জুয়েলের জাদু
সন্ধ্যারাতে জুয়েল আইচ বহুদিন পর ফের
আমাকে মোটরকালে নিয়ে
আমাদের শ্যামলীর বাসায় এলেন
নক্ষত্রের পানে চেয়ে বেদনার পানে
বড় বেশি ঝুঁকে গিয়ে। তাকে দেখে আমাদের দীপিতা ত্বরিত
এল ছুটে। ছোট্র এই মেয়ে আগে জুয়েলের জাদু
দেখেছিল এক সন্ধ্যারাতে। সেই স্মৃতি
নিয়ে এল টেনে তাকে আমাদের আলাপের কাছে।
অনেকের মতো দীপিতাও জেনে গেছে মজাদার
গায়েবি ক্ষমতা-কত কিছু হাত থেকে আচানক
হয় যে উধাও, উহাদের খোঁজ পায় না ত কেউ,
যদি না জুয়েল তার কেরামতি খাটিয়ে সেগুলি
ফের নিয়ে আসে হাতে। জাদুকর
জুয়েল পায়রা কিংবা অন্য কিছু হাওয়ায় বিলীন ক’রে
আমাদের তাক লাগানোয় ছিলেন না
উৎসাহী তেমন, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধকালীন নিজের
কিছু কথা জানালেন গল্পচ্ছলে কৃতী কথকের মতো আর
আমরা ক’জন শ্রোতা মন্ত্রমুগ্ধ যেন আগাগোড়া।
জুয়েলকে সে-রাতে বিদায় দিতে গিয়ে দীপিতার বাবা নিচে
নেমে যায় অন্ধকারে। দীপিতার জন্মদাত্রী টিয়া
ঠাট্রাচ্ছলে বলে তার মেয়েকে, ‘তোমার বাবা হওয়ায় মিলিয়ে
গেছে জুয়েলের ম্যাজিকের ছোঁয়ায় কোথায় যেন।‘
দীপিতা মায়ের কথা শুনে কেঁদে ফেলে। আমি তাকে
সান্ত্বানার কথা ব’লে থামাই ফোঁপানি ওর। ভাবি-
একদিন যখন আমার ক্ষয়া শরীর হঠাৎ
ভীষণ নিস্পন্দ শৈত্যে ছেয়ে যাবে, প্রাণপাখি উড়ে অজানায়
হবে লুপ্ত, চিহ্নহীন, সেই ক্ষণে জুয়েল অথবা
প্রবাদপ্রতিম হুডিনির চেয়েও অধিক খ্যাতিমান কোনও
জাদুকরও ব্যর্থ হবে ফেরাতে আমাকে এই সুন্দর ভুবনে।
০৫-০৪-২০০২
জয়ঢাক বাজাতে আগ্রহী আজও
ফাঁদ তো পাতাই থাকে নানাদিকে, পা হড়কে আটকে পড়াটা
অসম্ভব কিছু নয়। চৌদিকে ইঁদুর-দৌড় খুব
জমেছে দেখতে পাচ্ছি, কে কাকে কনুই
দিয়ে গুঁতো মেরে আচানক
নিজের জবর গলা সম্মুখে এগিয়ে দিয়ে বাজি
জিতে নেয়া, হৈ-হুল্লোড়ে মেতে ওঠা কেল্লা ফতে বটে।
কথাগুলো কোথায় কখন ঠিক কে যে
শুনিয়েছিলেন, মনে পড়ছে না। উচ্চারিত কথামালা কোন্
সন্ধ্যাবেলা দুলেছিল, খুঁটিনাটি সবই
বিস্মৃতির ডোবায় পচছে। আজকাল
মগজ বেবাক ফাঁকা, উপরন্তু অসংখ্য কাকের হাঁকডাকে
একান্ত নিভৃতচারী কোকিলের গান ডুবে যায়।
কে যে কোন্দিন মুখে চৌকশ মুখোশ এঁটে নিয়ে
দাঁড়াবে সম্মুখে এসে নিশ্চয়তা নেই, সেই মূর্তি দৃষ্টি পথে
পড়লেই নির্ঘাৎ ভড়কে উঠে মূর্চ্ছা যাব আর
প্রেতদের হাসি আঁধারকে অধিক আঁধার করে
তুলবে চৌদিক, দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে ওরা আর
মনুষ্যত্ব সম্ভবত দু’হাতে ঢাকবে মুখ অসহায় বালকের মতো।
রাত সাড়ে তিনটায় বুড়িগঙ্গা নদীটির নিদ্রিত যৌবন
অকস্মাৎ জেগে উঠে তীর ছাপিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে পথে,
বেপরোয়া আবেগে রাস্তার পর রাস্তা বেয়ে ঠিক
প্রবল চুম্বন করে লালবাগের কেল্লাকে আর
ছুটে গিয়ে একুশের শহীদ মিনারে মাথা ঘষে,
আসমান নেমে এসে খুব নিচে মিনারকে করে আলিঙ্গন।
অপরূপ এই দৃশ্য কেউ দেখল কি দেখল না, এই সত্য
জানলো কি জানালো না-বুড়িগঙ্গা, কেল্লা অথবা শহীদ
মিনারের কাছে শাদা কাগজের মতো অবিকল।
আলোকিত এই দিন নয়তো নির্বাক;
কল্যাণ, প্রগতি আর চিরসুন্দরের জয়ঢাক
সবদিকে বাজাতে আগ্রহী আজও পঁচিশে বৈশাখ।
০২-০৫-২০০২
ঢের ঢের দিনরাত
এই যে এখন এই হাড়-কাঁপানো শীতের ভোরবেলা
কাঠের চেয়ারে ব’সে একটি কবিতা
রচনার কথা ভেবে কলম নিয়েছি হাতে, দেখছি বাইরে
ধূসর কুয়াশা তার বিছিয়েছে জাল, যখন বাড়ির
সবাই ঘুমের গাঢ় মখমলে ডুবে আছে,
আমি কিছু শব্দ খুঁজে বেড়াচ্ছি, যেমন
নাবিক তালাশ করে প্রকৃতির মায়াঘেরা দ্বীপপুঞ্জ দীপ্র
আগ্রহ-উন্মুখ চোখে। প্রকৃত সন্ধান জেগে আছে
আমার এখনও ঢের ঢের দিন রাত
মানস ভ্রমণে মগ্ন থাকার পরেও। ডাঁই ডাঁই
শাদা কাগজের বুকে হরফের ছবি
আঁকা হয়ে গেছে, তবু সৃজনের ক্ষুধায় কাতর আজও আমি।
কী হয়, কী হবে সারি সারি শব্দ সাজিয়ে কাগজে?
আমি তো খুঁজি অমরতা কোনওকালে
পঙ্ক্তিমালা কালের গলায়
সাগ্রহে ঝুলিয়ে দিয়ে। বিনীত ভঙ্গিতে যতটুকু
পেরেছি সঞ্চয় থেকে করেছি অর্পণ। বলা যায়,
দিয়েছি উজাড় করে সব, জানি না কিছুর তার
প্রকৃত গৃহীত হবে, নাকি, শুধু
হেলার কলঙ্ক নিয়ে লুটোবে ধুলোয়!
হোক যত অবহেলা, না পড়ার সপ্রশংস দৃষ্টি কাব্যনাম্নী
রূপসীর এই অভাজজনের ওপর, তবু তার
পলায়নপর কায়া কিংবা ছায়ার পেছনে যত পারি
তত ষড়ঋতু অবিরাম ছুটব তুমুল লোকালয়ে কিংবা
বিরানায় পর্বত চূড়ায় আর উদাস প্রান্তরে
দেখব সে কতটা নিঠুরা উদাসীন হতে পারে।
১৭-০১-২০০২
তট ভাঙার জেদ
বলতে ভাল লাগে, আমার পূর্বপুরুষগণ
মেঘনা নদীর তীরবর্তী পাড়াতলী গাঁয়ের
বাসিন্দা ছিলেন। তাঁদের ছোট বড় কুঁড়ে ঘর
এখন নিশ্চিহ্ন, কিন্তু পুকুর আর পাকা মসজিদটি
আজ অব্দি রয়ে গেছে সগৌরবে। আমার
পিতার সৃষ্ট একটি দালান আর ইশকুল এখনও
দাঁড়ানো মাথা উঁচু করে। দু’তিন বছর অন্তর
আমরা একবার যাই পূর্বপুরুষদের স্মৃতির মঞ্জিলে।
দাদাজান, নানাজান, আব্বা আর চার চাচা, আমার
এক সন্তানের এবং আরও কারও কারও কবর রয়েছে সেখানে। রাত্তিরে
নিষ্প্রদীপ সেই উদাস কবরস্থানে জোনাকিরা ছড়ায় আলো
আর ঝিঁঝিঁ পোকা একটানা সুর হয়ে ঝরে চৌদিকে।
পূর্বপুরুষদের কদিমি পুকুর আত্মজকে আমার
গিলেছে সেই কবে। এক ভরদুপুরে। আজও স্বগ্রামে গেলে
অতীত এবং বর্তমানের প্রতি নির্বিকার পুকুরটির কিনারে
গিয়ে বসি। গাছ গাছালি ঘেরা এই
জলাশয় সাক্ষী, এখানেই একাত্তরে হিংস্রতার তাড়া-খাওয়া
সন্ত্রস্ত হরিণের মতো জন্মশহর থেকে ছুটে এখানেই
নিয়েছিলাম ঠাঁই। এই পুকুর আমাকে দেখলেই, মনে হয়,
হাসে বাঁকা হাসি; তবু দিয়েছে যুগল কবিতা উপহার।
আমাদের পাড়াতলী গাঁয়ে ইলেকট্রিসিটি এখনও
গরহাজির, অরণ্যের ঘোর অন্ধকার
বিরাজমান এখানকার রাতগুলো। নিশীথের
তিমির রোদেলা দুপুরেও অনেকের মনের
ডোবায় ভাসমান, অথচ গাভীর ওলান
থেকে নিঃসৃত দুধের ধারার মতোই সারল্য ওদের।
শহরে লালিত পালিত এই আমার সত্তায় পাড়াতলী গাঁয়ের
পূর্বপুরুষদের শোণিতধারা প্রবহমান
মেঘনার স্রোতের মত। বুঝি তাই সমাজের বহুমুখী নিপীড়ন,
নির্দয় শাসকদের সন্ত্রাস আমার ভেতর
মেঘনার উত্তাল তরঙ্গমালা হয়ে জেগে ওঠে প্রতিবাদ,
এগিয়ে চলার তেজ, প্রতিক্রিয়ার অনড় তট ভাঙার জেদ।
০৩-০৪-২০০২