মহাকাশে ধ্বনিত বাংলার জয়গান
চারদিক থেকে ধুলোর বৃষ্টি; দু’হাতে মুখ ঢেকেও
দৃষ্টি খোলা রাখতে ব্যর্থতা পোহাচ্ছি। ব্যর্থতা যেন
গোর খোদকের মত নৈপুণ্যে চাপ চাপ ধুলোর কবর
তৈরি ক’রে আমাকে ঢুকিয়ে দিচ্ছে ভেতরে। দম বন্ধ
হয়ে আসছে আমার। কঙ্কালেরা ঘিরে ধরেছে তাণ্ডবে,
হাল ছেড়ে মুখ ঢেকে পড়ে থাকি, করি মুর্দার অভিনয়।
হন্তারকের বিকট উল্লাস ধ্বনিত, প্রতিধ্বনিত এখানে
সেখানে; স্বেচ্ছা নির্বাসনে যাওয়া উচিত ছিল, অথচ
যেতে পারি না এই চেনা প্রকৃতির কোমল রূপ, মাটির
মাতৃসুলভ মমতা ছেড়ে। এই শহরের শ্বাস-প্রশ্বাস আমাকে
বাদ্যের মত বাজায়, নদীর ঢেউয়ের মত দোলায়। দুলতে
দুলতে স্নেহার্দ্রে চোখে তাকাই চন্দ্রমল্লিকা, রজনীগন্ধার দিকে।
আমার বাঁচার আনন্দে ঝাঁপিয়ে পড়ে হিংস্র ধু্লোর
ঝাপটা, শোকবার্তা অনবরত কালো করতে থাকে শহর
আর গ্রামকে। ফরসা রোদের জন্য প্রতীক্ষায় ক্লান্ত হই,
অথচ অমাবস্যা নিজস্ব প্রতাপের প্রদর্শনী কায়েম
রেখেছে আলোর গর্দান ধরে বহুদূরে ঠেলে দিয়ে। ভীত
আমি কখনও সখনও মাথা ঝাঁকিয়ে হয়ে উঠি প্রতিবাদী।
ধুলোর সন্ত্রাসে অচেতন আবর্জনা স্তূপের নীচে করুণ
সমাহিত-প্রায় আমি প্রগাঢ় জ্বলজ্বলে এক কণ্ঠস্বরের
স্পর্শে, কে যেন বলছেন, ‘জেগে ওঠো কবি মায়াবী ঘুমের
জাল ছিঁড়ে, দ্যাখো চেয়ে কী প্রতীক্ষা করছে তোমাকে
অভিবাদন জানাবার আকাঙ্ক্ষায়। দেখি, অদূরে
নদীতীরে একটি সোনার তরী দুলছে ঢেউয়ে ঢেউয়ে
এবং মাস্তুলে-গাঁথা পতাকা অপরূপ নর্তকীর মত
নৃত্যপর আর মহাকাশে ধ্বনিত বাংলার জয়গান।
০৮-০৪-২০০২
মহেঞ্জোদড়োর কণ্ঠস্বর
মহেঞ্জোদড়োর আসমান ফিসফিসে কণ্ঠস্বর কথা বলে
একালের উৎপীড়িত আকাশের কানে কানে
গোধূলিবেলায়। জঙ্গী বিমানের জাঁহাবাজ আওয়াজে কানের
পর্দা ফেটে যেতে চায় আর্ত আকাশের।
মহেঞ্জোদড়োর আসমান অতীতের প্রিয় কিছু
কথা ও কাহিনী বলে নীলিমার কানে কানে, ‘শোনো,
কী প্রভাতে, কী-বা দ্বিপ্রহরে অথবা নিশীথে মেঘ-প্রেয়সীর
ঠোঁটে কত এঁকেছি চুম্বন
নির্বিঘ্নে, করেছি আলিঙ্গন দ্বিধাহীন। এখন তো
যন্ত্রপাখি কান ঝালাপালা করে, ছিঁড়ে ফেলে বুক
মেঘেদের, ক্ষণে ক্ষণে ভেঙে যায় মিলনবাসর,
কত যে সাধের, হায়, এনগেজ্মেন্ট।‘
মহেঞ্জোদড়োর সুপ্রাচীন আসমান ক্লান্ত স্বরে
তরুণী মেঘের কানে কানে বলে, ‘যখন নীচের
দুনিয়ার দিকে এই বুড়োটে দু’চোখ মেলে দেখি
নানা দেশে বেশ কিছু মানুষের কাণ্ড-কারখানা
পাড়ায় পাড়ায় খুনখারাবির খেল, পথেঘাটে
আদম সন্তানদের মানুষ পুড়িয়ে
মারার আ-মরি মহোৎসব, বনবাদাড়ের হিংস্র
পশুদের বড় বেশি সভ্য মনে হয়। ওগো মেঘমালা, শোনো,
আমার দু’চোখ বুজে আসছে, এই তো
এক্ষুণি আমাকে শূন্যে লীন হতে হবে।‘
১৯-০২-২০০২
রোদ আর জ্যোৎস্নাধারা কাঁদে
কেন এই ভোরবেলা দু’চোখে আমার
বস্তুত কিছুই ধরা পড়ছে না? কিছুকাল ধরে
দৃষ্টি ঘুণে-ধরা সত্য, তবু
অন্ধ তো হইনি আজও, তবে কেন ঘোর
অমাবস্যা এমন পাথুরে
পর্দা আজ ঝুলিয়ে দিয়েছে
চারদিকে? এখন কোথায় কোন দিকে
আন্দাজে বাড়াব দু’টি হাত, চালাব পা
ঠিকঠাক বিভ্রমের ঘাড় মট্কে দিয়ে?
কোন্ গান জোগাবে প্রেরণা সুন্দরের হাত ধরে যেতে?
তীরে তরী প্রতীক্ষাপ্রবণ, কিন্তু গায়েব যে-মাঝি,
কোথায় খুঁজব তাকে? আমাকে যে পাড়ি দিতে হবে মহানদী
সূর্যাস্তের আগে, ঘুমাঙ্কিত সুরে ঢুলে
নদীর ভেতর থেকে কে ডাকে আমাকে?
সেই সুরে সুপ্রাচীন শ্যাওলার রঙ,
বিলুপ্ত মাছের ঘ্রাণ ভাসমান-এ কেমন ঘোর
আমাকে রয়েছে ঘিরে অবেলায়? তরঙ্গে তরঙ্গে
অবিরাম ওঠে নামে এ কার কঙ্কাল?
এই খেয়া নায়ের মাঝির নাকি? তবে
কী ক’রে পেরুব মহানদী এখন কে দেবে বলে?
দেব কি তরঙ্গে ঝাঁপ? সাঁতার শিখিনি, ঝাঁপ দিলে
সলিল সমাধি সুনিশ্চিত; আমার করুণ লাশ
মহোল্লাসে ছিঁড়ে খাবে মাছের মিছিল
এবং কঙ্কাল হয়ে ভাসব নদীতে। জানবে না
কেউ সন্ধ্যাবাতি জ্বলে উঠবার আগে
নদীতীরে ছিলাম প্রতীক্ষারত একা।
মুহূর্তেই স্থানান্তর, পৌঁছে যাই ছাদহীন ভাঙা দেয়ালের
নড়বড়ে ঘরময় এলাকায় মৃত অনেকেই, জীবিতরা অর্ধমৃত,
মূক ও বধির আর সর্বত্র গোঙানি, সারাদিন
রোদ আর সারারাত জ্যোৎস্নাধারা কাঁদে, শুধু কাঁদে।
১৯-০৩-২০০২
শহীদ মিনারকে ওরা গ্রেপ্তার করেছে
দাগী অপরাধী ঠাউরে নিয়ে
শহীদ মিনারকে ওরা গ্রেপ্তার করেছে, গোঁয়ার
শেকলে বেঁধেছে কোমর বজ্র-আঁটুনিতে,
আক্রোশে পরিয়েছে হাতকড়া।
যেখানে এখন রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুল গীতি, বাউলগুরু
লালনের গান নয়, নয় প্রতিবাদী কবিকণ্ঠে
উচ্চারিত পঙ্ক্তিমালা, তেজী বক্তাদের
আগুন-ঝরানো ভাষণ, শান্তির বাণী।
এখন দিনরাত শহীদ মিনার ঘিরে ধ্বনিত
অগণিত বুটের কর্কশ আওয়াজ। শহীদ মিনারে
শত শত স্রোতার মিলন-মেলা নয়, বসেছে হুকুম বরদার
রাইফেলের বৈঠক। শহীদ মিনারে আজ ফুলের স্তবক
প্রগতি, কল্যাণ আর আশাবাদের পতাকা নেই; সেখান
এখন চোখ-রাঙানো উদ্ধত উর্দির ধমক।
হায়, এ কেমন কাল এলো জন্মভূমিতে আমার,
যখন নন্দিত ভাষা-সৈনিক,
কবি, কথাশিল্পী, প্রাবন্ধিক,
চিত্রকর, সঙ্গীতশিল্পী-সবাই অবাঞ্ছিত
শহীদ মিনারের পবিত্র প্রাঙ্গণে! তবে কি
বায়ান্নোর ভাষা শহীদের আত্মা,
নিরস্ত্র অগণিত জীবিত মানুষ
প্রতিবাদে গর্জে উঠবে না ফের?
২৪-০৯-২০০২