জংধরা খাঁচার ভেতর
যতদূর জানি এক ঝাঁঝালো যুবক বুড়ো সুড়ো
এই ক্ষয়া আমার ভেতরকার নিভৃত বাসিন্দা
অনেক বছর ধরে। বসে থাকে, ঝাঁকায় দীঘল
কেশর শিং মাঝে মাঝে আমাকে থামিয়ে আওড়ায় পঙ্ক্তিমালা।
যুবকটি আমার গহন থেকে নিঝুম বেরিয়ে
সিঁড়ি বেয়ে গলিপথে নেমে
হেঁটে হেঁটে প্রধান সড়কে চলে যায়,
যেতে থাকে, যেতে থাকে উদ্দেশ্যবিহীন।
কখনও বাতাসে চুল ওড়ে তরুণের, কখনও বা
রোদের কামড়ে তার গায়ের চামড়া পুড়ে যায়, স্নেহ চায়
লাজুক জ্যোৎস্নার। নেই কোনও বান্ধবের
আস্তানা কোথাও কিছুক্ষণ জিরোবার।
তরুণ চলেছে হেঁটে পাথুরে রাস্তায়, যেতে যেতে
দেখছে দু’পাশে কত বাড়ি একরোখা তীক্ষ্ণ সাঁড়াশির মতো
নখের হামলা সয়ে দিব্যি টিকে আছে
প্রতিবাদহীন, রক্তধারা বয় দেয়ালে দেয়ালে।
এই কি আমার জন্মশহর?-যুবক ভাবে এবং চালায়
পদযুগ অযান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়। ভেতরের সব
ক্ষয়ে-যাওয়া যন্ত্রের আসর কেঁপে ওঠে ভয়ানক,
তরুণ সতেজ হাওয়া টেনে নিতে চায়, নিতে থাকে
সোজা বাঁকা নানা পথে চলতে চলতে
যুবকটি দ্যাখে কোনও দিকে সবুজের চিহ্ন নেই,
ইতস্তত একটি কি দুটি গাছ মরে পড়ে আছে;
একটি পাখিও চোখে পড়েনি সন্ধানী তরুণের।
কী করবে? কোন্ দিকে যাবে আর? সিদ্ধান্ত গ্রহণে
ব্যর্থ সে তরুণ; অকস্মাৎ কে যেন প্রবল টানে
পেছনে ঠেলছে তাকে, অসহায় যুবা জংধরা
খাঁচার ভেতর দ্রুত ফিরে যেতে থাকে।
হায়, প্রত্যাবর্তনের পরেও কেমন ব্য্যাকুলতা জন্ম নেয়
জংধরা খাঁচার ভেতর, তরুণের ঘাড়ে নেমে-আসা স্ফীত
কেশরাশি ফুঁসে ওঠে ঘন ঘন, ঘুমন্ত যৌবন
অধীর বাড়ায় হাত অনুপম জাগৃতির দিকে।
০৪-০৭-২০০২
জীবন কেটেই গেল প্রায়
জীবন কেটেই গেল প্রায়, তবু এই স্বদেশের রৌদ্র ছায়া,
জ্যোৎস্নাধারা, বুড়িগঙ্গা, মেঘনা নদীর তীর, আপনজনের
মধুর সংসর্গ ছেড়ে যাওয়ার ভাবনা
কখনও দিইনি ঠাঁই এমনকি মনের গহন
কন্দরেও। কারও সাতে-পাঁচে নেই আমি, কখনও দিইনি ছাই
কারও বাড়া ভাতে, শুধু একাকী নিজের ঘরে লিখেছি কবিতা।
আমার অনেক প্রিয়জন উচ্চাশায় মজে জ্বলজ্বলে এক
জীবনের সন্ধ্যানে দিয়েছে পাড়ি ভিন্ দেশে, আমি
রয়ে গেছি এই প্রিয় বাংলায় আমার
বিপদের উদ্যত বর্শা, বন্দুকের মুখে, কাটিয়েছি
কত না বিনিদ্র থরথর রাত, এমনকি রক্তরাঙা ঢের
দ্বিপ্রহর। বিভীষিকা জীবনের গায়ে পড়া ইয়ার এখন!
বুক খুব ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে হাঁটে পথে সিটি বাজাতে বাজাতে
সন্ত্রাসের জগতের কত যে মোড়ল,
কে তার হিসের রাখে? ধর্মের আড়ালে কত কট্রর সন্ত্রাসী
মাঠে ময়দানে, সরকারী ক্যামেরায়
দাপট দেখিয়ে বলে, ‘এক্ষুণি বিদায় হও, যাও জাহান্নামেঃ
তোমাদের ঠাঁই নেই আমাদের মুলুকে এখন।‘
যখন নিঝুম বিষণ্নতা আমাকে দখল করে, দু’পাশের
গাছপালা, গোলাপ, চামেলি কৃষ্ণচূড়া, চন্দ্রমল্লিকা এবং
বুড়িগঙ্গা, মেঘনা নদীর তীর, শ্যামলীর নীড়,
পাড়াতলী গাঁয়ের কাজল মাটি বলে সমস্বরে,-
‘আমাদের ছেড়ে প্রিয় কবি যেও না কোথাও, তুমি
আমাদের একান্ত আপন। আমি কাদের প্রস্তাব নেব মেনে?
০৯-০৪-২০০২
জীবন তো প্রকৃত খেলার মাঠ
(বন্ধু তওফিক আজিজ খানের স্মরণে)
জীবন তো প্রকৃত খেলারই মাঠ, আমরা সবাই
খেলে যাই যে যার মতোই। যতদূর
জানি তুমি শুরু থেকে শেষ অব্দি খেলেছ, বান্ধব,
নিজের ধরনে ক্রিকেটের দক্ষ ব্যাটস্ম্যানের
ভঙ্গিমায়। সাজিয়েছ আপন সংসার
সুচারু অভিনিবেশে, যেমন ব্যাটস্ম্যান তার
সফল ইনিংস। প্রতি পদক্ষেপে ছিল
নিষ্ঠা আর ভঙ্গিতে সুষমা। বিপরীত দিক থেকে
বল এলে কখনো ধৈর্যের সঙ্গে ঠেকিয়ে দিয়েছে,
কখনো-বা ফুটিয়েছ চারের মারের ফুলঝুরি।
ফুলবাণে বিদ্ধ হয়ে যখন উতলা ছিলে খুব, তখন সে
কাঙ্ক্ষিতা তোমার প্রিয় জীবনসঙ্গিনী হয়ে বাঁধলো তোমাকে
আলিঙ্গনে। তোমরা দুজন গড়েছিলে
সুখের, শান্তির নীড়। প্রিয়ার চুম্বন আর সন্তানের খেলা
তোমার ক্লান্তির ছায়াটিকে সহজে দিয়েছে মুছে। জীবনের
মাঠে কখন যে কোন্ অঘটন ঘটে, কে তার হিশের রাখে?
তোমার প্রতিটি শটে ছিল শিল্পের বিভাস, তবে কেন
সেঞ্চুরী না হাঁকিয়ে হঠাৎ পরাজয় মেনে নিয়ে
ব্যাট মাঠে ঠুকে ঠুকে বিশ্রামের কুয়াশায় নাকি
ভবঘুরে মেঘদলে, পড়লে ঘুমিয়ে সেই শোকে,
হে বন্ধু, যেখান থেকে কেউ ফিরে
আসে না কস্মিনকালে। কেন চলে গেলে?
ছিল না নাছোড় স্তব্ধ অভিমান কোনো? যতদূর
চিনেছি তোমাকে, ছিলে তুমি দিব্যি হাসিখুশি,
বাস্তবের খেলাঘরে সমর্পিত। কোন্ সে খেয়ালি
আম্পায়ার আচমকা আঙুলের সংকেতে তোমাকে
পিচ ছেড়ে যেতে বললেন আর সেই জ্বলজ্বলে ইনিংসটি
পুরো না খেলেই তুমি হায়, মিশে গেলে অজানা কোথায়!
২৪-০১-২০০২
জীবিতের পাথুরে স্তব্ধতা
সংকীর্ণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে কৃপণ আকাশের দিকে
তাকিয়ে কী যেন দেখতে পেয়ে ঢ্যাঙা যুবক চমকে
উঠলো তার অস্তিত্বের ঝাঁকুনিতে। ভীষণ কুৎসিত জন্তু এক
লাফাতে লাফাতে চৌদিকে বিদ্ঘুটে গন্ধ ছড়িয়ে ছিটিয়ে
মিশে যায় মেঘমালায়। খানিক পরেই সেটা মেঘ ফুঁড়ে
সেই যুবাকে অধিকতর ভড়কে দিয়ে উগরে ফেলে কয়েকটি করোটি এবং হাড়ের ভগ্নাংশ। হঠাৎ যুবার পা টলতে থাকে, বুঝি-বা
ভয়ঙ্কর তেজী ভূমিকম্প ওকে ধুলোয় মিশিয়ে দিতে প্রতিশ্রুতি
নির্বিকার আজরাইলের কাছে। কয়েকটি শতচ্ছিন্ন কামিজ,
ট্রাউজার ঝুলছে ফাঁসির লাশের মতো।
ঢ্যাঙা, আতঙ্কিত যুবক নিজেকেও লাশ ঠাউরে কাঠের
পুতুলের মতো পড়ে থাকে নিস্পন্দ এক কোণে। আলো,
আঁধার অথবা ধুলো কিংবা বৃষ্টি-কিছুই ফেরাতে পারে না তার
এক রত্তি কবোষ্ণ বোধ। বিধ্বস্ত বারান্দা, ঘরদোর, করুণ,
রক্ত-রঞ্জিত আসবাব, অভাবিত লাশের স্তূপের বড় নিঃশব্দ
আহাজারি, মুষ্টিমেয় জীবিতের পাথুরের স্তব্ধতার একঘেয়ে
বোবা আর্তনাদ ছড়িয়ে পড়েছে অলিতে, গলিতে, বাজারে, বন্দরে;
ভাঙাচোরা, বিকৃত মামুলি পাড়ায়, অভিজাত আকাশ-ছোঁয়া
প্রাসাদোপম ফ্ল্যাটের সারির হু হু হাহাকার, ধ্বংসের স্মৃতি
বয়ে বেড়ানো কী ক’রে সইবে পুরোনো বসতি?
৩০-০৯-২০০২