমার হৃদয় জুড়ে আছে। যেদিন প্রথম এলে
আমার এ ঘরে তুমি, মনে পড়ে, আনন্দ কলাপ
মেলেছিল, তোমার শরীরে ছিল কোমল, মধুর
স্পর্শ যার, তারও রূপ তোমার মতোই ঝরে যাবে
কোনোদিন? যদি যায়, ততদিন আমি থাকব না।
১৭/৪/৯৫
ছায়া গোধূলির আড়ালে
এই পরবাসে ছায়া গোধূলির আড়ালে
তুমি কি হঠাৎ মনের খেয়ালে দাঁড়ালে?
একটু আগেও ভাবিনি তোমার উপস্থিতি
এখানে আমার হৃদয়ে আনবে নতুন তিথি।
কত যে আকাশ কত সমুদ্র পেরিয়ে
এই ছোট ঘরে তোমার চরণ বাড়ালে।
কাছে এসে তুমি বসলে নম্র আঙ্গিকে,
তারই আভা ফোটে বেগানা প্রহরে চারদিকে,
যমজ চোখের কালো বিদ্যুৎ ছড়িয়ে
আমার মনের শঙ্কা, নিরাশা তাড়ালে।
ক্ষীণ দৃষ্টিতে দেখিনি তোমাকে পুরোপুরি;
কালো হাওয়া এসে হঠাৎ তোমাকে করে চুরি।
ছুঁইনি তোমাকে; কে যেন বলল আড়ালে
‘হায়, কবি তুমি বুঝলে না কী-যে হারালে!’
নিউইয়র্ক, ৮ সেপ্টেম্বর ৯৫
ছায়ার পুতুল
যখন আমরা দু’জন সন্ধেবেলা
কোথাও নিবিড় বসে থাকি মুখোমুখি,
বুঝি না কী ক’রে সময় যে ব’য়ে যায়,
সময়ের দানে আমরা তবুও সুখী।
হাতে হাত রেখে, চেয়ে থেকে, কথা ব’লে,
এবং নীরবে কাটে বিহ্বল বেলা;
কখনো হঠাৎ কী-যে হয় নিমেষেই
ছায়ায় মলিন দীপ্ত মিলন মেলা।
আমার অতীত কখনো সখনো কালো
প্রেতের মতোই চেপে ধরে শ্বাসনালী;
তোমার একটি কি দু’টি ঘটনা ক্রূর
দংশনে করে আমাকেই ফালি ফালি!
বুঝি এই সব ছায়ার পুতুল শুধু,
তবু কেন মিছে এমন মুষড়ে পড়ি?
আমার প্রহর কেন হাহাকার হয়?
কেন বারবার বেঁচে উঠি, বেঁচে মরি?
কখনো কখনো এমন নিঃস্ব লাগে,
যেন মরুভূর বুকে প’ড়ে থাকি একা
কিন্তু হঠাৎ কোন্ সে ইন্দ্রজালে
ক্ষুধিত আঁধারে উদিত চন্দ্রলেখা।
ছায়া-পুতুলেরা আমার জগৎ থেকে
নেবে কি ছিনিয়ে ঋদ্ধ সোনালী দিন?
এই যে এখনো রয়েছে তোমার প্রেম,
কী ক’রে শুধবো সেই দুর্লভ ঋণ?
এক রাতে তুমি বললে, ‘ছায়ারা নেই,
কবর দিয়েছি; আমরা দু’জন আছি।
যতদিন জ্বলে আমাদের প্রেম-দীপ,
এসো ততদিন নিজেদের মতো বাঁচি।
২০/৩/৯৫
জন্মদিন, ১৯৯৫
আমার ভেতরে থাকে সর্বক্ষণ একজন পাখি
নিবিড় একাকী।
নড়ে চড়ে; রোদের রঙের মতো, আঁধারের মতো
নরম পালক খসে, আবার গজায় ক্রমাগত
কে জানে কেমন ইন্দ্রজালে! নড়লে গাছের পাতা
অথবা ফুটলে ফুল সে পাখির মাথা
নত হয় কৃতজ্ঞতা হেতু,
কার কাছে জানা নেই তার, হাওয়ায় বিপুল সেতু
গড়ে ওঠে চোখের পলকে, লোক পারাপার চলে
অবিরাম। পাখি কী অনলে
জ্বলে মাঝে-মাঝে, অগ্নিপুষ্প হ’য়ে যায়,
হ’তে পারে মেঘ খন্ড, বুক-চেরা ঘোরে গান গায়।
আমার ভেতরকার পাখিটিকে আহারের অছিলা ছাড়াই
বাহিরে সম্পূর্ণ আনি, পক্ষী রূপে পাহাড়ে দাঁড়াই
সাবলীল, স্বর্ণপক্ষ ঈগলের সঙ্গে সখ্য গড়ি, মেঘে উড়ি,
ঝর্ণাতলে গেলে পায়ে লাগে পাথরের কিছু নুড়ি
সূর্যোদয়ে কি সূর্যাস্তে, এ মুহূর্তে ভেসে যেতে পারি
বিদেশের মমতার তাঁবু ছেড়ে ছুঁড়ে তোমার আপন বাড়ি,
তোমার অন্তরে চঞ্চু ঘষে যদি বলে ফেলি, ‘আজ এ দীনের
জন্মদিনে কোন্ উপহার দেবে, প্রিয়তমা? তুমি তো দিনের
আলোকে অধিক আলো ক’রে
উৎসুক পাখির হৃদয়ের কানা ভ’রে
বলবে গভীর স্বরে, ‘মনপ্রাণ যাহা ছিল সবই
তোমাকেই না চাইতে কবে দিয়ে ফেলেছি, হে কবি।
নিউইয়র্ক, ২০ অক্টোবর ৯৫