শহুরে বাউল হাঁটে
না, আমি ইঁদুর-দৌড়ে শরিক হবো না, কারো কোনো
প্ররোচনা কিংবা ছলাকলা
পারবে না আমাকে নামাতে সেই হুড়োহুড়ি, সেই পড়ি-মরি
নির্লজ্জ খেলায়। হেঁটে যাবো
একান্ত নির্জন প্রতিযোগীহীন পথে। ভোলা মন যা চাইবে
যখন, করবো সেই কাজ মহানন্দে তখন-কখনো
বটের ছায়ার বসে দেখবো পাখির
কোমল প্রণয়লীলা, কখনো-বা ভাসমান দেঘ।
না, আমি ইঁদুর-দৌড়ে নেই। যে উদাস
বাউলের ডেরা
অন্তরে আমার, সে আমাকে একতারা
বাজিয়ে শোনাবে গীতিমালা, দেবে তুলে
আমার ইচ্ছুক হাতে অরূপ ছিলিম, চতুর্দিকে
চকিতে উঠবে নেচে আরশি নগর। কে আমার
মনের মানুষ ব’লে খোলা পথে হেঁটে যাবো একা,
ব্যাকুল ডাকবো তারে, পাবো না উত্তর। একতারা
বেজে চলে পথের ধুলোয় আর গাছের পাতায়, মেঘলোকে;
শহুরে বাউল হাঁটে একাকী নিজের পথে, যেতে হবে হেঁটে।
সত্যি, কোথাও যাওয়ার নেই
সত্যি কি জীবিত আমি? এই যে শ্যামলী পাড়াটির এক কোণে
একটি বাড়ির ছোট ঘরে প্রায়শই বসে থাকি,
ওল্টাই বইয়ের পাতা, তাকাই বাইরে, দেখি কাছের গাছের
পাতার চাঞ্চল্য মাঝে মাঝে, বাথরুমে মুখ ধুই, প্লেট পেতে
আহারাদি সেরে নিই, এখনও ঘুমিয়ে পড়ি, খাতার সফেদ
পাতাদের দিকে চেয়ে থাকি,-একি সত্যি?
কেটে গেল কতদিন, মাস আর কত না বছর
যেন এক লহমায়-এভাবেই যায়,
যেমন ভোরের আলো সন্ধ্যার আন্ধারে মিশে যায়।
বাসায় বেঁধেছি ডেরা, কাটিয়েছি কত ষড়ঋতু
আনন্দে, বিষাদে আর জীবনের নানা বাঁকে প্রিয়
বন্ধু আর বান্ধবীর মুখোমুখি হয়েছি চকিতে
ভাগ্যগুণে বহুবার। বুদ্ধিজীবী বন্ধুর ড্রইংরুমে দেশী কি বিদেশী
সাহিত্য-কেন্দ্রিক আলোচনা কিংবা ঘরোয়া আলাপে
কেটে গেছে কত না বিকেল আর কত মধ্যরাত আর নানা
প্রহর কেটেছে প্রেমিকার আলিঙ্গনে
চুম্বনের স্বর্গীর স্বাদের আভা নিয়ে-সত্যি কি এসব?
স্বদেশে, বিদেশে করে বসবাস ঘনিষ্ঠ স্বজন অনেকেই;
আমার নিকেট থাকে জীবনসঙ্গিনী, পুত্র, পুত্রবধূ আর
নয়নের মণি দুই পৌত্রী নয়না, দীপিতা। অকস্মাৎ
কখন যে চলে যাবো, নিশ্চিত বিলীন হবো মহাশূন্যতায়
শুধু ক’জনের স্মৃতিরূপে রয়ে যাবো, স্মৃতি বিলীন হয়
বিস্মৃতির অন্ধকারে। আমার পার্থিব বাড়িঘর, ব্যক্তিগত
গ্রন্থাগার, স্বরচিত পুস্তকাদি-ধুলো হবে সবই জনমের
আগে আর মরণের পরে শুধু শুধু
অস্তিত্বহীনতা, এ জগতে বটে এসেছিলাম একদা, অবশেষে
বস্তুত নিশ্চিহ্ন হওয়া ছাড়া সত্যি কোথাও যাওয়া নেই।
১৫-০৮-২০০২
সন্ত্রাসে বড় জর্জরিত
ছিলেন আটক তিনি এলোমেলো ভাবনার হিম কুয়াশায়;
উপমা, উৎপ্রেক্ষা কিংবা স্রেফ শাদাসিধা
বর্ণনার অবয়ব-এসব কিছুই নয়। মেঘদল থেকে
ভেসে-আসা নিঃসঙ্গ, রহস্যময় বলছে তাকেই
‘কবি, তুমি কলম টেবিলে রেখে নিষ্ক্রিয় থাকবে কতকাল?
তোমার চোখে কি পড়ছে না
পুঞ্জ পুঞ্জ হিংস্র অন্ধকার
গিলে খাচ্ছে তোমার আপনকার শহর ও গ্রাম?
‘কিব, তুমি আর কতদিন, বল, থাকবে এমন উদাসীন
এই অবিরাম তাজা রক্তঝরা, আর্তনাদময়
দিনগুলি, রাতগুলি, হানাদার ছোরা
আর বুলেটের তাণ্ডবের ক্রূর ঝড়ে?
‘কবি, তুমি শোনোনি কি ভাসমান মেঘদলে ধর্ষিতা, গ্লানির
কাঁটায় ভীষণ জর্জরিত আত্মঘাতী মহিমার
ম্লান মুখ ঝরায় নালিশ এই নিষ্ক্রিয়, বেজায়
মূক সমাজের দিকে? শোননি কি তুমি?
‘কবি, তোমার কি জানা নেই পুলিশী সন্ত্রাসে বড় জর্জরিত
প্রগতি ও কল্যাণের পথে অগ্রসর, প্রতিবাদী সেই
তরুণের অস্ত্রাঘাত-চিহ্নিত, নিষ্প্রাণ
শরীরের ভেসে-ওঠা জলাশয়ে, মা’র চোখে বান?’
কালো রাত প্রত্যুষে রূপান্তরিত হওয়া সঙ্গেই সেই মেঘবাসী
প্রশ্নকর্তা হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। কবি যেন ঘোর
দুঃস্বপ্নের অরণ্য পেরিয়ে জেগে ওঠেন এবং
ফেলে-রাখা কলমটি প্রবল আবেগে তুলে নেন।
০১-০৬-২০০২
সুদূরের অনন্য প্রবাসী
শহীদ, বলো তো বন্ধু সেই সব দুপুর, গোধূলিবেলা আর
সন্ধ্যারাত, মধ্যরাত মার্কিন মুলুকে
ঢেউ হয়ে স্মৃতিতটে আছড়ে পড়ে কি
কখনও সখনও? বলো, পাতাল ট্রেনের কামরায়
তন্দ্রাচ্ছন্ন মুহূর্তে চকিতে জেগে ওঠো নাকি বিউটি বোর্ডিং
আর লক্ষ্মীবাজারের ঘ্রাণে?
যখন বস্টনে ঘন কুয়াশার কাফন জড়ানো সন্ধেবেলা
কাঙ্ক্ষিত আড্ডায় মেতে ওঠ কিংবা তুষারের আলিঙ্গন ছিঁড়ে
দীর্ঘক্ষণ কর্মস্থলে ডুবে থাকো, তখন কি আচানক
মনে পড়ে যায়, হায়, কোনও কোনও মৃত, অর্ধমৃত
ঢাকাবাসী বান্ধবের মুখ? কখনও মনে কি পড়ে
বুদ্ধদের বসুর কবিতাভবনের স্পর্শময়
‘কবিতা’-পত্রের জন্যে অধীর প্রতীক্ষা আমাদের? তখন কি
তোমাকে দখল করে অতীতের স্মৃতি-কাতরতা?
শহীদ, যখন তুমি হিম-রাতে বন্ধ দরজা জানালা, উষ্ণ
কামরার চারদিক নীরবে আবৃত্তি করো আর
কোনও কবিতার বই খুলে আঙুলের
ফাঁকে ধূমায়িত সিগারেট কোমল বুলিয়ে পাঠ
করো কোনও বিদেশি কবির তাজা কবিতা, তখন
তোমার পড়ে কি মনে সুকুমার, জাহাঙ্গীর, তাহের অথবা
বুড়ো কিংবা আখতার, খালেদ চৌধুরী
ফিল্মপ্রিয় দীর্ঘকায় বাচ্চু, সঞ্জীব, সৈয়দ হক, কায়সুল
আর এই সত্তর-পেরুনো অতিশয় ধূসর আমার কথা?
হে প্রিয় বান্ধব, বলো, মনে পড়ে নাকি?
কী আশ্চর্য, শহীদ তুমিও, হ্যাঁ, তুমিও
জ্বল জ্বলে একদা-কিশোর,
এ-ও সম্ভব ষাটে থরথর? যায় উচ্ছলতা,
ঔজ্জ্বল্য কী দ্রুত ক্ষয়ে ফিকে হয়ে যায়, হাহাকার
জেগে রয়; শুধু কি যৌবন অস্তাচলে
মিশে যায়? সৌহার্দের, সখ্যের গোধূলি লুপ্ত হয়
দীর্ঘশ্বাসে। কাদা থেকে উঠে-আসা অতিকায় জন্তুর জঠরে
যাচ্ছে চলে বাগান, পূর্ণিমা-চাঁদ, বাংলার মানব মানবী!
শহীদ, হে প্রিয় বন্ধু আমার, তুমি কি ফিরে এসে
ভূমিধসে অসহায়, দুঃস্বপ্ন-তাড়িত ভাঙাচোরা
মানুষের ভিড়ে মিশে অন্ত্রাঘাত মাটি-চাপা পড়ে
কোনও এক অজ্ঞাত কবির শোকগাথা হতে চাও? আপাতত
সুদূরের অনন্য প্রবাসী তুমি আর
এই অবসন্ন আমি শক্রময় নিজ বাসভূমে পরবাসী।
২৪-০৭-২০০২