ইতিহাস মিথ্যার কুহক ছিঁড়ে
ভোরবেলা ঘুমছেঁড়া চোখে দেখি, এ কী
ঘোর অমাবস্যা-রাত, হায়,
আমার শহরটিকে রেখেছে গ্রেপ্তার ক’রে। তবে কি সকালে
আজ এই নিঝুম দিবসে সূর্য আর
দেখাবে না মুখ? প্রকৃতির বুক জুড়ে
মহররমের নিস্তব্ধ মাতম মাথা কোটে সর্বক্ষণ।
নেই, তিনি নেই, আর রাজধানী, শ্যামল পাড়াগাঁ,
মফস্বলে; জগতের কোথাও পাবে না
কেউ খুঁজে তাঁকে, যে পুরুষ
ছিলেন আকাশ-ছোঁয়া দীপ্ত অস্তিত্বের
অধিকারী। বাংলার কতিপয় শক্র তাঁর প্রাণ
করেছে হরণ তস্করের
ধরনের বিপথামী অস্ত্রধারী কুটিল আন্ধার। বুঝি তাই
অন্ধকার চতুর্দিকে বিষধর অজগর রূপে প্রতিষ্ঠিত!
এই যে কখনও স্বদেশের গাছপালা, নদীনালা,
পথ ঘাট, ষড়ঋতু বুক চাপড়ায়,
অশ্রুপাত করে তাঁরই জন্যে আজও, হয়তো অনেকে
বোঝে না, পায় না টের। কেউ কেউ পায়।
তিনি তো প্রশস্ত বুকে তাঁর প্রিয় বাংলাকে ধারণ
করেছেন আমৃত্যু, সেবায় তার ছিলেন সর্বদা ব্রতী, যেমন বাগান
গড়ে তোলে রোদে পুড়ে বৃষ্টি ধারায় প্রায়শ স্নাত
হয়ে নিবেদিতপ্রাণ বাগবান। তারই কী আশ্চর্য প্রতিদান
যীশুর ধরনে পেয়ে গেলে তুমি। তবে ইতিহাস
চিরকাল মিথ্যার কুহক ছিঁড়ে গাইবে সত্যের জয়গান।
০৮-০৮-২০০২
এ কি আমাদেরই দেশ?
পায়ের তলায় মাটি আজকাল বড় জাহাঁবাজ,
হিংস্র হয়ে উঠেছে, আকাশ
যখন তখন চোখ রাঙায় এবং মনে হয় এ রকম
ভয়াবহ অন্ধকার নামেনি কখনও চারদিক
লুপ্ত ক’রে রক্ত-পানি-করা হিম অর্থহীনতায় আর। মানবের,
মানবীর মুখচ্ছদ এইমতো নির্বিকার পাথর-স্বরূপ
দেখিনি কখনও আগে। হাটে, মাঠে, ঘাটে
হেঁটে যায় ওরা, যেন পুতুলের নিষ্প্রাণ মিছিল!
এ কি আমাদের দেশ, যে-দেশে একদা
জনসাধারণ শহরে ও গ্রামে শান্তির ছায়ায় বসবাস
করেছে, দেখেছে রূপের স্বপ্ন নির্বিঘ্ন নিদ্রার অপরূপ
কোমল উদ্যানে? এ কি সেই বাংলাদেশ, কণ্ঠে যার
দুলেছে গৌরবদৃপ্ত বিজয়ের মালা
মুক্তিযোদ্ধা, ত্যাগী নেতা, সাধারণ মানুষের অনন্য সাধনে।
শোণিত-সাগর থেকে জেগে-ওঠা স্বাধীনতা-পদ্মটিকে যারা
ছিঁড়ে-খুঁড়ে লাঞ্ছিত করার
খায়েশে মেতেছে ঠারে ঠোরে এমন কি
মাঝে মাঝে স্পষ্টতই, তাদের তোয়াজে মেতে থাকে
নানান পাড়ার নানা মোড়ল এখন। ফন্দি আঁটে ছদ্মবেশী
অস্ত্রাঘাতে প্রগতির তেজী ঘোড়াটিকে খোঁড়া ক’রে দেয়ার খায়েশে।
আমাদের কত না নিঝুম স্বপ্ন থেঁত্লে যাচ্ছে বুটের তলায়,
কত যে পদ্যের পঙক্তি বেঘোরে গুমরে মরে কবির খাতায়
প্রখর দুপুরে আর নিশীথের বিরান প্রহরে। শব্দমালা
কখনও করুণ ফোঁপানিতে কম্পমান, কখনও-বা নজরুলী
দুলে-ওঠা বাবরির ধরনে রাগী, আগুনের আলিঙ্গনে রাঙা।
আগুনের তাপ কমে এলে স্বদেশের বেদনার্ত মুখ ভেসে ওঠে।
যেন স্বপ্নে আমার চকিতে মনে হ’ল- দিব্যি পূর্ব ও পশ্চিম,
উত্তর দক্ষিণ, ডান-বাম সব দিকে উচ্চারিত
প্রগতির জয়বার্তা, ঐ তো ওড়ে আসমানে কল্যাণের প্রশান্ত পতাকা-
চারদিক থেকে নর-নারী,
শিশু ছুটে আসছে সবাই। দীর্ঘস্থায়ী অমাবস্যা পলাতক,
কোনও গ্রীক দেবীর মুখের মতো চাঁদ হাসে আকাশের নীলে।
০৮-১০-২০০২
এ কেমন কৃষ্ণপক্ষ
কে যেন আমাকে ডাকে আবছা দূরত্ব থেকে আজ,
চেনা কি অচেনা সেই আর্ত কণ্ঠস্বর
বোঝা দায়, সে কি হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে?
নাকি তার অন্তর্গত বেদনা ভোগাচ্ছে বড় বেশি?
অস্থিরতা আমাকে দখল করে নেয়
মোহাবিষ্ট চেয়ে থাকি দিগন্তের দিকে।
কোথায় দিগন্ত এই আকাশকে চুমো-খাওয়া সব
উচ্চাকাঙ্ক্ষী দালানের ভিড়ে? হা, কপাল,
কী ক’রে অসুস্থ দৃষ্টি দিয়ে ছোঁব
হারানো দিগন্ত-রেখা, কে আমাকে বলে দেবে আজ?
কোথাও যাওয়ার মন নেই এই গুমোট প্রহরে, বসে আছি
অন্ধকার ঘরে একা। কাকে খুঁজে বেড়াব এখন
কোন পথে? কোন আস্তানায় গেলে পেয়ে যাব ঠিক
মনের মানুষ এই প্যাঁচা-ডাকা পরিবেশে? প্রবীণ আঁধারে
হঠাৎ উদিত হল চাঁদ,
ঠোকরে ঠোকরে তাকে কাচের পাত্রের মত গুঁড়ো
করে ফেলে হিংসুটে দানব এক, মৃত্যুগন্ধী অন্ধকার নেমে
আসে যেন ত্রিভুবনে। মানবিক হাহাকারে ডোবে সবদিক।
যে কাব্য রচনা ক’রে পাণ্ডুলিপি তার
লুকিয়ে রেখেছিলাম তাণ্ডবের কালে
ভূতলে একদা, হায়, হয়েছে তা’ কীটের ডিনার।
বস্তুত নিজেরই সৃষ্টি আজ স্মরণের অন্ধকার
কুঠুরির কালো ধুলোকণা।
এ কেমন কৃষ্ণপক্ষ করেছে ঘেরাও আমাদের
ইদানীং? কেউ কাউকেই আর পাচ্ছে না দেখতে,
ঘুরছি বিপথে শুধু নিঃসঙ্গ, অসুস্থ অস্তিত্বের
ভার বয়ে; যতদূর দৃষ্টি যায়, মানবের চিহ্ন নেই কোনও,
উপরন্তু এখানে সেখানে ফাঁদ পাতা আছে-
এই তথ্য জেনেও ফায়দা নেই, আজ
আমাকে যেতেই হবে বেলাবেলি যতটা এগিয়ে যাওয়া চলে।
এখনও কখনও পুরনো শ্যাওলায় বন্দী হয় মানবতা,
কখনও বা বেনোজলে ক্রমাগত ভেসে যেতে থাকে।
১০-০৪-২০০২
এই ডামাডোল, এই হট্রগোল
না, আমি মিনারবাসী নই কস্মিনকালেও, তবু
এই ডামাডোল, হট্রগোল, এই ঝগড়া ফ্যাসাদে
বড় বেশি বীতশ্রদ্ধ হয়ে
ঘন ঘন চুল ছিঁড়ি উত্তপ্ত মাথার।
কখনও কখনও ভারি ইচ্ছে হয় এই জমিনের
ধুলোবালি থেকে দূরে, বহুদূরে
উড়ে যাই। না, কোনও বিমানে
চেপে কিংবা ট্রেনের টিকিট কেটে নয়,
দূরগামী পাখির মতই মেঘ চিরে,
আকাশের নীলে উড়ে উড়ে, নক্ষত্র-পল্লীর খুব
কাছাকাছি চলে গিয়ে জমাই জম্পেশ আড্ডা আর
চুমো খাই চাঁদের অধরে।
আমি তো যেতেই পারি উড়ে বহুদূরে অন্বিষ্ট কোথাও;
আমার ঘরের কোণে অপরূপ দুটি ডানা আছে,
এক্ষুণি দেখাচ্ছি ব’লে গৃহকোণে যাই। হা কপাল,
কোথায় গায়েব হল ওরা? কোন্ সে রহস্যপুরী,
কোন্ সে কবন্ধ আস্তানায়,
হায়, লুপ্ত হল অনুপম ডানা দু’টি?
পাখা মেলে আর
মেঘে মেঘে দূরে
অনেক অনেক
দূরে পারব না
কোনও দিন যেতে
তারার মেলায়।
খেদ নেই, পারব তো হেঁটে হেঁটে যেতে বাংলার
পাড়াগাঁর, শহরের ঢের ঢের লুণ্ঠিত জনের
এবং ধর্ষিতা মা-বোনের খুব কাছে
দাঁড়াতে, জ্বালাতে দীপ ঘন অন্ধকারে।
ভাসমান মেঘ আর নক্ষত্রের রূপালি আসর,
চাঁদের বাসর থাক মানবের কাছ থেকে দূরে
অনেক অনেক দূরে। নাইবা গেলাম
সেখানে কখনও, এই আমি এখানেই
স্বদেশের সোঁদা মাটি আর
ঘাসের সুঘ্রাণ নিয়ে থাকি যেন আমরণ প্রিয় স্বদেশেই।
২৯-০৩-২০০২