মঞ্চের মাঝখানে
ভয়ানক ভয় পেয়ে গেছি। এরকম পরিস্থিতি
হবে, যাকে বলে
স্বপ্নেও ভাবিনি কোনো দিন। আমাকে সবাই মিলে
করিয়ে দিয়েছে দাঁড়। এ ব্যাপারে সত্যি বলতে কী,
প্রস্তুতি ছিল না এতটুকু।
এই চোখ ধাঁধানো আলোয়
মনে হলো আমি যেন সুদূর নূহের আমলের জালার ভেতর থেকে বেরিয়ে
এসেছি
অকস্মাৎ,
যেমন ডিমের
সাদাটে খোলস ভেঙে বড় কোন পাখির শাবক
এসে যায় রোদে। চুলে
চিরুনির আঁচড় পড়েনি কতকাল, নখগুলো
দীর্ঘ আর নোংরা, শার্ট বোতামবিহীন। সেই কবে।
স্বপ্নের ভেতর এক জোড়া মোকাসিন
হারিয়ে ফেলেছিলাম, তখন থেকেই নাঙা পায়ে
কেবলি ঘুরছি দিগ্ধিদিক। ট্রাউজার
ঊর্ণনাভ জাল দিয়ে তৈরি, দোমড়ানো-মোচড়ানো।
আমাকে বলতে হবে কিছু কথা শ্রোতার উদ্দেশে,
যারা বসে আছেন সমুখে,
বাগানের কেয়ারির ফুলের মতন সারি সারি। কী বলব
এমন যা শুনে তাঁরা মুগ্ধতার ঘোরে
বাহবা দেবেন ঘন ঘন? হলঘর
করতালিময় হয়ে উঠবে নিমেষে? অতিশয়
নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকি, ঠোঁট
শিলীভূত বহু আগেকার মৃতদের কণ্ঠস্বর ভেসে আসে কানে,
সেসব প্রাচীন কণ্ঠস্বর আজ ঠাঁই পেতে চায়
আমার গলায়। আমি কান
বন্ধ করে বোধহীনতায় ডুবে থাকি। কিছুক্ষণ।
এবং উইংস-এর অন্তরালে প্রম্পটার সাজবার ভীষণ হিড়িক
পড়ে যায়। কে কার ওপরে
টেক্কা দিয়ে জোগাবে আমার মুখে নিজেদের কথা,
এ নিয়ে বিস্তর
কিচিরমিচির শোনা গেল। কিন্তু আমি
যদি বলি কোনো কথা তাহলে করব উচ্চারণ
আমার আপন কথা, যতটুকু পারি
নিজেরই ধরনে।
আমি মুখ খুলতেই দেখি হলঘরে কোনো সিটে কেউ নেই, কবরখানার
নিস্তব্ধতা ভর করে আছে চতুর্দিকে। নিরর্থক
ভয়ে আমি কাঠ হয়ে ছিলাম এ মঞ্চে সারাক্ষণ।
যার যার কাজ
তোমরা যে কাজ করো দশজনে মিলে তাতে জিত
হলে ভালো, হার
হলেও কারোর লাজ নেই, এ কথাটা সুনিশ্চিত
জানি, তাই তোমাদের সব চমৎকার ধুন্ধুমার
বাজে নাক গলাতে আসি না। পথেঘাটে
যাত্রীভরা বাসের ভেতর
যদি বোমা ফাটে
হঠাৎ, বলি না ঘরে বসে এ এ খবর
মনঃপূত নয় মোটে। প্রতিদিন শহরে মিছিল
বের হলে, যানজট যেখানে সেখানে
বাধলে হামেশা চিড়বিড়ে বিরক্তির রাগী চিল
প্রশান্তির গাঢ় নীলিমাকে, মন জ্ঞানে,
আঁচড়িয়ে চঞ্চু দিয়ে ছিঁড়েখুঁড়ে এক সা করে না
কস্মিনকালেও; যদি জ্বালাও-পোড়াও
দাবি আদায়ের জন্যে, করো ঘেরাও কর্তাকে কোনো, বলবে না
এ বান্দা কাজটা মন্দ হলো,
সে-পথে চলেছ ঠিক সেই পথে চলো।
তোমাদের কোনো কাজে বাগড়া দেবার অভিলাষে
যদি কেউ দলে
আমাকে ভেড়াতে চায়, চোখ মেলে দূরের আকাশে
উদাসীন তাকে কথা দেবার বদলে
স্রেফ সাত হাত দূরে সরে
যাব আমি কিছুই না বলে। বলে রাখি,
তোমাদের সঙ্গে আছি, যতই দোরে
খিল ত্রঁটে বসে থাকি গহন একাকী।
কারো সাতে পাঁচে নেই আমার নিজের কাজ যাতে
করে যেতে পারি নিজ মনে চিরদিন
বাধাবন্ধহীন,
সেদিকে নজর রেখো, তাহলেই আনন্দের ভেলা।
আমাকে ভাসিয়ে নেবে দ্বীপ-দ্বীপান্তরে।
সারাবেলা
কী কাজ আমার, যদি চাও জেনে নিতে, তবে ঘরে
এসে দেখে যাও-
পায়রা উড়িয়ে দিই যখন তখন, টবে ফুল
ফোটাই সযত্নে ফ্ল্যাটে নিমেষে ময়ুরপঙ্খী নাও
আর জলকন্যাদের ডেকে আনি, তুলি
বিনা ছবি আঁকি সারাক্ষণ, স্বপ্নের বসতবাটি ফঁড়ে
ধ্বনির ফোয়ারা জেগে ওঠে। সোনালি কপাট খুলি
রহস্যের আর ঘুরে ঘুরে
কেবলি পাল্টাতে থাকি সবকিছু। বিরহিণী রাধা
বসে থাকে আমার চেয়ারে ফরহাদ
নহর বানায় ঘরে, তানসেন চকিতে আনেন পূর্ণ চাঁদ,
মেঘমালা। দোহাই, আমার এই কাজে কখনো দিও না বাধা।
শুচি হয়
কখনো দূর থেকে কখনো খুব কাছে থেকে
আমাকে আমার কবিতা সঙ্গ দ্যায়। অপরূপ গোসলের
পানি শীতল ধারায় ধুঁইয়ে দ্যায়
দেহমনের ক্লেদ নীল পদ্ম হয়ে ফুটি। আমার এই
জন্মান্তরকে কেমন করে নিরাপদে
রোদ বৃষ্টি অথবা আগুনের ভেতর দিয়ে নিয়ে যাব?
আজ মধ্যরাতে, চাঁদ যখন নির্বাসনে
তারামণ্ডলী গা ঢাকা দিয়েছে বামপন্থী রাজনৈতিক
কর্মীদের মতো, যখন স্বৈরাচারীরা
ষড়যন্ত্রের নীলনকশা তৈরি করে কিংবা নাক ডেকে ঘুমায়,
তখন আমি মনস্থির করে ফেলেছি
আমার কবিতা বিষয়ে। এতকাল
যে ধারণার সঙ্গে লদকা লদকি করেছি অষ্টপ্রহর,
তাকে অন্ধকার স্রোতে বন্যা উপদ্রুত এলাকার,
লাশের মতো ভাসিয়ে দিতে
এতটুকু দ্বিধা করিনি।
আমার কবিতায় থাকবে না সেই ভঙ্গি, যা
ভড়কে দেখে পাঠককে, যার ধাক্কায় পা হড়কে পড়বে
কবিযশঃ প্রার্থীরা কিংবা যার মর্মোদ্ধার
করার প্রাণান্তকর, চেষ্টা হোঁৎকা সমালোচকগণ
শেষটায় মাথা চুলকোতে চুলকোতে
ঘা করে ফেলবেন এবং এমন এক জগাখিচুড়ি, ফিসফিসে
থিসিস দাঁড় করাবেন,
যারা মাথামুণ্ড তারা নিজেরাও বুঝতে পারবেন না।
আমার কবিতার ভাষা কস্মিনকালেও
বিজ্ঞাপনের ন্যাকা বুলির মতো হবে না, এমন শব্দাবলী
তাতে থাকবে না যাতে বারবার তাক থেকে
নামাতে হয় স্ফীতোদর অভিধান। আমার কবিতার ভাষায়
বেজে উঠবে দিনানুদৈনিক
জীবনযাপনের ছন্দ। আমার কবিতা অশালীন।
চলচ্চিত্রের নায়িকার কোমর আর নিতম্বের দুলুনি
অথবা লম্বা ঘোমটার নিচে খ্যামটা নাচ
কিংবা কালো বোরখা ঢাকা জবুথবু ঢঙের বিরোধী,
আমার কবিতা সবে কামরুল হাসানের সেই
তন্বীর মতো যে ঢেঁকিতে ধান কোটে,
গভীর ইঁদারা থেকে শক্ত হাতে রশি টেনে
বালতি ভরা পানি তোলে গ্রীষ্মের দুপুরে
হাড়-কাঁপানো শীতের সকালে।
আমার কবিতা, আমি ঘোষণা করছি,
কখনো স্বৈরাচারী শাসক, নষ্ট মন্ত্রী, ভ্রষ্ট রাজনীতিবিদ,
কালোবাজারি আর চোরাচালানিদের
সঙ্গে ফুলের তোড়া সাজানো এক টেবিলে ডিনার খেতে
প্রবল অনাগ্রহী, বরং গরিব গেরস্তের ঘরে
ভাগ করে খাবে চিড়ে গুড়। জেনে রাখুন
আমার কবিতা পুলিশের লাঠি আর
বন্দুকের উদ্যত নল দেখে দেবে না চম্পট।
আমার কবিতা নয় গালে ঘাড়ে পাউডার-বুলানো
বিদূষক কিংবা বিশুদ্ধ গোলাপি আমেজে মশগুল
বুলবুলের সুরমুগ্ধ ফুলবাবু,
আমার কবিতা জয়নুল আবেদিনের গুণ টানা মাঝি।
যার বেঁকে যাওয়া পিঠে ছড়িয়ে পড়ে
ঘামমুক্তো আর সূর্যাস্তের রঙ।
আমার কবিতা গণঅভ্যুত্থানের চূড়ায় নূহের
দীপ্তিমান জলযান, আমার কবিতা বলিভিয়ার জঙ্গলে
চেগুয়েভেরার বয়ে যাওয়া
রক্তের চিহ্ন গায়ে নিয়ে হেঁটে যায় মাথা উঁচিয়ে
যারা ডুগডুগি বাজিয়ে
যখন ইচ্ছে গণতন্ত্রকে বাঁদর-নাচ নাচায়
তাদের পাকা ধানে মই দ্যায় আবার কবিতা ফুঃ বলে
উড়িয়ে দ্যায় দুর্দশার মুষলপর্ব।
আমার কবিতা নাজিম হিকমতের মতো জেলের নীরন্ধ্র
কুঠরীতে বসে মুক্তির অক্ষরে লেখে আত্মজীবনী।
আমার কবিতা বেঈমান অন্ধকারের বুকে ঈগলের মতো
নখর আর চঞ্চু বসিয়ে ঠুকরে ঠুকরে
বের করে আনে ফিনকি-দেয়া আলো এবং
সেই আলোর ঝরনাধারায় শুচি, হয় শুচি হয়, শুচি হয়।