একজন ঈগলের কথা
সাদা মাথা-অলা ঈগল আমি,
আমার নিজস্ব নিঃসঙ্গতার সুউচ্চ চূড়ায়
অধিষ্ঠিত। সম্প্রতি ক্ষীণদৃষ্টিহেতু উড়ালে
অবাধ গতি নেই, নিচে খুব তীক্ষ্ম নামার কালে
কণ্ঠ চিরে বেরোয়া না জোরালো চিৎকার। শীতের
কনকনে হাওয়ায় আমার পালকগুলো থরথর
কাঁপে বাঁশপাতার মতো। কাদাজলে
পড়ে-থাকা গাছের পাতার গন্ধের মতো
কী একটা আমাকে নিয়ত বিরক্তির
উৎকট বৃত্তে ঘোরায়।
দৃষ্টির প্রাক্তন উজ্জ্বলতা কমলেও চাঁদ ঝলসে ওঠে
আমার চোখে, চাঁদকে ফুঁ দিয়ে কয়েকটি রূপালি বুদ্বুদ
সৃষ্টি করি; কিছু নক্ষত্র টাকশালের নতুন মুদ্রা হয়ে ঝনঝনায়
চৌদিকে আমার আহ্বানে। কখনো মেঘের ছায়া
ভেসে যায় আমার উপর, কখনো
সাপের মতো বিদ্যুৎ ঝলসায় আকাশে। মাঝে মাঝে
ঝিমুনি ধরে। কী যেন একটা পাশ দিয়ে
চলে যায়, টের পাই, স্পষ্ট দেখি না। শক্তি
অবসিত প্রায়, অথচ ক্ষুধা ও তৃষ্ণা
নাছোড় সঙ্গী। চলে কোনোমতে শ্বাসটানার সংগ্রাম নিরন্তর। মাঝেমাঝে
অনুভবে আসে লাস্যময়ী তৃণের নাচ। বুকের কাছে রেশমি ফুলের উন্মীলন আর
আমার মাথার ভেতর বিভিন্ন ঋতু
স্বপ্ন তৈরি করে, স্বপ্নেরা আমার ডানায় জাগায়
উড়ালের অদম্য স্পৃহা, ধারালো চিৎকার
পূর্ণিমার নিশীথের তৃতীয় প্রহরে
বুকে তোলপাড় করে প্রণয়িনীর সঙ্গে মিলনের আকাঙ্ক্ষায়,
যে এখন অনুপস্থিতির ঘেরাটোপে বন্দিনী।
দুঃসহ বেদনাপ্রতিম প্রণয় আর বিচ্ছেদের
প্রহারে কাতর আমি এই নির্দয় চূড়ায় আঁধারে
ক্ষুধার্ত নিঃসঙ্গতাকে আহার জোগাই অন্তর-ছেঁড়া
গান দিয়ে, এই গান কী করে উৎসারিত, জানি না।
এ কি এক ধরনের দেহমনের যুদ্ধ?
এ কি প্রকৃত শান্তি? জানি না, জানি না, জানি না।
ফ্লোরিডা,২৫ সেপ্টেম্বর ৯৫
একটি উত্তর-আধুনিক কবিতা
কবিতা লিখতে না-পারার দীর্ঘ খরা দেখে দেখে
চোখ পুড়ে যায়,
চোখ ফেটে রক্ত ঝরে। হে মধুর, কখনো কখনো
তোমার নিবাসে গিয়ে দ্বিপ্রহরে অথবা সন্ধ্যায়
বলি, মনোকষ্টে আছি, যেহেতু কবিতা
পালিয়ে বেড়ায় ঘন বনে।
কবিতা লিখতে না পারার কষ্ট জানি
তোমার চুম্বন থেকে বহুকাল নির্বাসনে থাকা
যেন; তুমি হাত ধরে আমাকে এক্ষুনি
কবিতার যমুনার ঘাটে পৌঁছে দাও; জল পান ক’রে তিয়াস মিটাই।
যখন তোমাকে দিকে প্রগাঢ় তাকাই,
বলো তুমি আচঁল গুছিয়ে,
‘কী দেখছো কবি? দ্যাখো চর্যপদের হরিণী ছোটে
এখন উত্তর-আধুনিক জামানায়
পায়ে দলে আন্ধাধুরা পঙক্তিমালা আর
গৈরিক ডাঙায়
চিবোয় হরিৎ তৃণ। সে তোমার কানে কানে কিছু অনুপম
পংক্তি বলে দেবে, লিখে নাও।
এমন চুম্বনহীন শ্রাবণের দিন, হায়, ক্যায়সে গোঙাইব
এ ভরা বাদরে বিদ্যাপতি এসে দেবেন কি বলে?
বাইরে শীতল জলধারা,
আমার ভেতরে বয় মোহন আগুন। তুমি পাশে
দাঁড়ালে অথবা দূরে সোফায় এলিয়ে দিলে প্রতিমা-প্রতিম
দেহখানি তোমার অজ্ঞাতেয়ামি মদন বাউল হ’য়ে নাচি,
সবুরে মুকুল ভাজি, অকস্মাৎ কবিতা আমাকে
বেড় দিয়ে ধরে, তুমি দ্যাখো, তোমাকেই বুকে বাঁধি।
২১/৭/৯৫
একটি কবিতা লিখে
একটি কবিতা লিখে ছিঁড়ে ফেলাটাই সমীচীন;
কিন্তু একটি কি দু’টি বাক্যবন্ধ, কোনো চিত্রকল্প,
কোনো উপমার প্রতি কী রকম মায়া জন্মে যায়
ব’লে শব্দক্রীড়ার সময় ছিঁড়ে ফেলতে পারি না
সদ্যোজাত কবিতাটি। লেখা শেষ ক’রে পুরোপুরি
যদি কেটে দিই কিংবা কুটি কুটি ছিঁড়ে ছুঁড়ে ফেলি
বাজে কাগজের সঙ্গে হৃদয়-নিংড়ানো কিছু কথা,
আমার সত্তার অংশ, যাকে এত বেশি ভালোবাসি,
তার হাসি, চোখের চকিত চাওয়া, সন্ধ্যার আঁধারে
সোনালী বাহুর আভা ঝরে যাবে পরাগের মতো।
ফলত নিজের দুর্বলতা হেতু, যতই নিষ্ফুল
হোক এই শব্দক্রীড়া, রচিত কবিতা রেখে দিই।
১২/৪/৯৫
একটি প্রশ্ন
ফ্লোরিডার কিসিমি শহরের এক নিঝুম অ্যাপার্টমেন্টে
বসে আমি লিখছি। আমার
মেজো মেয়ে ফাওজিয়া গ্যাছে এক প্রতিবেশিনীর
অ্যাপার্টমেন্টে; ওর বর গ্যাছে কাজে। ওদের তিন ছেলে
হৃদয়, উপল এবং জেহিন ইশকুল। একলা
ঠান্ডা ঘরের জানালা দিয়ে দেখলাম জালিম রোদ বেদম চাবকাচ্ছে
গাছপালা, বিনীত অ্যাপার্টমেন্ট এবং
একটি কি দু’টি মোটর কারকে। তৃষ্ণায় ফেটে যাচ্ছে
দুপুরের বুক। নিঃসঙ্গতা আমাকে নিয়ে কেলিপরায়ণ; যেমন
বেড়ালের থাবা জব্দ ইঁদুরকে নিয়ে খেলায় মত্ত।
মনে পড়ল চার বছর ছুঁই ছুঁই আমার পৌত্রী নয়নাকে, যাকে
রেখে এসেছি ঢাকায়। তার দুটি কালো চোখে
দিগন্তে নেমে-আসা শ্রাবণ মেঘের গাঢ়, টলটলে মায়া।
জানি না, সে এখন কী করছে। হয়তো ভোরবেলা
বারান্দায় লুটিয়ে-পড়া
এক ফালি গাছের ছায়া নিয়ে খেলায় মেতেছে,
হয়তো চিলের ছোঁ থেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে
নিজের বুকে জড়িয়ে ধরেছে কবুতরছানাকে, হয়তো জীবজন্তুর
ছবি-অলা একটি বইয়ের পাতা ওল্টাচ্ছে আপন মনে।
আজ টেলিফোনে কথা হলো নয়নার সঙ্গে।
মধুর কণ্ঠে সে জিগ্যেস করল আমাকে, ‘তুমি কেমন আছো দাদাভাই?
তুমি কবে আসবে?’ ‘শিগগিরই চলে আসবো,’ জানালাম ওকে।
ভবিষ্যতে একদিন নয়নার সত্তায় ক’টি বসন্তের ঘ্রাণ সঞ্চিত হবে, জানব না।
সে ব্যাকুল প্রশ্ন করবে,
‘দাদাভাই, তুমি কবে আসবে?’ সেদিন
তাকে জবাব দেওয়ার জন্য আমি কোথাও থাকব না।
ওর প্রশ্ন ধ্বনি প্রতিধ্বনি তুলে মিলিয়ে যাবে
নির্দয় শহরের কৃপণ নিসর্গে, দালানে, পথের ধুলায়।
ফ্লোরিডা, ২৯ সেপ্টেম্বর ৯৫