সেন্ট্রাল পার্কে
ম্যানহ্যাটানের বুকের ভেতর জেগে-ওঠা নিসর্গ-ধনী
সেন্ট্রাল পার্কের কিছু মরা পাতা
আমার মোকাসিনের তলায় আর্তনাদ ক’রে ওঠে।
লেকের ধারে সবুজাভ কাঠের বেঞ্চিতে বসে। কয়েকটি
কবুতর ইতস্তত কী যেন খুঁটছে ঘাসে।
অদূরে গাছতলায় একজন যুবক
গলা ছেড়ে গান গাইছে গীটার বাজিয়ে।
আমার পাশ দিয়ে এক জোড়া তরুণ-তরুণী পরস্পর
হাত ধরে যাওয়ার সময় আড় চোখে
দেখে নেয় মামুনের কর্মলগ্ন ভিডিও ক্যামেরা।
শাদা, ধুলোটে মেঘগুলো ভেসে যায়
মানুষের প্রতি উদাসীন। হেনরি মুরের ভাস্কর্য
অমরতার সঙ্গে অন্তরঙ্গ কথা বলে
এই নম্র রৌদ্র ছায়ায়
পড়ল তোমাকে মনে। যেভাবে তুমি
আমার পাশে বসতে কিংবা কিছুদূরে ব’সে
বলতে নানা কথা হাসির আভা ছড়িয়ে, তোমার
চোখের অতল চাওয়া আমাকে করতো আদর
এই সব এই মুহূর্তে সেন্ট্রাল পার্কে হলো উদ্ভাসিত।
লেকের প্রসন্ন কিনার আমাকে হঠাৎ
স্মরণ করিয়ে দেয়, মাঝে মাঝে তুমি বলতে একটি ঝর্ণা আর
তার নুড়িগুলোর কথা, যেগুলো এখন
আমার হাতের তালুতে এক স্বপ্নপুরী হ’য়ে বাজে সেন্ট্রাল পার্কের
দুপুরে; তুমি জানলে না।
নিউইয়র্ক, ১৫ সেপ্টেম্বর ৯৫
স্বদেশে ফেরার পর
তিন মাস পর শ্যামলীর গলিতে ঢুকতেই
মনে হলো রাধাচূড়া গাছটা তরুণীর মতো হেসে উঠল
শরীর ঢেউ তুলে। গোলাপের নার্সারি জানালো অভিবাদন,
কয়েকটি গোলাপ লাফিয়ে আমার বুকে মাথা রাখতে চাইল
গভীর অনুরাগে। একটু এগোতেই আমার
বসতবাড়ির পেয়ারা গাছ স্বাগত ভঙ্গিতে
আমার দিকে বাড়িয়ে দেয় হাত। ওর পাতাগুলো
আমাকে জড়িয়ে নেয় সংলাপে। পেয়ারা গাছ আর আমি
পরস্পর কথা-স্রোতে ভাসি, যেমন দুই কবি। আমার উদ্দেশে
অনাবিল আনন্দে হৃদয় খুলে ঘর-দুয়ার।
নিঃসঙ্গতার চোরাবালিতে ডুবতে-ডুবতে লক্ষ করি,
দোতলায় ওঠার সিঁড়িগুলো বহুদিন
অপেক্ষায় ছিল আমার। অধীর আগ্রহে একে-একে
ওরা সবাই আমার পদচুম্বন করে। কৃতজ্ঞচিত্তে ওদের দিকে
তাকাতে তাকাতে দেয়ালের ফটোগ্রাফগুলোর
আদর কুড়িয়ে, আপনজনের বিকশিত আনন্দে ডুব সাঁতার কেটে
প্রবেশ করি নিজের ঘরে, যেখানে অপেক্ষমান
আমার লেখার টেবিল, বুক শেলফ আর
পুরনো দিনের বিশ্বস্ত এক চেয়ার। কয়েকটি নতুন সোফা
আমাকে দ্যাখে উৎসুক দৃষ্টিতে আপন করে নেওয়ার
তীব্র ইচ্ছায়। আমি আমার কবিতার খাতার মুখ চুম্বন ক’রে
ওর অন্তরের ঘ্রাণ নিই বার বার।
আমার ভেতরের নিভৃততম সত্তা
কিছুক্ষণ কল্পনার নুড়ি কুড়ায়, এক পেয়ালা চা খেতে খেতে
বাইরের দিকে চোখ মেলে তাকায় আর ভাবে
যার প্রতিটি হৃৎস্পন্দনে আমার স্মৃতি, স্বপ্ন, বর্তমান
এবং ভবিষ্যৎ ঢেউয়ের প্রদীপের মতো জ্বলে, দোলে
সে এখন তার অনুপস্থিতিকেই এখানে জাজ্বলমান করে রেখেছে।
১/১১/৯৫
হও নীলকণ্ঠ
বাইরে ভীষণ কোলাহল, অনেকের চড়া গলা
প্রজ্ঞার গভীর বাণী নিয়ত ছাপিয়ে ওঠে, কারো
কারো কিছু ইতর, অশ্লীল ভঙ্গি ভব্যতাকে করে
বিদ্রূপ; কলহপরায়ণ লোকগুলো অকারণ
ক্ষেপে ওঠে, তাড়া ক’রে বেড়ায় ধীমান ব্যক্তিদের
যখন তখন, পথে পথে ঘোরে দাঁতাল শুয়োর!
তুমি কি ভন্ডামি, ডাহা মিথ্যা, কপটতা, উচ্ছৃংখল
ধর্মান্ধ ভিড়ের কাছে স্বীকার করবে নতি? ম্লান
মুখে বসে থাকবে একা? ভ্রষ্ট রাজনীতিবিদ আর
প্রগতির নেতাদের পিঠটান দেখে হতাশায়
নিয়ত থাকবে ডুবে? তোমার চৌদিকে গজরাচ্ছে
বটে হিংস্র অন্ধকার, তবু নিজেকে আলোর ধ্যানে,
সত্য-সুন্দরের সাধনায় মগ্ন রাখো নিত্য হও
নীলকণ্ঠ ভালোবাসো, যাকে গাঢ় ভালবাসা যায়।
২০/৪/৯৫
হাসান হাফিজুর রহমানকে মনে রেখে
যখন হঠাৎ কোনোদিন তোমার স্বাক্ষরময়
কবিতার বই হাতে নিই, মন কেমন যে করে,
কী ক’রে জানাই? মেঘাচ্ছন্ন আকাশের বিদ্যুল্লতা
খেলে যায় আজ এই বয়সের ধূসর প্রান্তরে।
মনে পড়ে যৌবনের জয়োল্লাস, পলাশের দিন-
মিটিং মিছিল, জনসভা, মধুদা’র ক্যান্টিনের
যুক্তি, তর্ক, গপ্পো, সবচেয়ে বেশি কবিতার রাত
মনে পড়ে। মাথা তোলে ভার্সিটির স্নিগ্ধ আমতলা।
আজ তুমি জনপথে নেই, মিছিলেও কোনোদিন
তোমার শ্যামল মুখ ঝলসে ওঠে না, তুমি আর
লেখার টেবিলে ঝুঁকে বসবে না, সন্তানের প্রতি
তাকাবে না মমতায়। তোমার নিবাস থেকে সাড়া
না পেয়ে পদ্যের পঙ্গক্তিমালা চলে যাবে বহুদূরে;
বন্ধু, তবু তুমি তরঙ্গিত আমাদের চেতনায়।
২৯/৩/৯৫