- বইয়ের নামঃ মঞ্চের মাঝখানে
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- প্রকাশনাঃ জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশন
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অথচ নিজেই আমি
একদিন সন্ধ্যেবেলা ফ্ল্যাটে ফিরে দেখি
থমকে-দাঁড়ানো অন্ধকার বারান্দায়
দাঁড়ের সবুজ টিয়ে পাখিটার ঘাড় কী নিখুঁত
মটকে পালিয়ে যাচ্ছে একজন লোক, তাকে খুব চেনা চেনা
লাগল আমার। কিছুদিন
শুধু সবুজাভ ছোপ চারপাশে বারংবার ভেসে
বেড়াল আমাকে ঘিরে। খুন হয়ে যাওয়া টিয়েটার
কথা ভেবে মন ভারি খারাপ থাকল কিছুকাল।
এই তো সেদিন
মাঝ রাত্তিরের বুক শিল্পিত আঁচড়ে চিরে চিরে
বিলায়েত খান
ক্যাসেটে নিশুত দরবারি কানাড়া হচ্ছেন ক্রমে,
হঠাৎ আমার পোষা বেড়ালের, যে আমার
চেয়ারে শয্যায় আর কখনো সখনো
লেখার টেবিলে ঘুমে থাকে, কান্না শুনে
ছুটে গিয়ে দেখি গলা টিপে আক্রোশে মারছে একজন
লোক, হাতে নাতে তাকে ধরে ফেলতেই
সে তাকাল আমার চোখের দিকে, ওর চোখ দুটো
দেখে ভয়ে পেছিয়ে গেলাম
তিন হাত। লোকটা নিহত বেড়ালের
শব ঝুল বারান্দায় ফেলে
চলে গেল অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে। বাষ্পাকুল চোখে
সে রাতে অনেকক্ষণ জেগে থাকলাম
উঠোনে মাটির নিচে নিষ্প্রাণ বেড়ালটিকে
গুপ্তধনের মতন চুপিসারে
গচ্ছিত রাখার পর।
অন্যদিন আমার সবচেয়ে প্রিয় দেশ-বিদেশের
কবিতার বইগুলো দিয়ে
সাজালো জ্বলন্ত চিতা সেই একই লোক। অসহায় চক্ষুদ্বয়
অসহ্য আটকে থাকে ভস্মীভূত অক্ষরমালার দিকে, যেন
অপরূপ একটি সভ্যতা লুপ্ত হলো
আমার চোখের নিচে ঘটা করে। কেমন নিশ্চুপ বসে থাকি
পোড়া গন্ধময়
একলা ঘরের মধ্যে অতিশয় বিস্ফোরিত চোখে।
আকাশ যাচ্ছিল ভেসে চাঁদের যৌবনে আর আমি
ছিলাম নিবিষ্ট ঝুঁকে লেখার টেবিলে।
অকস্মাৎ অমাবস্যা গ্রাস
করে আকাশকে, সে লোকটা
বলা কওয়া নেই
ঘরে ঢুকে আমার নিজস্ব কবিতার খাতা কেড়ে
নিয়ে কুটি কুটি ছিঁড়ে ফেলে
সবগুলো পাতা, তার ক্রূর ক্রিয়াপরায়ণ হাত
থেকে খাতা ছিনিয়ে নেয়ার
সাহস হলো না, আমি শুধু নির্বাসিত
কবির মতন
অশ্রুপাত করি ধু-ধু বিদেশ বিভুঁইয়ে।
পড়েছি ভীষণ ধন্দে লোকটাকে নিয়ে; একে একে
আমার সকল প্রিয় বস্তু নষ্ট করে
সে এখন ভয়ানক উল্লাসে প্রমত্ত আর আমি নামহীন
আতঙ্কে সেঁধিয়ে যাচ্ছি নিজের ভেতর ক্রমাগত। মনে হয়,
যে কোনো মুহূর্তে এসে লোকটা আমার
মুখের ভেতর ঠেসে দেবে অসংখ্য ঘুমের বড়ি। বড় ভয়ে
ভয়ে থাকি, হে দীপিতা, যদি
আমাদের আর দেখা না হয় কখনো কোনো দিন।
পদধ্বনি শুনি, কার? লোকটা কি আসছে আবার? রোমকূপ
কাঁটা হয়; অথচ নিজেই আমি বানিয়েছি তাকে।
একটি কাব্যগ্রন্থের প্রকাশনা উৎসব
আজ ফুরফুরে হাওয়ার বিকেলে সদ্য প্রেস থেকে
বেরিয়ে-আসা আমার একটি কাব্যগ্রন্থের
প্রকাশনা উৎসব। কোথায়?
জায়গাটার নাম অকথিত থাক, যদিও
ভূতলবাসী নয় আমার কবিতার বই। গ্রন্থে
ঠাই-পেয়ে-যাওয়া
রচনাগুলি কবিতা না পদ্য, এ নিয়ে বাছা-বাছা
গুণীজনের মধ্যে
বিস্তর মতভেদ লক্ষ্য করা গেছে, যখন এগুলি
প্রকাশিত হচ্ছিল কোনো কোনো লিটল ম্যাগাজিনে কিংবা
প্রতিষ্ঠিত পত্রিকায়।
একে একে অতিথিরা এলেন ধরাচূড়া নিয়ে,
যাবে বলে আসন গ্রহণ করলেন। দু’চারজন জবরদস্ত
সমালোচক, যাঁরা মনে মনে
শানিয়ে নিচ্ছিলেন তাঁদের প্রিয় বাক্যগুলি,
পরখ করছিলেন সেই ঝকঝকে
তূণ, যেখান থেকে ছুড়বেন কবির হৃদয় লক্ষ্য করে
বিষমাখানো তীর আর
নিজেদের অর্জুন ভেবে পার্শ্ববতী বনোয়ারির
দিকে তাকাবেন প্রশংসাকাতর
দৃষ্টিতে, তাঁরাও বসলেন আয়েশী আঙ্গিকে
যে যার আসনে।
কারো ঠোঁটে স্মিত হাসি, কেউবা
ঈষৎ গম্ভীর, যেন খালে গলা-ডোবানো
মোষ; একটা চাপা গুঞ্জন ঘরময়। কতিপয়
রাগী ছোকরা খিস্তি ছুড়ে দিচ্ছিল
টেবিলে সাজিয়ে-রাখা আমার অতিশয় লাজুক
কাব্যগ্রন্থটির উদ্দেশে। সভাপতি
তাঁর নির্ধারিত আসনটি অলংকৃত করলেন
ঘোষকের আমন্ত্রণে। প্রধান অতিথি
আর বক্তা মহোদয়গণ অনুসরণ
করলেন তাঁকে।
ঘোষক কী যেন বলতে চাইলেন তার মখমল-কোমল
কণ্ঠস্বরে মাইক্রোফোনের
খুব কাছে মুখ নিয়ে। আর সে মুহূর্তেরই
আমার কাব্যগ্রন্থের অন্তঃপুর থেকে
কবিতার অক্ষরগুলো বেরিয়ে এসে সারা ঘরে
উড়তে শুরু করল এক ঝাঁক প্রজাপতির মতো।
কেউ এসে বসে পড়ল সভাপতির মোগল সম্রাটের
দাড়ির মতো দবিজ দাড়ির ডগায়, কেউ
কোনো সুন্দরীর রঙিন ঠোঁটে চুমু খেল
অনেকক্ষণ ধরে। কেউ কেউ
সুড়সুড়ি দিল প্রধান অতিথির কানের ভেতর,
কেউবা হঠাৎ প্রজাপতি থেকে দূরন্ত বোলতায়
রূপান্তরিত হয়ে হুল ফোটাতে লাগল
সমালোচকদের বাঙির মতো ভুঁড়ি আর ডাগর
পাকাপোক্ত পাছায়। আহারে উহুরে শব্দে
সভাঘর বনে গেল
মেছো বাজার খদ্দের বিহনে।
আমার কাব্যগ্রন্থের প্রকাশনা উৎসবটাই
ভণ্ডুল হয়ে যাচ্ছে ভেবে
দিগ্ধিদিক ছুটতে শুরু করি আর উড়ন্ত অক্ষরগুলোকে
বইয়ের ভেতর ফিরিয়ে আনার জন্যে
কখনো মিনতি জানাই এবং কখনো বজ্রে ধার করে
অনবরত ধমকাতে থাকি জেহোভার মতো।
এখনো নিজেকে
এখন যেখানে আছি, কস্মিনকালেও এখানে
আসতে চাইনি।
একটা ঘোরের মধ্যে এখানে আমার আসা।
ভাবি, কোনো দিন মনের মতো একটা জায়গায়
গিয়ে দাঁড়াব, যেখানে ইঁদুর দৌড় নেই, কলহ,
খিস্তি-খেউড় নেই, দুস্থ ভিড়ের মধ্যে একে অন্যকে
কনুইয়ের গুঁতোয় হটিয়ে পায়ে মাড়িয়ে
যাবার মতো মনোবৃত্তি কারো নেই।
এখানে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে ক্রমাগত,
একটা সাঁড়াশি চেপে ধরেছে কণ্ঠনালি,
কিছুতেই বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারছি না,
কেবল ক্লান্তি আমাকে চাদর দিয়ে মুড়ে রেখেছে,
স্পষ্ট কিছুই দেখতে পাচ্ছি না আশপাশে,
অসুস্থ চোখ জড়িয়ে আসে অবেলায় ঘুমে।
আমি কি স্বস্তি পাব কেতাদুরস্ত কপট মিত্রের
সঙ্গে একটানা আড্ডা নিয়ে?
শান্তি খুঁজব পচা টোমাটোর মতো গণিকার
ক্ষীণায়ু আশনাইয়ে? দু’নৌকায়
পা রেখে আর কতকাল
ঝোড়ো হাওয়ায় চাল সামলে চলব?
এবার একটা হেস্তনেস্ত হওয়া দরকার,
এ-কথা কতবার
মনে মনে আউড়ে নিজেকে প্রবোধ দেয়ার
চেষ্টা করেছি, অথচ
পুরোনো বৃত্তের বাইরে পা রাখা হ’য়ে ওঠেনি কখনো।
যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধে হয়,-
এই প্রবাদ বারবার আমার জীবনে,
সত্যতা যাচাই করে নিয়েছে। পাঁকে থেকে থেকে
পঞ্জক হবার স্বপ্ন দেখেছি, কিন্তু শেষ অব্দি।
ক্লেদমুক্ত হ’তে পারিনি। আমার অনুভূতিগুলো
গান হ’তে গিয়ে আতর্নাদ হ’য়ে উঠেছে।
আজ এমন একটা জায়গায় পৌঁছুতে চাই,
যেখানে ঘাসে শুয়ে আকাশের তারা দেখে দেখে রাত ভোর
করে দিতে পারব, নির্বিঘ্নে আঁজলায়
ঝর্ণার পানি তুলে নিতে পারব, দেখতে পারব
খরগোশের দৌড়, হরিণের লাফ, যেখানে বকধার্মিকের
বকবকানি নেই, রাজনৈতিক টাউটদের
ধূর্তামি নেই,
নেই নিষ্কর্মা, দাম্ভিক প্রশাসকদের আস্ফালন।
কিন্তু নিজেকে বিশুদ্ধ করার জন্যে এখনো
যথেষ্ট পুড়িনি রৌদ্রে, ভিজিনি বৃষ্টিতে।