একটি কুটিরের কাহিনী
পরিবেশ ছিল দৃষ্টিনন্দন সেখানে, চারদিকে মোলায়েম
দীপ্তি ছিল ঘাস আর গাছগাছালির। যুবতীর
হাসির মতোই প্রস্ফুটিত ছিল ফুল। নিরিবিলি
একটি কুটির যেন একাকী তাপস মগ্ন ধ্যানে বহুকাল।
কুটিরের দরজা জানালা বন্ধ সারাক্ষণ; কড়া নেড়ে নেড়ে
ক্লান্তি আর বিরক্তির গাঢ় ছায়া নিয়ে
ফিরে যায় ছায়ার মতোই অগণন পথচারী। এভাবেই
দিন যায়, রাত কাটে, নানা ঋতু এসে চলে যায়;
হায়, কত কাল লুপ্ত হয়, রাখে না হিসেব কেউ। সেই ঘর
প্রতীক্ষা-কাতর কোনও রূপসীর মতো
খাঁখা দৃষ্টি মেলে
পথের আরেক ধুধু সত্তা অবিরত হতে থাকে যেন।
অপরূপ সেই পরিবেশ কেবলি হারাতে থাকে
রূপ-বড় জীর্ণ শীর্ণ গাছ, মরা ঘাসের ফোঁপানি
চারদিকে, ফুল আর ফোটে না কোথাও
কিছুতেই, হাহাকার ছাড়া কোনও সুর নেই এখানে এখন।
কোনও এক নিশীথের প্রগাঢ় প্রহরে একজন শাদাসিধে
পুরুষের পদচ্ছাপ পড়তেই অমাবস্যা-রাতে আচানক
নিরুপম জ্যোৎস্নায় প্লাবিত হয় বিরান এলাকা। সহজেই
খুলে যায় কুটিরের রুদ্ধ দ্বার, বেজে ওঠে জীবনের সুর।
১৬-০২-২০০২
একটি সামান্য সংলাপ
‘আচ্ছা জনাব, আপনি তো হামেশা
মেঘের মুলুকে থাকেন, তাই না?’
‘মাফ করবেন জনাব, প্রায়শ এই অধম
জমিনেই থাকে, কী রোদে, কী বৃষ্টিতে; তবে হ্যাঁ,
সত্যি বলতে কি, কালেভদ্রে মেঘলোকে
কী করে যে চলে যাই, জানি না নিজেই।‘
‘মাফ করবেন, আমি ভাই অতসর বুঝি না।
লোকে বলে, তাঁরাও উঁচু কিসিমের মানুষ,
ইয়া মোটা মোটা কেতাব লিখেছেন
গহীন রাতের চেরাগ জ্বেলে বিস্তর। তাঁদের
কথা তো বানের পানিতে ভাসাতে পারি না,
মগজের খাস কামরায় জীইয়ে রাখি।‘
‘নয়, নয়, কস্মিনকালেও নয়। তাঁদের
কথামালা ধোঁয়ায় মিলিয়ে দেয়ার
মতো নয়, তাঁরা যা বলেন তা বাজারের
বেজায় কিমতি জিনিশ। আমাদের মানে
আমরা যারা মাঝে মাঝে মেঘে ভাসি, নীলিমায়
সাঁতার কাটি, ফুটফুটে তারা ছুঁয়ে দেখি,
তাঁদের নোস্খা ঠিক হজম হয় না,
হড়হড়িয়ে বমি করে ফেলি অশ্লীল
বেয়াদবের মতো। আচ্ছা চলি, মাটিতে
বহুদিন পা রেখে চলাফেরা করেছি, বিস্তর
হোঁচটও জুটেছে। এখন খানিক দূরে, মানে
মেঘকন্যার চুমো খেতে যাই, ভাই। গুড বাই।‘
১৭-০২-২০০২
এতদিন যে-কবিতা আমার লেখা হয়নি
নির্ঘুম বসে ছিলাম একলা ঘরে,
হাত-ঘড়িতে তখন রাত তিনটা। বাইরে
অন্ধকার আদিম জন্তুর মতো মাথা গুঁজে জমিনে
ঘুমিয়ে আছে। অকস্মাৎ সেই জন্তু
মাথা ঝাঁকিয়ে নিজেকে প্রসারিত ক’রে
ওর দাঁত-নখে কামড়ে ধরলো ঘুমন্ত শহরকে। কেঁপে
উঠলো চেয়ার, আমার লেখার টেবিল। ভূমিকম্প ভেবে
বাইরে ছুটে গিয়ে
চেয়ারেই আটকে থাকলাম, যেন কেউ আমাকে
আঠা দিয়ে সেঁটে রেখেছে আমার চিরচেনা আসনে।
সেই মুহূর্তে, পরদিন প্রচারিত হলো লোকমুখে,-
সংবাদপত্রের পাতায়-আমার এই
জন্মশহরের ঐতিহ্যখচিত বিশ্ববিদ্যালয়ের
ছাত্রীনিবাসে রাত তিনটায় চলছিল হায়েনাদের তাণ্ডব,
নিদ্রাছুট ছাত্রীগণ পথ পাচ্ছিল না আত্মারক্ষার। আব্রু
হারানোর শঙ্কায় লুকোতে গিয়েও
ওদের অঙ্গবাসে পড়লো টান, আলুলায়িত বেণী,
খসে-পড়া খোঁপা পোশাক সজ্জিত জান্তব সন্ত্রাসে হলো লাঞ্ছিত।
সেই মুহূর্তে আশপাশের গাছপালা শাসন-না-মানা ক্রোধে
কাঁপতে কাঁপতে ছুটে যেতে চেয়েছিল
ছাত্রীনিবাসে, কিন্তু, হায়, ওদের শেকড় বন্দী কঠোর মাটিতে।
সেই মুহূর্তে শান্ত বুড়িগঙ্গা নদী ধিক্কারে ফুঁসে
উঠছিল খুব, অথচ বড় নাচার সেই জলধারা
তটে মাথা কুটেও পারলো না
ছুটে গিয়ে জালিমদের ভাসিয়ে
নিয়ে যেতে। নাগরিকগণ তখন ঘুমে অচেতন।
এ কেমন দূষিত, পচন-ধরা কালে নিঃশ্বাস নিচ্ছি? আমরা
সবাই কি ঠুঁটো জগন্নাথ হ’য়ে বসে থাকবো অষ্টপ্রহর?
আমরা কি আহারান্তে পান চিবিয়ে,
সিগারেট ফুঁকে, আড্ডায় গা ভাসিয়ে কাটিয়ে
দেবো সময়? আমরা কি ঘুমিয়ে থাকবো কালবেলায়?
আমরা কি আমাদের ভগ্নি কন্যাদের
বস্ত্রহরণ পর্বে নির্লজ্জের মতো নিষ্প্রাণ পুতুল হয়ে থাকবো?
আমরা কি তখনও ফেটে পড়বো না বিস্ফোরণে?
পাড়ায় পাড়ায় কখন কত কী-যে হারায়,
অনেকেই বোঝে না, কেউ কেউ বোঝে। তুমি কি তোমার
ভাঙা গালে হাত দিয়ে ব’সে ভাবতে থাকবে কারা কোথায়
কী লুটে নিলো, কারাই বা হলো বঞ্চিত? ভাবনারা
মৌমাছি হয়ে হুল ফোটাবে তোমার অস্তিত্বে,
তুমি ধৈর্য ধরে সইবে, সবই সইতে থাকবে
দিনের পর দিন, মাসের পর মাস। তা হবে না, চলতে দেবো না
সেই খেলা ব’লে গর্জে উঠবে তারুণ্য, আগামীর নকিব।
এই জাঁহাবাজ, দাঁত-নখ-খিচোনো অমাবস্যার
আস্ফালন আমরা কি থামাতে পারবো না?
আমরা কি পারবো না ভয়ঙ্কর কৃষ্ণপক্ষে পূর্ণিমা-চাঁদের পথ
সুগম ক’রে দিতে আমাদের
প্রতিবাদের ঝড়ে ঝেঁটিয়ে সকল বাধা? আমরা কি
পারবো না জন্ম দিতে তেমন নতুন যুগকে,
যে-কালে ছদ্মবেশী স্বৈর শাসকের হুঙ্কারে,
অঙ্গুলি হেলনে আজ্ঞাবহ বরকন্দাজদের তাণ্ডবে
ধুলোয় লুটোবে না মানবিক মূল্যবোধ, হিংস্র কাদায়
সমাহিত হবে না অগ্রসর তরুণ তরুণীর স্বপ্ন, আর্তনাদ করবে না সভ্যতা?
২৮-০৭-২০০২
এমন কুটিল অন্ধকারে
এমন কুটিল অন্ধকারে হঠাৎ কোথায় যাব?
জানোই তো রাগী শুয়োরের
মতো ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে পরিবেশ সকল সময়। তবে আমি
কোথায় খুঁজব শান্তিনিকেতন?
এখন দেখছ না কি শুধু শীতাতপ- নিয়ন্ত্রিত
নতুন মোটরকারে জ্বলজ্বলে দুপুরে ঘুরছে
মাথায় মুকুট-পরা সাঙ্যাৎ খুনীর সঙ্গে? কান
খাড়া রাখলেই গলি কিংবা রাজপথ থেকে ঠিক
নিয়ত আসছে ভেসে জালিমের হুঙ্কার এবং
অসহায় উৎপীড়িত নরনারীদের আর্তনাদ।
দুপুরেও অমাবস্যা তুখোড় মোড়ল ইদানীং। অসহায়
কুমারীর সম্ভ্রম রক্ষাই দায়; শহরে ও গ্রামে
কত যে নারীর জীবনের আলো নরপশুদের
থাবার দাপটে নিভে গেছে, কে তার হিসেব রাখে?
তবুও মানুষ ঘর বাঁধে, আসমানে নক্ষত্রের মাইফেল
বসলে দেখতে চায়। শিশুকে জড়ায় বুকে আর
কান পাতে দূর থেকে ভেসে-আসা বাউলের গান
অথবা বাঁশির সুরে, ভালবাসে দয়িতাকে ডাগর জ্যোৎস্নায়।
১১-০৬-২০০২