সন্ধানের পরেও
বহু চেষ্টা, বহু অনুসন্ধানের পরেও মানুষ
কোথাও পায় না খুঁজে অভীষ্ট জিনিশ
কখনো কখনো। খরতাপে
পুড়ছে চৌদিক, দুপুরের বুক ছিঁড়ে ক্রমাগত
ডেকে যায় পিপাসার্ত কাক।
গরু, মোষ অসহায় তাকায় রক্তিম চোখে এদিক ওদিক
জলহীনতায়,
মানুষের বুক জুড়ে ধূ ধূ হাহাকার,
অথচ কাছেই রয় স্নিগ্ধ জলধারা অবিরাম,
তালাশের পরেও পায় না খোঁজ পশু-পাখি এবং মানুষ।
শহরে শহরে বোমা ফাটে, অস্ত্র নাচে, রক্ত ছোটে
শহরে শহরে আততায়ীর মোচ্ছব, মানবতা
খুন হয় প্রহরে প্রহরে
ধর্মান্ধ খাঁড়ার কোপে। মৌলানা রুমির
কবিতার চোখ
জলে ভাসে যূথচারী বক ধার্মিকের আস্ফালনে।
রক্ত ঝরে, রক্ত ঝরে, উত্তর দক্ষিণে
পূর্ব ও পশ্চিমে,
ঘর পোড়ে হিংসার আগুনে
শান্তির পাড়ায়, নারী আর শিশু কাঁদছে নিয়ত।
বর্বরের অট্রহাসি ম্লান করে দেয় প্রতিদিন
জ্ঞানীদের মুখ।
বহু চেষ্টা, বহু অনুসন্ধানের পরেও মানুষ
পায় না সে বাগানের খোঁজ,
যেখানে গোলাপ
চকিতে প্রেমের পদাবলী হ’য়ে যায়,
ঝাঁক ঝাঁক প্রজাপতি ওড়ে,
শিশুরা কোমল হাত ধরাধরি ক’রে নাচে, প্রেমিক প্রেমিকা
জ্যোৎস্নারাতে অলৌকিক, কথোপকথনে মেতে ওঠে,
আহত কবির বুকে প্রলেপ বুলায় পুষ্পঘ্রাণ।
৭/৫/৯৫
সৃজনে উন্মুখর
এই তো বিষাদ ভোরবেলা হেঁটে গেল একাকিনী
সুষময়; রাখাল আসেনি আজ এই খোলা পথে
ভুল ক’রে ফেলে রেখে বটমূলে বাঁশি তার। নেই
অন্য কেউ এ মুহূর্তে উদাস গলিতে। দোতলার
ছোট ঘর থেকে একজন অসুস্থ মানুষ দ্যাখে
আকাশ, গোলাপ, কাক, শালিকের নাচ, ভেজা গাছ।
লোকটা নিভৃতে ব’সে ছবি দ্যাখে, ছবি আঁকে আর
মাঝে-মাঝে আঁক কষে হিজিবিজি কী জানি কিসের
ঘোরে, ফের মুছে ফ্যালে। নীরবে তাকায় ছবিটির
নৈর্ব্যক্তিক ভগ্নাংশের দিকে। ভাবে, সে, শৈশব তার
কেটেছে পাখির ডিম সংগ্রহের বাসনায় আর হারিকেন
জ্বেলে নামতার নূপুরের তালে দিব্যি দুলে দুলে।
কৈশোরে লোকটা জেনেছিল ক্রমে পাটীগণিতের
উজ্জ্বল যাদব চক্রবর্তী নন তত ভীতিপ্রদ,
যত তাঁর হাত ধ’রে ঘুর সিঁড়ি ভাঙার সময়
মনে হয়। শুধু অভিনিবেশের কেন্দ্রে ঈগলের
চোখ রাখলেই বেশ দীক্ষা মিলে যায়। লোকটার
হিশেবের খাতা তবু প্রমাদের কাঁটার মাদুর।
লোকটা অসুস্থ বড়, বিশেষ চেয়ারে একজন
বিজ্ঞানের প্রভু লগ্ন সারাক্ষণ ঘাতক পীড়ায়,
যিনি শুদ্ধ গণিতের দেয়ালি জ্বালিয়ে সময়ের
ইতিহাসে জাগান নতুন শিহরণ। গণিতের
কিরণে নির্মম ব্যাধি স্বৈরাচার ভুলে থাকে;
আজো তিনি ক্রীড়াশীল মোহনীয় সংখ্যার খেলায়।
বিশ্বময় সংখ্যাগুলো হীরের কুচির মতো নাচে
প্রতীকের রূপ ধ’রে। এ গ্রহ ক্রমশ পাল্টে যাচ্ছে
সাইবারনোটিকস্ তত্ত্বের স্ফুরণে; সে লোকটা
কেমন বিস্ময়ে দ্যাখে বিবাগী কবির মানসীও
তীক্ষ্ম নাক, আয়ত চোখের নম্র বিভাবরী নিয়ে
পরিস্ফুট গণিতের ঔরসের মোহন আভায়।
লোকটা নিমগ্ন সুন্দরের ধ্যানে, ভেসে ওঠে তার
দু’চোখে, সুদূর নীলিমার বীথিকায় পরস্পর
হাত ধ’রে নাচে অবিরত সঙ্গীত, কবিতা আর
বিশুদ্ধ গণিত, শোনে গোলাপ বলছে মৃদু স্বরে
‘আমিই গণিত আর গণিতই গোলাপ গূঢ় এক
ঝলসিত তরঙ্গের ভেতরে সৃজনে উন্মুখর!
২৮/৬/৯৫
সে এক কিশোরী
একজন কিশোরীকে চিনি যার চুল খাটো,
ঠোঁটে খেলা করে মধুর হাসি; মুখে সৌন্দর্যের আভা।
প্রজাপতির মতো সে ঘুরে বেড়ায়
এ-ঘর থেকে ও-ঘর। ওকে দেখলেই
মমতার ঢেউ জাগে মনে, ইচ্ছে হয়, ওর
মাথায় হাত রেখে কোনো কল্যাণময় বাণী উচ্চারণ করি।
বৃদ্ধি তার তীক্ষ্ম; পড়ার পাট চুকলেই
সেই কিশোরী প্রায় সেঁটে থাকে টিভি সেটে। আচার
খেতে খেতে দ্যাখে নানা অনুষ্ঠান। কবিতার প্রতি
তার কোনো টান নেই, অথচ তার ঘরে
চটকিলা গানের টেপ বাজে প্রত্যহ। কিশোরীর
অজান্তেই তার সত্তা ক্রমে ক্রমে
হাত বাড়াচ্ছে
যৌবনের বসন্ত বাহারের দিকে।
কয়েক মাস আগে কিশোরী মেতে উঠেছিল
ত্র্যাকুরিয়ামের মাছ নিয়ে। বালিকা বয়সে তার
শখ ছিল সারা দিনমান
খরগোশের সঙ্গে খেলা করবার এখন সে
খাঁচায় পোষে রঙ বেরঙের পাখি। পাখির খাঁচার পাশে
শুয়ে ব’সে সে চুপ ক’রে মুগ্ধাবেশে দ্যাখে
পাখিগুলোর রূপ, শোনে
ওদের ঐকতান। জানি না সে তার মায়ের মতো
ঘন ঘন আকাশ, বৃষ্টি জ্যোৎস্না দ্যাখে কিনা অথবা
নক্ষত্র চেনার উৎসাহ ওর কতটুকু।
এখন সে পাখিদের যত্নে বিভোর,
নিয়মিত খাবার দেয় ওদের। পাখিদের
ওড়া উড়ির সাধ মেটাবার জন্যে নীলাকাশকে
পুরে দিতে চায় খাঁচায়। যখন তখন সে
সস্নেহেহ তদারক করে পাখিদের, কথা বলে
ওদের সঙ্গে। কী কথা সেসব, কে জানে। কিশোরী কি ভাবে
কোনো নিষাদ আড়ালে লুকিয়ে আছে
পাখিদের বধ করার মতলবে? না কোনো শিকারী
খাঁচাবন্দী পাখি শিকার করে না। পাখি মারার লালসা ওরা
চরিতার্থ করে খালে বিলে, নদীতে, ঝিলে জঙ্গলে। তবে
অদৃশ্য অশুভ জীব তো থাকতে পারে ওঁৎ পেতে। কোনো
ভর সন্ধেবেলা কিশোরী যদি দ্যাখে খাঁচাময় পাখিদের
সব পালক ছেঁড়া, তছনছ, তাহলে তার সন্ত্রস্ত
বুকের ভেতরে বইবে কোন্ ঝড়?
১০/৭/৯৫
সে-রাতে তোমার চোখ
সে-রাতে তোমার চোখ আমাকে ভর্ৎসনা করেছিল
নীরবে, হয়নি কষ্ট বুঝে নিতে সে চোখের ভাষা।
কখনো কখনো খুব ভুল করে ফেলি। তিন দিন
তিন রাত্রি পরে তুমি এসেছিলে আমার নিবাসে।
তিনটি শতাব্দী বয়ে গেছে আমার উপর আর
আমি উপদ্রুত কয়েদির মতো মুক্তি-প্রত্যাশায়
পেয়েছি তোমার দেখা সে-রাতে হঠাৎ। প্রাণে ছিল
রঙিন ফোয়ারা, তুমি নিশ্চিত করেছ অনুভব।
সে-রাতে আমার করোটিতে ঘোড়ার পা ঠোকা ছিল
অবিরত, বুঝি তাই আমি অহেতুক সতর্কতা
মেনে নিয়ে করিনি তোমার মুখ চুম্বন, ধরিনি
ব্যাকুল বাড়ানো হাত। ফলত তোমার দু’টি চোখ
আমার ভীরুতা আবিষ্কার ক’রে ভর্ৎসনা-মুখর
হয়েছিল আআর আমি বিষাদে ছিলাম সারা রাত।
১২/৪/৯৫