প্রত্যাশার প্রহর
আমার চাতক-মন সেই কবে থেকে প্রত্যাশার
প্রহর কাটায় ধ্যানে, মাঝে মাঝে তার
কী খেয়াল হয়, টেলিফোন রিসিভার তুলে
বলে যায় এলেবেলে কথা,
যদিও ওপারে কেউ নেই শ্রবণের প্রতীক্ষায়। এই খেলা
কেন যে মাতিয়ে তোলে আমাকে প্রায়শ-এ বাধ্যতা।
আমি কি প্রকৃত কোনও শুভ সংবাদের
আশায় নিজের সঙ্গে কৃষ্ণকায় এই বর্তমানে
ক্রীড়াপরায়ণ হয়ে উঠেছি এমন? মাঝে মাঝে
শুনছি কলিংবেল, ছুটে যাই হন্তদন্ত হয়ে। দরজাটা
খুলে দাঁড়ালেই স্রেফ খাঁখাঁ শূন্যতার
দেখা পেয়ে কিছুক্ষণ খুব স্তব্ধ হয়ে থাকি।
সন্ত্রাসের ধ্বনি ভেসে আসে প্রতিদিন, চতুর্দিক
থেকে বাড়িঘর, ধুলো, মাটি, গাছগাছালি এবং
ল্যাম্পেস্ট, ওভারব্রিজ বমি করে হাহাকার আর
অমাবস্যা-রাতে অগণিত মৃতদেহ
মাথা নত করে হেঁটে যায়
কে জানে কোথায়! পথে বিকট গহ্বর!
এই অন্ধকার, এই হাহাকার থেকে, হায়, নেই কি নাজাত
আমাদের? কতবার টেলিফোন তুলে
কেবল নিজের সঙ্গে অভিনয় করে যাব? এভাবেই
আপন সত্তার সঙ্গে অভিনয় করে যাব আর কতকাল?
আমি চাই পথে আজ প্রাণবন্ত সব মানুষের
আসা-যাওয়া, গাছে গাছে কোকিলের সুরের মহিমা।
২১-০৫-২০০২
প্রত্যাশার বাইরেই ছিল
প্রত্যাশার বাইরেই ছিল ব্যাপারটি। রোজকার
মতোই টেবিল ঘেঁষে পুরোনো চেয়ারে
আরামে ছিলাম বসে, ঘড়িতে তখন
সকাল আটটা ফ্যাল ফ্যাল ক’রে তাকিয়ে রয়েছে।
আমি কি না-লেখা কোনও কবিতার পঙ্ক্তি মনে-মনে
সৃজনে ছিলাম মগ্ন? একটি কি দুটি শব্দ হয়তো-বা ভেসে
উঠছিল আমার মানস-হ্রদে। আচমকা
চোখে পড়ে ঘরে একটি প্রজাপতির চঞ্চলতা।
বেশ কিছুকাল থেকে কৃষ্ণপক্ষ দিব্যি গিলে রেখেছে আমার,
আমাদের বসতিকে। আলো জ্বালাবার
প্রয়াস নিমেষে ব্যর্থ হয় জাহাঁবাজ
তিমিরবিলাসী ক্রূর হাওয়ার সন্ত্রাসে নিত্যদিন। তবুও তো
একজন রঙিন অতিথি ঘরটিকে দান করে অকৃপণ
সোন্দর্যের আভা, মুগ্ধ চোখে দেখি তাকে। মনে হয়,
একটি কবিতা যেন ওড়াউড়ি করছে এ-ঘরে,
অথচ দিচ্ছে না ধরা আমার একান্ত করতলে, যার ধ্যানে
দীর্ঘকাল মগ্ন ছিল কবিচিত্ত সম্ভবত অবচেতনায়
আধো জাগরণে কিংবা ঘুমের আংশিক এলাকায়।
২৩-০৮-২০০২
বিষাদের সঙ্গে সারাদিন সারারাত
বিষাদের সঙ্গে কাটিয়েছি সারাদিন সারারাত, ভোরবেলা
চায়ের পেয়ালা হাতে নিয়ে দেখি, এ কী
কেমন নাছোড় বিষণ্নতা ভাসমান, কখন যে
চুমুকে চুমুকে সেই বিষণ্ন পানীয়
আমার নাচার জিভে ছেয়ে গেল আর আমি
নিজের কাছেই যেন কেমন বেগানা হয়ে যাই।
বুঝতে পারে কি কেউ কীভাবে ভেতরে তার কোন্
রিপু তাকে হিঁচড়াতে হিঁচড়াতে নিয়ে
যায় সর্বনাশের কন্দরে? এই আমি অসহায়
চেয়ে চেয়ে দেখছি যাপিত জীবনের পাতাগুলি
কী দ্রুত গাছকে ন্যাড়া ক’রে ঝরে গেছে, এই আমি
অচিরেই হয়ে যাব কীট পতঙ্গের উৎসবের উপাদান।
হাহাকার তাড়া করে নিয়ত আমাকে আজকাল;
কারা যেন, বস্তুত কঙ্কালসার কতিপয় বুড়ো, ভয়ঙ্কর
ভঙ্গিমায় এগোয় আমার দিকে, তিমির-ছড়ানো
ছমছমে শ্মশানের কালো ছায়া আমার মানসে
ভীষণ দুলতে থাকে, পা দু’টো কে যেন
মাটিতে দিয়েছে পুঁতে, হায়, হয়ে গেছি স্বরহারা।
কিছুক্ষণ কেটে গেলে নিজেকে দেখতে পাই রক্তখেকো কিছু
অর্ধপশু অর্ধ-মানবের জটলায়। ওদের বীভৎস চোখ
ক্ষণে ক্ষণে করছে বমন নরকের অগ্নি-ঢ্যালা;-
পুড়ে যাচ্ছি, ছুটে যেতে চাই অন্য দিকে, অন্য কোনও
সুস্নিগ্ধ অভয়াশ্রমে, যেখানে দুঃস্বপ্ন নেই, নেই অর্ধপশু
অর্ধ-মানবের পৈশাচিক স্বৈরাচার, বন্য আইনের হাঁক।
শ্মশানের ছাই উড়ে এসে জুড়ে বসেছে শহরে আমাদের,
বেয়াড়া অস্ত্রের ঝলসানি বারবার
নিরীহ চোখের জ্যোতি নেভানোর শপথ নিয়েছে
যেন, মাস্তানের জোট শ্রেয়বোধ তাড়ানোর,
কল্যাণের দীপ নেভানোর প্রতিযোগিতায় মেতে
উঠেছে বেদম আর শুভবাদী চেতনা হিংসার পদতলে পিষ্ট, ক্লিষ্ট।
সময় কি ফুরিয়ে এসেছে সত্যি? আমি কি এমন ভ্রষ্ট, নষ্ট
সমাজের বাসিন্দা হয়েই বাকি সময়ের ধ্বনি
শুনে যাবো? ধুধু গোরস্তানের স্তব্ধতা সারাক্ষণ
বয়ে যাবো? প্রায়শই মধ্যরাতে ছেঁড়া ছেঁড়া ঘুম
থেকে কেঁপে জেগে উঠে বোবা হয়ে থাকবো কেবল? তখন কি
ত্বরিত পড়বে মনে একদা দুপুরে-শোনা কোকিলের গান?
০১-১১-২০০২
বড় দীর্ঘ সময়
পথ শক্ত অথচ মসৃণ ছিল অনেকটা, হেঁটে
যেতে যেতে যেতে অকস্মাৎ
পা দু’টি কাদায় ডুবে যায়। মনে হল সম্ভবত
ডুবে যাব আপাদমস্তক। দম বন্ধ হয়ে এল
প্রায়, কোনও মতে মাথা উঁচু রেখে শ্বাস নিতে থাকি,
সজোরে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে পড়ি।
আবার নতুন ছাঁদে পথ চলা সম্মুখে কায়েম
রাখি, আরও কতদূর যেতে হবে, কোন্ বিপদের
মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কা
ওঁৎ পেতে আছে,
কে আমাকে বলে দেবে এই কৃষ্ণপক্ষে? পদযুগ
বিগড়ানো, মাথার উপর ঘোরে খাপছাড়া পাখি।
পাখিটা কি অশুভ সঙ্কেত কোনও? নাকি
ভীষণ বেয়াড়া মাংসভুক? অতিশয়
ক্লান্তি দুটি চোখ বুজলেই
অতিপয় অচেনা চেহারা
ভয়ঙ্কর বিকৃত আদলে দেখা দেয় বার বার,
কেড়ে নেয় স্বস্তি; দৃষ্টি জ্বেলে নিই ফের।
‘শোনও পথচারী, এখানেই এই বিয়াবানে যাত্রা
থামিও না, ওঠো, মুছে ফেলে ক্লান্তির কুয়াশা
যত পারও জোর কদমে এগোও’,-মেঘমালা
চিরে যেন কার কণ্ঠস্বর ভেসে আসে। গোধূলির
রঙ মুছে যাওয়ার আগেই
ত্বরিত কদমে হাঁটি স্বপ্নাদ্য স্বর্ণিল আস্তানার অভিমুখে।
১২-০৩-২০০২