একটু পরেই যাত্রা
একটু পরেই যাত্রা আমার, অথচ ফ্লোরিডার
কিসিমি শহর রইল চুপচাপ, নির্বিকার;
বলল না, কেন যাবে? থাকো না এখানে
আরো ক’টা দিন। বলল না,
এলোমেলো চুলে চালাও চিরুনি যত্ন ক’রে, শার্টে
লাগাও বোতাম ঠিকঠাক, দেখে নাও সফেদ ক্লসেট থেকে
ট্রাউজার ভরেছো তো স্যুটকেসে, ফেলে
যাচ্ছো না তো কিছু?
আইড্রপগুলো পুরোছো পকেটে না কি রয়ে গেলো
টেবিলের কোণে জন অ্যাশবেরিসহ?
সত্যি সত্যি চলে যাচ্ছো? চলে যাবে তুমি?
কিসিমির কণ্ঠে এ রকম প্রশ্ন হয়নি ধ্বনিত,
অথচ আমিতো এর সতেজ সবুজ গাছপালা,
টলটলে হ্রদ, বৃষ্টিধোয়া রাত, জ্বলন্ত দুপুর
গোধূলিতে বাগানের ফুল,
ভোরবেলাকার পাখিদের কলতান
এবং ডিজনি ভিলেজের প্রতিবেশ
ভালোবেসে ক্ষীণদৃষ্টি দু’ চোখকে সজল করেছি।
আখেরে বিদায় বেলা আসে, বিমানন্দরে পৌঁছে
আত্মজা আমাকে মমতায় ব্যাকুল জড়িয়ে ধরে।
ওর প্রতি অশ্রুকণা বলে, ‘চলে যাবে?
সত্যি তুমি চলে যাবে, বাবা?
নিরুত্তর আমি তার কপালে একটি চুমো এঁকে
স্নেহপাশ ছাড়িয়ে এগোই।
নিউইয়র্ক ৬/১০/৯৫
ও বাংলার পাখি
ও বাংলার পাখি, শ্যামা পাখি, রামপ্রসাদের গান
হয়ে তুমি এমন বিহানে
এখানে কী করে এলে? এই জানালায়
বাংলার সবুজ ঘ্রাণ ছড়িয়ে রয়েছে নিরিবিলি
ঝরিয়ে সুস্নিগ্ধ সুর। কে তোমাকে পাঠালো
আমার একান্ত কাছে হু হু পরবাসে? বলবে না
তুমি সুনিশ্চয় মাথা খুঁড়ে মরলেও
কঠিন দেয়ালে, তবু জানি ও বাংলার পাখি, ওগো
শ্যামা পাখি, আমার অন্তরে জানি, যার
ছলছল দু’টি চোখ তোমাকে করেছে বাধ্য আজ
দূর দূরান্তের নানা মেঘে ছুঁয়ে ছুঁয়ে
নিউইয়র্কের এই কংক্রীটের জঙ্গলে গোপনে
এড়িয়ে সকল ফাঁদ হে রামপ্রসাদী সুর, হে অমল স্মৃতি
ও বাংলার পাখি, শ্যামা পাখি, তুমি বোলো গিয়ে তাকে
এই পরবাসে
আমার বিরস দিন যায়- যেন আমি
নিষ্ঠুর মরুর বুক পাড়ি দিয়ে চলেছি, কোথাও
মরুদ্যান নেই, ফণিমনসার ঘায়ে চোখ ফেটে রক্ত ঝরে;
বুঝি বা হারাবো দৃষ্টি অচিরেই! শ্যামা পাখি, বোলো তাকে
তার বিচ্ছেদের চৈত্রে আমি পুড়ে যাচ্ছি, এ অনল
কী করে লুকাবো আমি? কীভাবে নেভাবো? কোথায় সে জলধারা?
ও বাংলার পাখি, শ্যামা পাখি, কাছে এসো, খুব কাছে
তোমার কোমল বুকে মুখ রেখে খানিক জুড়াই অন্তর্জ্বালা।
১৮/৮/৯৫
ও ভ্রমর
ও ভ্রমর, ভ্রমর রে তারে কইও গিয়া
আমার রাধার বিচ্ছেদের অঙ্গারে আমি ফুইট্রা মরি
খইয়ের মতো। কত দিন কত রাত যায়
আমি মাথা কুইট্রা মরি কংক্রীটে, তবু
দিদার পাই না তার; ও ভ্রমর
তারে কইও গিয়া কানে কানে নিরালা নিশীথে।
ও ভ্রমর, ভ্রমর রে আমার চক্ষের পিদিম
নিভু-নিভু জ্যোতি নিভবার আগে
তারে দেখতে না পাইলে
আমার পরাণ ফাইট্রা যাইবে ভ্রমর গো।
ভ্রমর, তুমি আমারে এই পাষাণ নগরে
একবার দেইখ্যা যাও,
দেইখ্যা যাও কী হালতে আছি আমি
পোড়া অঙ্গ লইয়া।
ও ভ্রমর, ভ্রমর রে তোমারে ডাইক্যা মরি পাতালে,
পাথরের জঙ্গলে, আইসো আমার ধারে, আমার
শেষ কথা শুইন্যা তুমি তারে কইও গিয়া
ও আমার ভ্রমর রে।
ও আমার ভ্রমর, ভ্রররে আমার রাধারে আইজ
খুঁইজ্যা পাই না কাছে-ধারে, কোনোখানে।
ভ্রমর গো, কী কইরা আইবারে তুমি অ্যাত্ত দূরে
পরাণের বাংলা ছাইড়া? কইয়া যাও, ও ভ্রমর, কইয়া যাও রে।
নিউইয়র্ক, ২৫/৮/৯৫
কবি আক্রান্ত হ’লে
এই গ্রহের যে-কোনো অঞ্চলের যে-কোনো
স্বেচ্ছাচারী শাসক যখন কারাবন্দী করে
একজন প্রকৃত কবিকে, যখন একজন কবি
আক্রান্ত হন মৌলবাদী ধর্মান্ধদের হাতে,
অথবা তাকে যে-কোনো উৎপীড়ন তাড়া করে, লাঞ্ছিত করে,
তখন কি লতাগুল্ম, গাছপালা, পশুপাখি, পাহাড়,
পথরেখা, নদীনালা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে? বিলাপধ্বনিতে
ভরে ওঠে ভূমন্ডল আর আকাশের পর আকাশ?
না, এমন কিছুই ঘটে না। যখন কোনো স্বৈরাচারী শাসক
একজন প্রকৃত কবিকে
অন্ধকার সেলে পোরে জন্তুর মতো,
কিংবা সন্ত্রাসী ধর্মান্ধরা কোনো কবির
জীবন দাবি করে, বোমা ফাটায় তার ঘরে, অথবা
দেশছাড়া করে উচ্ছৃঙ্খল কোলাহলে, তখন লক্ষ্মী প্যাঁচার
ঘাড়ের লোমগুলো ফুলে ওঠে, রক্ত ঝরে কোকিলের স্বরে,
জলপাই গাছের পাতাগুলো
অঙ্গার ঝরায় এখানে-সেখানে,
আকাশের মেঘগুলো হয়ে যায় রাগী সিংহের কেশর,
ফোঁসে নদী, রুদ্ররোষে আদিম দেবতার মতো মাথা ঝাঁকায় অনড় পাহাড়।
নিউইয়র্ক, ৯ সেপ্টেম্বর ৯৫
কবিতার একটি পঙক্তি
বহু বছর আগে লিখেছিলাম এক সনেটে-
‘যে-তুমি আমার স্বপ্ন, অন্নজল, অস্তিত্বের গান।
কার উদ্দেশে রচিত হয়েছিল সেই পঙক্তি,
আজ আর স্পষ্ট মনে পড়ে না। কোন এক কুহকিনী
সেই পঙক্তি গলায় দুলিয়ে দমকা হাওয়ার মতো
মিলিয়ে গেছে ঘন কুয়াশায়। আমার কয়েকটি দিন
লুট করে সে উধাও। তার অনুপস্থিতি পারেনি
আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে অশ্রুকণা অথবা দীর্ঘশ্বাস।
আজ এতকাল পরে তুমি, হ্যাঁ তুমি,
পা রেখেছে আমার ধূসর প্রাঙ্গণে, রঙ বেরঙের
অনেক পাখি উড়িয়ে দিয়েছ আমার আকাশে, তোমার শরীর
বীণা হয়ে বেজে উঠেছে আমার অন্তরে।
প্রথম যেদিন তোমাকে দেখলাম আমার জীবনের
সবচেয়ে আশ্চর্য বিকেলে, সেদিনই মনে হলো
আমার পুরনো কবিতার সেই পঙক্তি, সেই নৈবেদ্য
একান্ত তোমারই প্রাপ্য, আর কারো নয়। কেন আমি আগে
সেই শব্দমালার অপব্যবহারে মেতে উঠেছিলাম? আমার সেই
উপব্যবহার মার্জনায় ধুয়ে পঙক্তিটি তুমি নিত্যনতুনরূপে গ্রহণ করো প্রিয়তমা।
নিউইয়র্ক, ২৫/৮/৯৫