ভরদুপুরেই অমাবস্যা
আকাশটা যেন ভাঙা বাসনের মতো
এক্ষুণি পড়বে ঝরে আমাদের ভয়ার্ত মাথায়-এ রকম
আশঙ্কায় কাটছে সময় অনেকের। মস্তিকের
ভেতরে বৃশ্চিক কখন যে ফের করবে দংশন
আচানক, বলতে পারি না। স্বস্তি নেই, শান্তি নেই
একরত্তি; আমি সদা সহবাসী যাদের, তাদের
জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চোখ রাখতে পারি না কিছুতেই, যেন এই
প্রিয়জনদের সঙ্গে কানামাছি খেলে যাচ্ছি যখন তখন।
পায়ের তলার মাটি কাঁপছে ভীষণ, দিকে দিকে
ঘরবাড়ি রূপান্তরে ভগ্নস্তুপ, অসহায় মাতম ধ্বনিত
পাড়ায় পাড়ায়, কত সংসার উজাড় হলো চোখের পলকে
এই কালবেলায় কাদের, কে আমাকে ব’লে দেবে? ‘মানবের,
মানবীর’, বলে গেল আতঙ্কিত পাখিদের উড্ডীন মিছিল,
দিগন্তের ছায়ায় জন্মন্ধ শিল্পী হয়ে যায় বেদনার্ত সুর।
দূর দিগন্তের সুরে আমার লেখনী নিমেষেই
টেবিলে স্পন্দিত হয়, গভীর সঙ্কেতে ডাকে কাছে মিলনের
আকাঙ্ক্ষায় চেনা ক’টি আঙুলের সঙ্গে। জানি না কী কথা তার
মনে মেঘ হয়ে জমে আছে,
আমার চৌদিকে শুধু বহু বিঘা পোড়ো জমি আর
ওদের হৃদয়-চেরা বিলাপের বিষণ্ন ফসল জেগে ওঠে!
মাটিতে একটি মৃত কাকের চৌদিকে উড়ে উড়ে কাছে এসে
কয়েকটি কাক প্রতিবাদী শোক করছে পালন,
লক্ষ করি আমার জানালা থেকে। অথচ নগরে
ও পল্লীতে আজকাল কী সহজে রোজ
সোল্লাসে মানুষ চুরি করে নেয় প্রাণ মানুষের
প্রতিদিন দেশপ্রেমিকেরা নিগৃহীত, নিপীড়নে
জর্জরিত। এখন তো আসমানে
চাঁদ বড় বিষণ্ন এবং চুর্ণ হতে চায় প্রতিবাদে।
দেখছি স্বচক্ষে আজ মহত্ত্ব বিচূর্ণি, পদদলিত নিয়ত
এই ভ্রষ্ট, নষ্ট কালে ন্যাঙটো রোশনিতে। এই মতো ভরদুপুরেই ঢের ঢের আগে, জানি,
অকস্মাৎ নেমেছিল ঘোর অমাবস্যা, তবু নানা যুগ করে
স্তব, গায় জয়গাথা কালজয়ী মহাপুরুষের।
০২-০৪-২০০২
ভাঙাচোরা চাঁদ মুখ কালো করে ধুঁকছে
মাথার ভেতর এক ঝাঁক ছোট পাখি
বেশ কিছু দিন থেকে কিচিরমিচির করে চলেছে হামেশা;
শুধু রাত্রিবেলা গাঢ় ঘুমে হয়তো-বা
নিঝুম নিশ্চুপ থাকে,-অনুমান করি। এভাবেই অস্বস্তিতে
কাটছে জীবন। কে আমাকে বলে দেবে
হায়, এই উপদ্রুত মাথায় ঝিঁঝির একটানা
ধ্বনি কবে হবে শেষ। আজ এটা, কাল সেটা আছে তো লেগেই
যেমন কৌতুকপ্রিয় বালকেরা বেড়ালের লেজে
ভারি ঘণ্টা বেঁধে দেয়। অকস্মাৎ চোখে পড়ে দূরে
ভাঙাচোরা চাঁদ মুখ কালো ক’রে ধুঁকছে ভীষণ, যেন এই
মুহূর্তেই মৃত্তিকায় খসে পড়ে যাবে। অকস্মাৎ
অকারণ কার স্মৃতি প্রস্ফুটিত হৃদয়ে বিধ্বস্ত বাগানে?
কোনও কোনও দিন একা ছোট ঘরে এক কোণে ব’সে
গোধূলি-বেলায় দরবেশী মন নিয়ে কেবলি ভাবতে থাকি,-
আকাশ পাতাল এক হয়ে যায়, কখন যে
নিজেকে দেখতে পাই ভ্রাম্যমাণ নিঃসঙ্গ পথিক, হেঁটে হেঁটে
পেরিয়ে চলেছি মাঠ, নদীতীর, উপত্যকা, উজাড় নগর, কখনও-বা
যত্রতত্র কঙ্কালের ঢিবি চোখে পড়ে। কবেকার এইসব
মূক গল্পময় ঢিবি, প্রশ্ন ছুড়ে দিই স্তব্ধ, দূর
আকাশের দিকে আর ধিক্কারে রক্তাক্ত করি নিজের স্মৃতিকে!
হাঁটতে হাঁটতে ধ্যানী আমি থেমে যাই। কী আশ্চর্য, চোখে পড়ে
কবেকার সুদূরের দাস-নেতা স্পার্টাকাস তার উৎপীড়িত
অথচ সুদৃঢ় সেনাদের চাবুকের
প্রহার-লাঞ্ছিত শরীরের গৌরবপ্রদীপ্ত অরুণিমা নিয়ে
দাঁড়ালেন আমার সম্মুখে, দীপ্তকণ্ঠে শোনলেন আশ্বাসের শুভবাণী;
আমি তার পৌরুষের অনন্য কান্তিতে প্রজ্বলিত
হতেই গেলেন মিশে নক্ষত্রের অনাদি জগতে। পিপাসায়
ভীষণ শুকিয়ে আসে জিভ, শিশিরের প্রত্যাশায় শূন্যে দৃষ্টি মেলি।
আচমকা মনে হয়, বিভ্রম আমাকে শুধু অর্থহীনতার
ধোঁয়াশায় টেনে নিচ্ছে, নিরুত্তর জিজ্ঞাসার হামলায়
রক্তাক্ত, বিহ্বলবোধ, অসহায় আমি
ফ্যাল ফ্যাল চেয়ে থাকি পানীয়ের ফতুর গেলাশে অন্তহীন।
কে আমাকে বলে দেবে গলাভর্তি অত্যাচারী বালি
আর কাঁটা থেকে মুক্তি পাওয়ার কসরৎ ঘোর অবেলায়?
এক্ষুণি শিখিয়ে দেবে কোন্ জাদুবলে? চারদিক
থেকে ধেয়ে আসছে শ্বাপদ ছিঁড়ে খেতে আমাকে মেটাতে ক্ষুধা।
এখন সহজে কেউ করে না বিশ্বাস কাউকেই। প্রত্যেকের
দুটি চোখ সন্দেহের ধূম্রজালে আচ্ছন্ন এবং
সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময় মনে জাগে আশঙ্কা, হয়তো কেউ
অকস্মাৎ ঠেলে ফেলে দেবে বিশ হাত নিচে। সে মুহূর্তে
অন্য কারও অন্তরাত্মা ঘেমে ঘেমে কাদাময় হয়
বুলেটের বৃষ্টির আচ্ছন্নতায় ডুবে বিলুপ্তির হিম ভয়ে।
মরুর বালি
কেউ কি এসে কবির এমন ক্ষয়া জীবন-গোধূলিতে
গান গেয়ে আজ পুঁতবে খুঁটি কবির প্রাণের খোলা ভিতে।
কৃষ্ণপক্ষে আজকে যাদের জীবন কাটে স্মৃতি নিয়ে,
কে-বা চাইবে সুখী হ’তে স্মৃতির জালটি ছিঁড়ে দিয়ে?
ক’দিন ধ’রে মুষড়ে আছি একলা নিজের ছোট ঘরে,
ভুগছি আমি, কাঁপছি এবং পুড়ছি বেজায় কালো জ্বরে!
কেউ কি আমায় বলতে পারো শান্তি কোথায় পাবো কিছু?
কোথায় যেতে হবে না আর ক’রে আমার মাথা নিচু?
যেদিন থেকে ভাবি না আর তোমার মুখের হাসি, কথা
মনের গুহায় গুমরে মরে অনেক কথা, রাঙা ব্যথা।
হয় না বলা সেসব কথা কারো কাছেই ডেকে ডুকে,
তোমার কথা স্মৃতির পাতায় নিয়েছিলাম সুখে টুকে।
পরে যেদি আমায় হেসে প্রশ্ন করো, ‘গ্যাছো ভুলে?’
নীরব থেকে দৃষ্টি দেবো হরিণ-চোখে, কালো চুলে।
জানি আমি অনেক কথাই বলার জন্যে বলি শুধু,
হৃদয় জুড়ে অনেক সময় মরুর বালি করে ধুধু।
০৭-১১-২০০২