কৃষ্ণপক্ষে অসহায় পঙ্ক্তিমালা মহিমাবিহীন যীশু
এ কী? এই শহরের গাছগুলি ক্ষণে ক্ষণে রক্ত বমি ক’রে
প্রবল ভাসিয়ে দিচ্ছে পথ ঘাট, মাঝে মাঝে
থামছে খানিক, পরমুহূর্তেই ফের ফিন্কি দিয়ে
রক্ত ঝরে, যেন ওরা ভীষণ আক্রোশে ছুড়ে দিচ্ছে লাল থুতু।
শুধু কি আক্রোশ? নাকি ভয়ানক বিবমিষা আজ
করেছে দখল এই নগরের বৃক্ষসমাজকে! ইচ্ছে হল ছুটে যাই।
তাদের নিকট, সেবা শুশ্রূষায় মুছে ফেলি
রোগের মলিন ছায়া, বৃক্ষসমাজের বর্তমান অস্তিত্বের
ধূসরতা অকৃত্রিম সবুজে বদলে দিই, ডেকে আনি ফের
পলাতক কোকিলকে রোগমুক্ত সতেজ পাতার আস্তানায়।
আমি তো রবীন্দ্রনাথ, নজরুল অথবা জীবনানন্দ নই, কেন
আমার নাছোড় আবেদনে পীড়িত গাছের পাতা
আবার সবুজ আভা ফিরে পাবে? কেন কোকিল আসবে ফিরে
নাগরিক বিপন্ন গাছের মজলিশে সুর ঝরাতে আবার?
মাথা নিচু ক’রে ফিরে যাচ্ছি শ্যামলীর অবসন্ন গলিমুখে;
অকস্মাৎ পায়ের তলার মাটি কেঁপে ওঠে, দেখি-
মাটি ফুঁড়ে আগুনের জ্বলজ্যান্ত ঢেলা
চৌদিকে ছিটিয়ে পড়ে, এ কী! নড়ে ওঠে সুপ্রাচীন
ডাইনোসরের মাথা, হিংস্র দাঁতগুলো
নিমেষে আমাকে গেঁথে ফেলে, যেন আমি মহিমাবিহীন যীশু!
২২-০৮-২০০২
কে যেন তরঙ্গ তুলে কুয়াশায়
এখন আমার যে বয়স সে বয়সে পৌষ, মাঘে
শীতের সুতীক্ষ দাঁত সহজেই ভেদ করে মাংসের দেয়াল
আর কেঁপে ওঠে খুব সত্তার চৌকাঠ। অন্ধকার
ঘরে একা বসে ভাবি, কী উদ্দাম ছিল
একদা আমার যৌবনের ফাল্গুনের পুষ্পময়
দিনগুলি, বৈশাখী ঝড়ের মতো আবেগের ঝাপ্টা
বয়ে শহরের অলিগলি চষে বেড়াবার দিনগুলি আর
কবিতায় মশগুল নিজের সঙ্গেই কথা-বলা রাতগুলি।
সেকালের শীতের সুতীক্ষ্ণ দাঁতে হতো না তেমন
শীতল শরীর এই সাম্প্রতিক বুড়ো লোকটার
কিছুতেই; বসন্ত বাহার রাগে নিয়ত উঠত বেজে সবই
নিমেষে তখন। আজ জবুথবু
পড়ে থাকি এক কোণে হৈ-হুল্লা, মিছিল থেকে দূরে। কোনও দিন
নব্য কোনও কবির বইয়ের
পাতায় উৎসুক চোখ পাতি, স্বাদ নিই, কখনও বা দেখি
কাছের গাছের ডালে বসে-থাকা পাখিটিকে-ওর শীত নেই?
সত্য, এখন তো এই শরীর শীতল অতিশয়
ঋতুর কামড়ে, কিন্তু হৃদয়ে আমার
ঝরে না তুষার আজও; কী আশ্চর্য, এখনও সেখান
প্রফুল্ল ধ্বনি হয় বসন্তের কোকিলের গান
প্রায় অবিরাম, সেই গানে প্রস্ফুটিত
হতে থাকে কারও কারও নাম। অকস্মাৎ চোখে পড়ে
কে যেন তরঙ্গ তুলে কুয়াশায় হেঁটে যায় একা
এবং পরনে তার অপরূপ মহীন লেবাস। সে রূপসী
তাকায় না পেছনে একটিবারও। তার হাত ধরে
নিবিড় যাচ্ছেন হেঁটে নিভৃত জীবনানন্দ প্রলম্বিত ছন্দে।
১০-০১-২০০২
কোথায় চলেছি?
যাচ্ছি, ক্রমাগত যাচ্ছি; সেই কবে থেকে
আজ অব্দি, বলো,
কোথায় চলেছি? বলা যায়,
এই অধমের আওতায়
যা-কিছু দেখার আর শোনার, ছোঁয়ার
সবই তো হয়েছে এ জীবনে-
বিনীত স্বীকার করি গোধূলিবেলায়,
তবু কেন মনোলোকে তুষারের স্তূপ?
আমার যাপিত জীবনের সঙ্গে কোনও
বিবাদ, ঝগড়াঝাঁটি নেই,
নেই কোনও বায়বীয় খেদের বালাই। এই মাটি,
হাওয়ার চুমোয় শিহরিত গাছের সবুজ পাতা,
রাঙা ফুল পথরেখা, নদীর রূপালি
নাচ, মোলায়েম মেঘে পাখির সাঁতার,
শিশুর অনিন্দ্য হাসি, নারীর প্রণয়,
তারুণ্যের কণ্ঠে জীবনের, প্রগতির গান আজও ভালবাসি।
অথচ কখনও ভোরবেলা চোখ থেকে
ঘুমের কুয়াশা মুছে গেলে,
অথবা রাত্তিরে কোনও কবিতা লেখার দীপ্র ক্ষণে দয়িতার
মুখশ্রী খাতার বুকে জেগে
ওঠার মুহূর্তে অকস্মাৎ মৃত্যুচিন্তা অতিশয়
কালো লেবাসের অন্তরালে ফিস্ফিস্ স্বরে বলে,-
“আমি আছি, বুঝেছ হে, কোন দিন কখন যে
হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ে লুটে নেব প্রাণ, জানবে না”।
শোন, এই পৃথিবীর রৌদ্রছায়া, জ্যোৎস্নামায়া
উপভোগ করে বহু জ্ঞানী বলে গেছেন, আখেরে
মরণ তো অবসান, অস্তিত্বের পরিণতি ‘মুঠো
মুঠো ধুলো।‘ এই যে গভীর রাতে জেগে
সাজিয়ে চলেছি পঙ্ক্তিমালা কিংবা অতীতে লিখেছি
কতই না গ্রন্থ, সেগুলো পাহাড়ে,
নাকি হায়, সুবিপুল বিস্ফোরণজনিত কণায়?
২৫-০৬-২০০২
ঘুড়ি
একটি নকশা-কাটা ঘুড়ি হাওয়া আর
মেঘে মেঘে উড়তে উড়তে
চকিতে লাটাই-লগ্ন গতিময় সুতো প্রতিদ্বন্দ্বী
লাটাবাজের তীক্ষ্ণ সুতোর আঁচড়ে
ভাসতে ভাসতে কোথায় যে কত দূরে
লীন হ’ল, জানতে পারেনি নকশা-কাটা সেই ঘুড়ির মালিক।
বেদনার্ত সেই লোক ভেবে, জেগে তিন দিনরাত
হারানো ঘুড়িটি সৃষ্টি করেছিল স্বপ্নাদ্য আদলে
হয়তো-বা, অপরূপ এক নকশা ছিল
ঘুড়ির সত্তায়। ঘুম নেই চোখে তার, নিরানন্দ
বসে থাকে এক কোণে, কী-যে ভাবে আকাশকুসুম,
নিজেও কি জানে সেই লোক? শুধু বয় হাহাকার।
নিজেকে পীড়িত করে প্রায়শ উপোসে, দিনরাত
কী-যে ভাবে মানুষটি, বোঝা দায়। কোনও এক
অমাবস্যা-রাতে, কী আশ্চর্য, নিরালোক ঘর তার
হয়ে ওঠে জ্যোৎস্নাময়, শিরায় শিরায়
ছন্দ নেচে ওঠে, হাত সৃষ্টির দোলায় মশগুল
এবং অনিন্দ ঘুড়ি জন্ম নিতে থাকে।
চিকিৎসকের চেম্বারে
চিকিৎসক এবং রোগী মুখোমুখি, যেন দুই গ্রহ। চিকিৎসক
রোগীর দিকে এক ফালি হাসি পেশ করে জানতে চাইলেন,
কি অসুবিধা খুঁড়ছে তাকে। ঘুসঘুসে জ্বর হচ্ছে কিনা, কিংবা
শরীরের কোন অংশ যন্ত্রণাকাতর কতটুকু, হজম হচ্ছে তো
ঠিক? চিকিৎসক রোগীর রক্তচাপ পরীক্ষা করে দেখলেন,
স্বাভাবিক। সব কিছুই তো ঠিকঠাক আপনার। কোথাও কোনও
উপসর্গ, গলদ লক্ষ গোচর হচ্ছে না। খামোকাই বিচলিত
আপনি। এবার নিশ্চিন্ত মনে বাড়ি যেতে পারেন।
রোগী চিকিৎসকের কথা শুনে তাজ্জব! কোথাও ভুল
করেন নি তো তিনি? রোগী চিকিৎসককে বললেন, চোখ দুটি
বুজলেই দৃষ্টিপথে হাজির হয় ভয়ংকর বিকৃত কয়েকটি মুখ।
কখনও একজন ডাকাবুকো লোক ছুরি চালাচ্ছে এক তরুণের
গলায় আমারই সামনে, সন্ত্রাসীরা সুশীল গেরস্তের ঘরবাড়ি
দেদার পোড়াচ্ছে, যত্রতত্র সম্ভ্রম লুটছে তরুণীদের। ধর্ষিতা
যুবতীরা গ্লানিতে ডুবে মাতে আত্মহননে। চকচকে
ছোরা, উপরন্তু রক্ষীরা সন্ত্রাসে দড়।
প্লীজ ডাক্তার আমাকে বাঁচান।
০৬-০৬-২০০২