তাকালেই চোখে পড়ে
কিছুদিন হল কী-যে হয়েছে আমার, কিয়দ্দূরে
তাকালেই চোখে পড়ে রঙ বেরঙের
নানা চৌকো নক্শা, কখনও বা শাদা অথবা ধূসর
গোলাকার বস্তু যেন। মাঝে মাঝে হঠাৎ আমার
কাছে ব’সে-থাকা কারও পরিচ্ছন্ন মুখে ফুটে ওঠে
গুটি বসন্তের মতো দাগ। এ আমার কী-যে হল!
চোখে সাম্প্রতিক অস্ত্রোপচারের পর আচানক
এই অঘটন বিষাদের জালে করেছে আটক
আমাকে, তবে কি এভাবেই বাকি পথ প্রায়শই
থমকে, চমকে পাড়ি দিতে হবে? এই বিভীষিকা
থেকে, হায়, নেই কি আমার মুক্তি? কখন কী ছবি
ভেসে ওঠে দৃষ্টিপথে, সে আতঙ্কে ডুবে থাকি বেলা অবেলায়!
আমি তো দেখতে চাই কদম ফুলের রূপ সজল আষাঢ়ে,
গোধূলির নরম আলোয় বারান্দার রেলিঙে খানিক ঝুঁকে
দাঁড়ানো তন্বীর শরীরের সৌন্দর্য-ঝরানো মুদ্রা,
মেঘের বাগান ছুঁয়ে-যাওয়া
পাখির ডানার সুকোমল সঞ্চালন,
এবং শুনতে চাই দূর থেকে ভেসে-আসা বাঁশির আহ্বান।
এমনই নসিব, আজকাল বার বার চোখে ভাসে
নদীর নিস্পৃহ বুকে কুমারীর লাশ; হন্তারক লাপাত্তা এবং
কন্যাহারা জনক জননী শোকে রুদ্ধবাক্, বুকে
হাহাকার। সন্ত্রাস মুকুট পরে রাজপথে ভ্রাম্যমাণ শিস্
দিতে দিতে; গেরস্তের ঘরে দীপ নিভে যায় যখন তখন,
আমার দু’চোখে ভেসে ওঠে ঘাতকের বিজয়ী মিছিল!
সম্প্রতি নিজেই আমি আমার চোখের আচরণে বড় বেশি
ক্ষুব্ধ, সর্বক্ষণ ওরা সম্পূর্ণ মুদ্রিত থাকলেও
দেখি নানা ভয়াবহ বিকৃত মুখের আনাগোনা,
রক্তময় দেয়াল এবং বিধ্বস্ত বিছানা
এই বিভীষিকা থেকে আমি কি পাবো আন মুক্তি? যদি
দু’চোখ উপড়ে ফেলি নিজ হাতে, তবুও কি নয়?
দর্পণে প্রতিফলিত
দর্পণে প্রতিফলিত এই মুখ কার? সত্যি কার?
এ আমারই নাকি অন্য কারও? যতদূর
মনে হয়, এ আমার নয়। এ রকম
অচেনা, বেগানা মুখ কী ক’রে আমার
হতে পারে? এই মুখমণ্ডলে কী গাঢ়
রেখাবলী প্রস্ফুটিত, চোখ দুটো স্লান অতিশয়।
এ কার চেহারা আমি বয়ে বেড়াচ্ছি এখন? ইচ্ছে হয়,
এক্ষুণি বাতিল কাগজের মতো ছিঁড়ে
ফেলে দিই ডাস্টবিনে। হামেশা সাবানে ঘষলেও
কদাকার, জাঁহাবাজ, হিংস্র চিহ্নগুলি
কখনও যাবে না মুছে। ধিক, তোকে ধিক, ব’লে এক
পাখি উড়ে যায় ভাসমান মেঘে।
দর্পণে প্রতিফলিত এই মুখ কফিলের? নাকি অনিলের?
বড়ুয়ার? রিচার্ডের বুঝি? নয়, নয়,
এদের কারুর নয়। যদি বলি বনের পশুর,
তাহ’লে তারাও সমস্বরে প্রতিবাদে
ভীষণ পড়বে ফেটে, বলবে ‘কোনো না, অপমান
আমাদের। আমরা পারিনি হ’তে হিংস্র এই মতো’।
শ্যামলী, ঢাকা।
২৯-০৫-২০০২
দীর্ঘ আয়নায় নিজের ছায়া
দীর্ঘ আয়নায় নিজের ছায়া ঠোঁট নেড়ে স্তিমিত কণ্ঠস্বরে
প্রশ্ন করে, ‘বলতে কি পারো কে তুমি? ভড়কে গিয়ে ছায়াকে ছুঁই,
জানতে চাই কেন সে এমন সওয়াল করেছে ব্যাকুলতায় এই
গোধূলিবেলায়। ছায়া তাকায় আমার দিকে, কিছুক্ষণ থেমে
বলে, ‘আমি নিজেই জানি না কেন এই অবেলায় এমন প্রশ্ন ছুড়ে
দিয়েছি তোমার দিকে। তোমার মনের গভীরে কখনও কি
উঁকি দেয়নি এমন সওয়াল?’ মাথার সব কোণা হাতড়ে যাচাই
করি, কখনও ব্যাপারটি আমাকে প্রশ্নাতুর করেছে কি না। আবছা
কিছু মনে পড়ে, অথচ মুহূর্তেই গাঢ় কালো মেঘমালা দিয়েছে
ঢেকে অস্পষ্ট কথাকে। আয়নার ছায়া থেকে দূরে সরে গিয়ে
বসি পাশের ঘরে, যেখানে আমার তিনটি বুক-শেলফ্-ভরা নানা
বই রয়েছে হাতের স্পর্শের নীরব, ব্যাকুল প্রতীক্ষায়। আমার প্রিয় এই ঘরে
লেখার টেবিল, টেলিফোন সেট, কয়েকটি পুরোনো, নতুন
কলম, কছু সাদা কাগজের প্যাড, একটি টেবিলল্যাম্প, টেবিলের
শরীর-ঘেঁরা পুরোনো চেয়ার, অদূরে স্থিত খাট, মনে হয়,
অনুরক্ত, মায়াময় দ্যাখে।
কতকাল নিজের সঙ্গে বসবাস করছি, অথচ আজ অব্দি নিজের
প্রকৃত সত্তা অচেনা রয়ে গেল। বই পড়ি, টেবিলে ঝুঁকে লিখি, কখনও
দিনে, সর্বদা রাতে বিছানায় শুয়ে স্মৃতির জাল ফেলি, অচমকা
গুটিয়ে নিই, নিদ্রার কুয়াশায় হারাই। কখনও কখনও জেগে উঠে
অন্ধকারে চোখ মেলে তাকাই জীবনসঙ্গিনী, দেয়াল, দরজা জানালা,
বুক শেল্ফ-এর দিকে। ঘরের তিমির প্রশ্ন করে আমাকে, ‘কে তুমি?
বলতে পারো প্রকৃত কে তুমি? অস্থিরতায় বিছানায় এ-পাশ
ও-পাশ করি। দম বন্ধ হয়ে আসে যেন, হঠাৎ উঠে বসি, পাথুরে
অন্ধকার আমাকে গিলে খেতে চায়। বাতি জ্বেলে তাকাই চৌদিকে,
কিঞ্চিৎ স্বস্তি পাই, তবু প্রশ্ন জাগে, ‘কে আমি? আমার গন্তব্য
কোথায়? কে আমাকে বলে দেবে?’ ঘরের আলো নিভে গেছে যেন,
হাহাকারময় অন্ধকার গম্ভীর কণ্ঠস্বরে করে উচ্চারণ,
‘কোথায় যেতে চাও? বস্তুত চির-তিমির ছাড়া কোথাও যাওয়ার নেই।‘
২৭-০৯-২০০২
ধ্বংসকেই দ্রুত ডেকে আনে
ভীষণ ঘুরছে মাথা, হাত-পা টলছে, যেন ঢেউয়ে
নৌকা, তবু দাঁড়িয়ে থাকতে হবে, উদ্যম হারালে
চলবে না। আমাদের চোখের সামনে চাঁদটিকে
গিলে খাচ্ছে দুরন্ত খবিশ, শহরের
সবগুলো বাগিচার নানাবিধ ফুল
কীটের সন্ত্রাসের নিমেষেই ঝরে পড়ছে লোলুপ মৃত্তিকায়।
যে-ভাবে কাঁপছে জমি, মনে হয়, নিমেষেই দরদালানের
কাতার পড়বে ধসে তাসের ধরনে। চেয়ে দ্যাখো,
কেমন নড়ছে সব-গাছ গাছড়া এবং খসে
পড়বে পাখির নীড়। অথচ অদূরে মেতে আছে বেপরোয়া
ক’জন জুয়াড়ি তিন তাসের খেলায়। কালবেলা
কী দ্রুত আসছে ধেয়ে বারবার, তবুও টনক নড়ছে না।
অতিদূর কোথাও কে যেন অতিশয়
নিবিড় করুণ সুর তুলছে বাঁশিতে, সেই সুরে
ভবিষ্যৎ কালের ধ্বংসের পূর্বাভাস সদ্য-বিধবার কান্না
হয়ে ঝরে যাচ্ছে অতিরত। পদতলে বারবার
মাটি কম্পমান আর কোন্ দিক থেকে যেন ঘন
ঘন ভেঙে-পড়া ফ্ল্যাটদের আর্তনাদ ভেসে আসে।
বিপদের কালো মেঘে ছেয়ে যাবে আমাদের সুনীল আকাশ-
কোনও কোনও জ্ঞানী বলেছিলেন আগেই,-
প্রাসাদ, কুটির সবই ভূগর্ভে বিলীন হবে, যদি না মানব
আগে ভাগে সুন্দর, কল্যাণ-প্রদর্শিত পথে হেঁটে
মহত্ত্বের সাধনায় মনে প্রাণে সদা
ব্রতী হয়। হিংসা, দ্বেষ ঘৃণা সৃষ্টি নয় ধ্বংসকেই দ্রুত ডেকে আনে।
‘পাগলের প্রলাপ এসব,’ ব’লে হো-হো হেসে ওঠে
জুয়াড়ির ঝাঁক আর মদিরার স্রোতে ভেসে কোমর দুলিয়ে
রাস্তা সাম্ভা নেচে নিজেদের সমাজ সংসার মিছে সব ভেবে,
আপদ বিপদ ভুলে বস্তুত আপনকার পকেট হাতড়ে
শূন্যতাকে পেয়ে দিব্যি ঢলে পড়ে ইয়ারের কাঁধে আর হিন্দি
ফিল্মের চটুল সুর টেনে আনে জিভের ডগায়।
ওদিকে ক্ষুধার্ত জমি ‘খাদ্য চাই’ ব’লে ভায়ানক গর্জে ওঠে
চৌদিকে, পাখিরা নীড় ছেড়ে অতিদূর আসমানে উড়ে যায়।
১০-০৯-০২