নির্জন তরণী
তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে চিরচেনা নদীটির তীরে
এসে দেখি জনহীন ঘাট, হা কপাল,
একটিও নৌকা নেই। বুকের ভেতর হু হু হাওয়া
বয়ে যেতে থাকে, ব্যগ্র দৃষ্টি ঢেউদের ব্যাকুলতা করে পাঠ।
আমি তো ভেবেছিলাম, রঙিলা নায়ের মাঝি হাত
নেড়ে গলা ছেড়ে ডেকে নেবে
আমাকে নৌকায় তার, আমি হাসি মুখে
যাব সেই দিকে আর বসব বাদামি পাঠাতনে।
নদীতীরে নৈঃসঙ্গের হাত ধরে চলে পায়চারি
কিছুক্ষণ, অকস্মাৎ আমার আপনকার মাথার ভেতর
মসৃণ প্রবেশ করি-সে এক বেগানা
আশ্চর্য জগৎ বটে, নানাবিধ পাখি ওড়ে রঙধনুময় ঠিকানায়।
বেলা ক্লান্ত হয়ে এলে পর দিগন্তের আবছায়া ভেদ ক’রে
ভেসে ওঠে এক তরী, কে জানে কীসের
টানে ঠিক নদীতীর অভিমুখে খুব দ্রুত চলে
আসে, মাঝি নেই, কেউ নেই, তবু তরী আমন্ত্রণময়!
কী এক অপূর্ব ঘোরে উঠে পড়ি তাড়াতাড়ি রঙিলা নায়ের
যাত্রী রূপে। অচমকা কারা যেন বেঁধে ফেলে আমার দু’হাতে,
হো-হো হেসে ওঠে অন্তরালে, অসহায় আমি’ মন-মাঝি তোর
বৈঠা নে রে’ ব’লে সাড়া তুলি নায়ে, গতি পায় নির্জন তরণী।
১০-০৫-২০০২
পরস্পর হাতে হাত রেখে
সূর্যোদয় এখনও অনেক দূরে, অন্ধকার বটতলে
বসে থাকি অর্থহীন। বেশ কিছু পথ
চলা বাকি আছে হে আমার ভাই-বোন। চোখ খোলা
রেখে এ মুহূর্তে যাত্রাপথে পা বাড়াও দ্বিধাহীন।
রাহেলা, ফাতেমা, রাধা, অনিমা, নঈম, শাহরুখ,
অনিল গৌতম, শোনো, এখনই গা ঝাড়া দিয়ে পথে
নেমে পড়। মনে দ্বিধা, আতঙ্ক, নিরাশা
কিছুতেই কখনও দিও না ঠাঁই, পা চালাও দ্রুত।
তোমাদের প্রাণ হরণের পালা ওত পেতে আছে
নানা দিকে, পথে কাঁটা বিছানো বিস্তর-
এই তথ্য জানা আছে, তবুও সব অশুভের হিংস্র
থাবা ছিঁড়ে খুঁড়ে যেতে হবে উদ্দিষ্ট চাতালে।
মানবীকে দাসীরূপে দেখলে অপার উল্লাসিত যারা, তারা
যতই প্রবল হোক, হোক অমানুষ,
তোমরা রাশেদা, মরিয়ম, উর্মিলা, অঞ্জনা, বীথি,
বিমল, অতীশ, অবিনাশ, ফরহাদ, হালিম, রিয়াজ দ্রুত
পা চালাও পরস্পর হাতে হাত রেখে,
পৌঁছে যাও কাঙ্ক্ষিত মিলন-ক্ষেত্রে, যেখানে মানবী,
মানব সমান অধিকারে বসবাস করে আর
সাগ্রহে সানন্দে গড়ে নিরুপাম শান্তিনিকেতন।
২৬-০৩-২০০২
পূর্ণিমার জাগরণে
সমাজের বিভিন্ন কন্দরে কিংবা খোলামেলা ঘাটে
কীভাবে সম্পর্ক এই মনুষ্য সমাজে
ভীষণ হোঁচট খেয়ে পঙ্গু হয়ে যায়, অনেকেই
সহজে পায় না টের। কালো মেঘ গ্রাস করে সারা উজ্জ্বলতা।
কিছু কেঠো সামাজিকতার আবরণ
হয়তো-বা রয়ে যায় বাসি, পচা খাদ্যের ধরনে,
যেমন নদীর ঠোঁটে ঢেউগুলো চুমো খাওয়ার পরেও
ভেজা বালি রোদের ধমকে শুক্নো, ধুধু
অবয়বে টিকে থাকে। আন্তরিক পরিচয় পথ
ভুলে অমাবস্যার খপ্পরে পড়ে গেলে ঘটে বটে বিপর্যয়।
এই যে এখনও খুব চড়া রোদ ছায়াময় তিয়াত্তর
বছর বয়সে নিত্য পলায়নপর
কবিতা নামের নিরুপমার পেছনে
পেছনে আপ্রাণ ছুটি, সে কি নির্বুদ্ধিতা
আমার? খেয়াল শুধু? যখন অনেকে দ্বিপ্রহরে
কিংবা সন্ধ্যারাতে গল্প গুজবে বেজায় মেতে রাতে
গৃহিণীর আলিঙ্গনে সুখে ঘুমের চুমোয় মজে থাকে, আমি
তখন চেয়ারে বসে আকাশ পাতাল ভেবে চলি।
সমাজ সংসার সব ভুলে সুফী সাধকের মতো ধ্যানে,
মগ্নতায় সফেদ পাতায় পংক্তিমালা
সৃজনে মাতাল হই-জানি না এসব কিছু উন্মাদের স্বপ্ন
নাকি কিছু বেখাপ্পা প্রলাপ।
জানি, জীবনের নানা বাঁকে প্রচুর ভ্রুকুটি আর
বিষাক্ত সমালোচনা সাপের মতোই
প্রকাশ্যে কি অপ্রকাশ্যে আমাকে ছোবল
মেরেই চলেছে-নিয়তির এই আঁকিবুকি, বলো,
কীভাবে এড়িয়ে যাবো? তবু অমাবস্যার শক্রতা
কুটোর মতোই ভেসে যায় একদিন পূর্ণিমার জাগরণে।
১৯-০৮-২০০২
প্রণয়কৌতুকী তুই
প্রণয়কৌতুকী তুই, ওরে যদি বলি সরাসরি,
ছিনালি স্বভাব তোর, সুনিশ্চিত জানি
হবে না সত্যের অপলাপ। একদা দুপুরে তুই,
সে তো আজ নয়, যৌবনের জ্বলজ্বলে
ফাল্গুনে আমার থরথর
পিপাসার্ত ওষ্ঠে দিয়েছিলি এঁকে প্রগাঢ় চুম্বন।
অপরূপ আলিঙ্গনে সেই যে আমাকে বেঁধেছিলি,
অতীন্দ্রিয় সেই গাঢ় স্পর্শে করেছি ভ্রমণ দূর মেঘলোকে,
স্বর্গীয় হ্রদের তীরে শুয়ে
অচিন পাখির সখ্য, ঝুঁকে-পড়া নিরুপম গাছের পাতার
প্রাণঢালা মৃদু ছোঁয়া, নক্ষত্রের মদির চাউনি
পেয়ে গেছি বারবার, না চাইতে এখনও তো কিছু পেয়ে যাই।
তবে কেন হৈ-হুল্লোড়ে মজে তুই এক ঝটকায়
বেচারা সর্বদা-অনুগত এই ক্ষমা প্রেমিকের
সান্নিধ্যের উষ্ণতা হেলায় ঠেলে দূরে চলে যাস
মাঝে মাঝে? অকুণ্ঠ কবুল করি, জীবিকার চাবুকের ঘায়ে
বিব্রত, রক্তাক্ত হই, তবুও তো ভুলিনি তোমায়, ওরে তোর
সত্তার অনিন্দ্য ঘ্রাণ, আজও চাই, তোকেই তো চাই মায়াবিনী।
তোমার সন্ধ্যানে আজ চা-খানায়, অলিতে-গলিতে, পার্কে, মাঠে,
নদী তীরে হই না হাজির অসুস্থতা হেতু, তবে
গোপন আস্তানা আছে আমার হৃদয়
জুড়ে, যার আওতায় বেহেশ্ত-দোজখ,
দিঘির বুকের চাঁদ, তপ্ত রাজপথময় প্রতিবাদী দীপ্র
মিছিলের কলরব। তবুও কি ছেড়ে যাবে তোমার কবিকে?
২০-০৩-২০০২
প্রত্যাশা জেগে নয়
এখন রোদের যৌবনের তাপ নেই, এটাই তো
অনিবার্য পড়ন্ত বেলায়। প্রত্যুষের আনকোরা ক্ষণে মাথা
ক’রে হেঁটে চলা দীর্ঘকাল
ক্লান্তিকেই করে আলিঙ্গন, জানা আছে
যুগ যুগান্তের পথচারীদের। এই যে পথিক আমি
হেঁটেছি বিস্তর, সে-তো গোধূলি বেলায় পৌঁছে গেছে।
এ চলার পথে কত প্রিয় মুখ থুবড়ে পড়েছে
দিগ্ধিদিক, বেদনার্ত দাঁড়িয়েছি ক্ষণকাল, ফের অন্বিষ্টের
প্রলোভনে দ্রুত
করেছি চলার ভঙ্গি, হোঁচটে হোঁচটে
পায়ে ঢের দগদগে ক্ষত
ত্বরিত হয়েছে সৃষ্টি, তবু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে
অব্যাহত রেখেছি যাত্রার রীতি। হবে কি আখেরে
ক্লান্ত মাথা মুকুটে শোভিত?
বস্তুত চলার পথে ধূলিকণা জমেছে শরীরে ঢের আর
চোখ দুটো ক্লান্তির গহন কুয়াশায়
সমাচ্ছন্ন, তবু হেঁটে চলেছি দৌড়ের
করুণ, অস্পষ্ট, ব্যর্থ ভঙ্গিমায়। এ খেলায়
জয়ের প্রত্যাশা শুধু ধুধু মরীচিকা জানি, তবু
আখেরে কোথাও পৌঁছে যাওয়ার প্রত্যাশা জেগে রয়।
১৯-০২-২০০২