ওরা তিনজন
গোধূলিবেলায় অকস্মাৎ আমার অভ্যন্তর থেকে একজন,
তার ভেতর থেকে অন্য একজন, ওর বুক ফুঁড়ে আরেকজন
বেরিয়ে এসে বসে চেয়ারে। যারা বেরিয়ে এলো ঈষৎ
প্রফুল্ল কায়দায়, অভিন্ন ওদের অবয়ব। ওরা পরস্পর
দৃষ্টি বিনিময় করে একই ধরনের হাসির আভাস ঠোঁটে
ফুটিয়ে। ওদের মুখে কোনও কথা নেই, শুধু তাকিয়ে থাকে
আমার দিকে। আমি ওদের অভিবাদন জানাবো কি
জানাবো না, মনস্থির করতে পারি না।
কিছুক্ষণ পর নিস্তব্ধতা ভেঙে জেগে ওঠে একজনের ধুধু
কণ্ঠস্বর, ‘আমাকে চিনতে পারছো না? তোমার তো না
চেনার কথা নয় আমাকে। আমি হলাম তুমি, যে-তুমি
ব্যর্থ হলে আমাকে চিনতে। তুমি আমার ভেতরে থেকে
একদা ছুটোছুটি করেছো শৈশবে, কৈশোরে সবুজ খোলা
মাঠে। আমার ভেতর মিশে ভোরবেলা গাছগাছালিময়
পাড়াগাঁর ছোঁয়ালাগা পথ পেরিয়ে দিঘিপারে বসে
ছিপে তুলে এনেছো সতেজ মাগুর। আমি সেই মৎস্য শিকারী।
দ্বিতীয় জন হাত নেড়ে চোখ ঠেরে বলে, ‘আমাকে চিনলে না তুমি?
আমি সেই লোক, যে প্রতিক্রিয়ার দুর্গ-কাঁপানো শব্দমালা
উপহার দিয়েছে সমাজকে তার যৌবনের মধ্যাহ্নে। তোমার সঙ্গে
এই আমি নানা মুণির হিংসা, দ্বেষ, চরম শক্রতার শরাঘাত সয়েছি।
জানি না বহুমুখী ভোগান্তি শেষ হবে কবে! তৃতীয় জন
নিজের চারদিকে নৈঃশব্দের পাহারা বসিয়ে কেবল হাসির আভা
ছড়িয়ে বসে থাকে এক পাশে। গোধূলি মিশে যায় গাঢ় সন্ধ্যায়।
ওরা তিনজন সুদক্ষ অভিনেতার মতো আমার ভেতরে প্রবেশ করে।
১৪-১০-২০০২
কখনও কোথাও
সেই কবে কাকে যেন কথা দিয়েছিলাম, আবার আসবই।
কখন কোথায় দেখা হবে, ছন্নছাড়া
এই আমি জানাতে পারিনি। সুকোমল
দুটি হাত ছেড়ে চলে গেছি নিরুদ্দেশে।
আমার তো আজও পথ চলার বিরাম
নেই, নানা দিকে যাত্রা করি,
হই মুখোমুখি কত চেনা,
অচেনা জনের, শুধু দেখি না দেখতে যাকে চাই।
নতুন পথের দিশা খুঁজে এগিয়েছি বহুবার,
কত না সকাল সন্ধ্যারাগে পরিণত
হয়েছে, কেটেছে রাত অজানা জায়গায়,
হিসাব রাখিনি।
সম্মুখে চলার দৃঢ় ভরসায় পথ হাঁটি,
দূর দিগন্তের দিকে চোখ
রেখে চলি, অথচ বিস্মিত
পথচারী আমি দেখি শুধু
ঘুরছি, ঘুরছি একই সীমানায়। কে পাখি পাখার
ঝাপ্টায় আহত করে আমাকে এবং
আওড়ায় বার বার, ‘শোনো হে পথিক,
প্রকৃত কোথাও কারও কোনও যাওয়া নেই’।
১০-০৫-২০০২
কলমের চুম্বন
‘আচ্ছা মানুষ তো ভাই আপনি, ভোরের
সূর্য পশ্চিমের আসমানে বুড়ো মানুষের মতো
ধুঁকছে, অথচ চুপচাপ বসে আছেন ঘরের
দরজার খিল এঁটে। দুপুরের আগেই আমার
দোকানে যাবেন বলে কথা ছিল আপনার। ঠিক বলুন তো
পাণ্ডুলিপি তৈরি নাকি আজও ফিরে যেতে হবে শূন্য হাতে?’
এসব কী বলছেন আপনি, সাহেব? কে আপনি? কার কী-বা
পাণ্ডলিপি, এসব জানি না কিছু। তা ছাড়া আমি তো
আপনাকে কখনও দেখিনি কোনও কালে। সব কিছু
ভোজবাজি বলে মনে হচ্ছে। আপনি নিশ্চিত ভুল
জায়গায় এসেছেন, আপনার অভীষ্ট মানুষ নই আমি;
আপনাকে ভিন্ন কোনও দোরের কলিংবেলে ধ্বনি তুলতেই হবে
বাঁচা গেল। আমি কি লেখক কোনও? নইলে কেন সম্পূর্ণ অচেনা
একজন পাণ্ডুলিপি করে দাবি আমার নিকট? ভদ্রলোক
ষোলআনা প্রকাশক বলেই হয়েছে মনে। ভ্রমবশত আমার
উদ্দেশেই অবেলায় হন্তদন্ত হয়ে এসেছিলেন এখানে।
চিঠি আর আবেদনপত্র ছাড়া অন্য কিছু
কখনও লিখিনি, তবে কেন পাণ্ডুলিপির চাহিদা এত?
হায়, এ কেমন এলোমেলো ঠেকছে বেবাক কিছু; উল্টোপাল্টো
চতুর্দিকে; ফাঁকা, সব কিছু ফাঁকা, বড় ধুধু স্মৃতির এলাকা।
একটি বিশাল, ভয়ঙ্কর পশু গিলে খাচ্ছে আকাশ, জমিন।
অকস্মাৎ প্রশ্ন জাগে মনে, কখনও কি
সুদূর অতীতে কোনও কালে আমার খাতার শূন্য পাতাগুলি
উঠত কি ভরে নানা শব্দে কলমের চুম্বনের ফুল ঝরে?
আমি কি বিস্মৃতকালে রাত জেগে লিখেছি ঝাঁঝালো দলছুট
উপন্যাস? আমার লেখনী থেকে হয়েছে কি নিঃসৃত একদা
পাঠকনন্দিত কবিতার পঙ্ক্তিমালা? এই আমি
ছিলাম কি কাফে আর বইপাড়ার আড্ডার
শানানো জিভের মুখরোচক খোরাক? দিন যায়, রাত যায়, ভাবীকালে
এই অধমের কোনও বই থাকবে কি কাব্যপ্রেমী কারও হাতে?
২৯-০৪-২০০২
কাঙ্ক্ষিত অর্কেস্ট্রার প্রতীক্ষায়
আবহাওয়া দপ্তর প্রচার করেছে, ঝড়ের
তেমন কোনও সম্ভানাই নেই; তবু লেখার
টেবিলে কাগজ কলম নিয়ে ব’সে কেন জানি না
বার বার মনে হচ্ছে, তুমুল তুফান হঠাৎ
আসবে ধেয়ে চৌদিক থেকে প্রচণ্ড
ঝাঁকুনি দিয়ে। বাড়ির সবার জন্য আশঙ্কা
শাঁকচুন্নির মতা ভীষণ আঁকড়ে ধরেছে
আমাকে বুকে বড় বেশি চাপ কী করি? কী করি?
নিঃশ্বাস নেয়া ভার, এক ঝটকায়
খানিক মুক্তির জন্য হয়ে পড়ি বেপরোয়া, অথচ
দেখছি এক অন্ধকার কুঠুরির খড়বিচুলিতে গড়িয়ে
গড়িয়ে গোঙাচ্ছি। আচমকা চোখে পড়ল,
চৌদিকে পড়ে আছে অসহায়, নিস্তেজ
ক’জন লোক; এক ঝাঁক হিংস্র ছুঁচো আর ইঁদুর
তেড়ে আসছে আমাদের ছিঁড়ে খাওয়ার
অপ্রতিরোধ্য তাগিদে। পড়ি মরি বাঁচি দিই চম্পট।
দিনদুপুরে চেয়ারে বসেই কি ভয়ানক দুঃস্বপ্ন
দেখছিলাম? নাকি আগামীর কোনও সম্ভাব্য
ঘটনার আভাস ফুটে উঠেছিল অলক্ষুণে সুদীর্ঘ
তন্দ্রায়? কে আমাকে বলে দেবে? হায়, এই পোড়া মাটিতে
কখনও কি দেখে যেতে পারব না এরকম বাগান,
অপরূপ, বিচিত্র পুষ্পরাজি যার সকল
মানব-মানবীর হৃদয়ের ক্ষত করে দিতে পারবে
নিরাময়? আমরা কি পাব না শুনতে নতুন সৃষ্টির অর্কেস্ট্রা?
২৩-০৩-২০০২