পথে যেতে যেতে
আজ ভোরবেলা থেকে মন ভালো নেই। কিছুতেই
পড়াশুনা লাগছে না ভাল, এমনকি পদ্য লিখে
মন খারাপের ঘন মেঘ পারি না উড়িয়ে দিতে।
রিকশায় চলেছি লেক সার্কাসের মোড়ে; অভ্র-গুঁড়ো
ঝরায় আকাশ, সন্ধ্যা হয় হয়, বেপরোয়া ঢঙে
ক’জন যুবক হাঁটে ফুটপাতে, বেজে ওঠে শিস
মাঝে মাঝে। মনে পড়ে হৃদয়ের উঠোনে আমার
এখনো পূর্ণিমা জ্বলে, জ্বলবে কি আরও কিছুকাল?
সে কেমন আছে? কি করছে ভেজা ধোঁয়াটে সন্ধ্যায়?
আমাকে কি মনে পড়ে তার, যখন সে বসে থাকে
বারান্দায় খুব একাকিনী, হাতে আধপড়া বই,
কিংবা কাঠবিড়ালির খেলা দেখে কাটায় সময়,
দাঁতে চেপে আঙুল অতীত নিয়ে বোনে তন্তুজাল?
যেন আমি হাড়কাঠে গলা দিয়ে বসে আছি, কাকে
জানাব আমার কথা? কে বুঝবে ভাষাহীন ভাষা?
রাস্তায় ঝিমোচ্ছে বসে লোলচর্ম অসুস্থ মহিষ।
বন্ধু তুমি অকম্পিত হাতে
ডাকতে হয় না, নিজেই সে আসে, টোকা দেয়
মনে, স্মৃতি যার নাম। কখনো কখনো
মুখোমুখি বসে,
পা দোলায় শিস দেয় দোয়েলের মতো কখনোবা
চোখের পানির মতো কী অপ্রতিরোধ্য এসে পড়ে
সবকিছু এলোমেলো করে, এমনকি
পীড়নের ভয়কে তফাৎ যাও বলে। মনে পড়ে,
সেলিম তোমার কথা মাঝে মাঝে খুব
মনে পড়ে। সে কবে প্রথম দেখা হয়েছিল আমাদের?
সেই উনিশশো আটান্নোয়
পুরানো ঢাকায়, অতি পুরাতন বেতার ভবনে।
মনে পড়ে বহুদিন গল্পচ্ছলে সিগারেট পুড়ে ছাই হ’তে
দেখেছি আঙুলে
তোমার এবং কত কিছুই তো ছাইয়ের গাদায় ঠাঁই নেয়
ক্রমান্বয়ে, এমনকি অমৃতের সন্তানও সহজে।
যে হাসি তোমার ঠোঁটে প্রায়শই বেলা-অবেলায়
দেখেছি ঝিকিয়ে উঠতে, তাতে
বিষাদে করেছি লক্ষ্য দ্রুত পুড়ে-যাওয়া
মানুষের কাহিনীর ঈষৎ ঝলক। অনেকেই, বিশেষত
শিল্পীরা পোড়ায় নিজেদের;
কিন্তু এরকম সাততাড়াতাড়ি কেউ আমার ধরনে
করে না আগুনে সমর্পণ। বন্ধু, তুমি
অকম্পিত হাতে
মোমবাতিটার দু’দিকেই খেলাচ্ছলে
তৈরি করেছিলে শিখা।
বাড়িটা
বাড়িটা গভীর রাতে দেখেছিল বৃষ্টিপাত।
ওর সারা গায়ে বর্ষার তুমুল ছাঁট, খুব
হিসহিসে হাওয়া ক্রমাগত
ক্ষ্যাপাটে ছোবল মারে। মাঠের ভেতরে
অন্ধকারে একলা বাড়িটা আরও বেশি
বাড়ি হয়ে ওঠে,
যেন পৃথিবীর আদি বাড়ি
কংক্রিটের অরণ্যের সংসর্গ ছাড়িয়ে
এই মাঠে থিতু।
এ-বাড়ি ছোঁবে না কাউকেই;
কোনো গূঢ় কথা, কারো ছায়া
ধরে রাখবে না কোনো দিন।
কতকাল থেকে বৃষ্টি, রৌদ্র আর বাতাসে বাড়িটা
পারিপার্শ্বিকের প্রতি উদাসীন আর
সন্ন্যাসীর মতো ধ্যানী।
কখনো সে কারো কারো শৈশব অথবা যৌবনের নিমগাছ
এ বাড়িটা কার? জানা নেই। ডুমুরের
গাছটা এখনও
আছে কি দাঁড়ানো এক কোণে? বাসিন্দারা
লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে,
কেউ কেউ হয়তো খাচ্ছে কফি, কেউবা পুরানো কথা
টেনে আনে,
অন্যজন দেয়ালের দিকে চোখ রেখে
চেয়ারে ভাস্কর্য এক চুপচাপ, পায়ে রাগ টানা,
কান পেতে বৃষ্টি শোনে একা,
বলার কিছুই নেই তার।
বুকের অসুখ
তিন-চার মাস ধরে সমগ্র সত্তায় জ্বরোভাব। মুখ তেতো
সারাক্ষণ, খুক খুক কাশি।
ফুসফুস থেকে অবিরাম মিলকভিটা
মাখনের মতো কফ পড়ে,
যদিও খাই না টোস্ট মাখন লাগিয়ে কতকাল,
সে কবে পঞ্চাশ পেরিয়েছি বলে। বন্ধুদের কেউ
কেউ বলেছেন
অনেক আগেই,
‘তোমার কাশিটা ভাই সুবিধের নয়, ভয় হয়,
ভালো করে চিকিৎসা করাও।
অন্তর্গত তেজে কারো পরামর্শে এতদিন তেমন করিনি কর্ণপাত।
এমনই ছিলাম, আছি; থাকব কি বহুদিন?
এখন শরীরটাকে নিয়ে পারছি না
আর, ডাক্তারের
পরামর্শ নিয়ে
যাই গ্রিন সুপার মার্কেটে এক্স-রে করাতে বুকের,
রক্ত পরীক্ষাও হলো; সব
খুঁটিয়ে অভিজ্ঞ চোখে দেখেশুনে ডাক্তার বললেন,
‘আপনাকে, শুনুন, করেছে
দখল ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিস, তারপর
কাগজে দিলেন লিখে প্রেসক্রিপশান। অকস্মাৎ
মনে পড়ে গ্রিন
সুপার মার্কেটে দোতলায় সন্ধ্যেবেলা
এক্স-রে ঘরে একজন তরুণীকে দেখে
চম্কে উঠেছিলাম। সে কেন এখানে এল? তার পূর্ণিমায়
কোন অমাবস্যা বাসা বেঁধেছে হঠাৎ?
অচেনা সে যুবতীকে দেখে কেবলি তোমার কথা
মনে পড়ছিল বারবার,
আর দ্রুত বেড়ে গেল আমার এ বুকের অসুখ।
তোমার স্পর্শের জন্যে বুক
কাঙালের মতো
অত্যন্ত করুণ চোখ মেলে চেয়ে থাকে অন্তহীন প্রতীক্ষায়।
বেশি বাকি নেই
দেখতে দেখতে ফ্ল্যাটে, গাছগাছালিতে খোলা মনের ভেতরে
হেমন্ত দিনের ছায়া, যাবার সময় হয়ে এল।
সে কখন থেকে তাড়া দিচ্ছে, অথচ এখনো
সুটকেস গোছানো হয়নি।
হ্যান্ডব্যাগ খালি পড়ে আছে। তাড়াহুড়ো
ক’রে খুঁটিনাটি সব জিনিসপত্তর
হ্যান্ডব্যাগে পুরে দিতে গিয়ে
রাজ্যের ঝামেলা।
বাদামি ফ্লাস্কটা কই? পুতুলেরা মেঝেতে গড়ায়।
বড় ঘরে একা, বৃষ্টি ভেজা গন্ধ, কার দীর্ঘশ্বাস
ঘাড় ছুঁয়ে যায়?
তড়িঘড়ি সুটকেসে শার্ট, ট্রাউজার, পাণ্ডুলিপি
ইত্যাদি ভরার পরে সুটকেস কিছুতেই বন্ধ
করতে পারি না আর সবচেয়ে মুশ্কিলে
পড়েছি পুতুল নিয়ে। কাকে ছেড়ে কাকে নেব? তাছাড়া হঠাৎ
জুতো জোড়া কী করে যে এরকম ছোট হয়ে গেল,
অত্যন্ত কুণ্ঠিত হয়ে আছি
সমাপ্তি ঈষৎ উঁকি দিয়ে যায় কৌতূহলে ধুলো ওড়ে।
‘তোমাকে যেতেই হবে? কণ্ঠস্বর শুনে
পেছনে তাকিয়ে দেখি, একটি তরুণী
বড় বড় চোখ মেলে দেখছে আমাকে।
মনে পড়ে, কতকাল দেখিনি তন্বীকে, লাল টিপ
স্মৃতির মতোই জ্বলে, সমগ্র সত্তায় তার মেঘমেদুরতা।
বাঁধা-ছাঁদা কী নিপুণ সেরে
ময়ূরপঙ্খীর মতো সে এগিয়ে এসে বলে-‘কত তুচ্ছ কাজে
বেলা গেল, অথচ কিছুই বলা হলো না আমার।
আমারও কি বলবার মতো ছিল কোনো কথা? চুলে
চিরুনি চালিয়ে ছুটি, সময় তো বেশি বাকি নেই।