ভাটিয়ালি সুর হয়ে বেজে ওঠে
ও আমার রঙিলা নায়ের মাঝি, গহীন গাঙের ভাটিয়ালি
সুরপ্রিয় মাঝে, নাও বাইয়া কোথায় যাও? কোন্ সে গাঁয়ের
ঘাটে তুমি ভেড়াবে সাধের নাও? ওরে
গাড়িয়াল ভাই, রাঙাধুলি গায়ে নিয়ে যাবে তুমি
দুলা আর দুল্হিন নিয়ে কোন্ ঠিকানায়? হায়, আমি এই
খোলা পথে দাঁড়িয়ে রয়েছি বড় একা, আমাকেও সঙ্গে নাও।
ও আমার রঙিলা নায়ের মাঝি, তোমার গানের
শিল্পীকে খুঁজছ তুমি কোথায় এখন? গোধূলিতে কান পেতে
আছো যে সুরের জন্যে, তাঁর অপরূপ
প্রতিধ্বনি গুঞ্জরিত পদ্মা আর মেঘনার ঢেউয়ে ঢেউয়ে,
উত্তরবঙ্গের লাল মাটির অন্তরে। অতীতের দিনগুলি,
রাতগুলি মঞ্জরিত মৃত্যুঞ্জয় গায়কের সুরের নির্ঝরে।
ওহে গাড়িয়াল ভাই, যার গানের মোহন সুরে
দুলত গাড়ির চাকা, যুগল গরুর
পথ চলা, তাঁর
সুরের মায়ায় মুগ্ধ আজও নদীনালা, বাঁশবন,
প্রান্তর, পাহাড় আর শহরতলি
শান্তিনিকেতন আর রাজধানীর সুরম্য বহুতল বাড়ি।
কার গীত, কার সুর এমন সর্বত্রগামী, কে সেই মহান
প্রামীণ সুরসাধক? কার সুরের ছোঁয়ায় জেগে ওঠে আজও
সঙ্গীতপিপাসু প্রাণ? কার সুরে ধূলি-ধূসর পথের ধারে
নিমেষেই ফোটে ফুল, হৃদয় ব্যাকুল হয় দূর
দিগন্তের না-দেখা দৃশ্যের জন্যে, কে তিনি? কে তিনি? ভাটিয়ালী
সুর হয়ে বেজে ওঠে তাঁর নাম-আব্বাসউদ্দীন তিনি আব্বাসউদ্দীন।
মেরীর পুত্র
এরা তোমার অবসন্ন মেষপাল।
প্রত্যূষ এলে
রাত্রি ওদের ছুঁড়ে দেয় মাটির বুকে,
ওরা তাড়িত হয় ওদের নিত্যকার গেরস্থালির
টুকিটাকি কাজে
বাজারে, দপ্তরে, ফ্যাক্টরিতে,
যেখানে ওরা কাজ করে।
চলার পথে ওরা জিরোতে পারে না-
এমনকি আহত হ’লেও ওরা থামতে পারে না,
তুমি কি-ই বা প্রত্যাশা করতে পারো ওদের কাছে?
নেকড়েরা এখন মিশে যায় মেষপালের সঙ্গে।
তুমি তাকিয়ে আছো এই পথের দিকে;
এখানে সমাহিত অগণিত কাহিনী,
অনেক মানুষের হারানো যৌবন,
একই পথে হেঁটে যায়।
ধনী আর নির্ধন।
প্রায়শ আমি অবাক হয়ে ভাবি কার জন্যে
অপেক্ষা করছ তুমি!
এই আমাকে দ্যাখোঃ
আমি সে-জন
যে ছিল শৃঙ্খলিত তার ক্ষেতে
এবং ছিল সেই ক্ষেতেরই অঙ্গ।
যখন দুর্দশায় বেচে দেয়া হলো জমিন;
বিকিয়ে গেলাম আমিও
যেন আমি কিছুই নই। শুধুমাত্র আগুনের জ্বালানি।
এই আমাকে দ্যাখোঃ
আমি সে-জন
মেশিনের মালিকরা এখন আমাকে
ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে ওদের চাকার ভেতর।
আমাকে দ্যাখোঃ
আমি ক্লান্ত আর দিশেহারা,
শতাব্দীর পর শতাব্দীর ধরে ভবঘুরে আমি
তুমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছো,
সেই বেদীমূল থেকে যদি সরে যাও, তাহলে
এখানে আমি ঘুমোতে পারি।
দোহাই ঈশ্বরের এখান থেকে চলে যাও তুমি,
চলে যাও ভিয়েতনামের সেইসব জঙ্গলে,
সেইসব বিধ্বস্ত শহরে,
জখমি গ্রামগুলিতে-
যেগুলি ওরা, যারা পাঠ করে তোমার ধর্মগ্রন্থ,
পায়ে মাড়িয়ে, দাউ-দাউ আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে।
যুগ-যুগ ধরে ওরা ডাকছে তোমাকে।
যাও আমাদের জন্যে আরও একবার তুমি যাও,
আবার এফোঁড়-ওফোঁড় বিদ্ধ হও গে ক্রশকাঠে।
(উর্দু কবি কাইফি আজমরি কবিতার অনুবাদ)
মৎসসমাজের কথা
জল তো ছিলই সুপ্রচুর, টলটলে, ঝলমলে
নদীটির দু’কুল-ছাপানো। তরঙ্গের
খেলা ছিল, ছিলাম সাঁতারপ্রিয় প্রায়শই, এখনও রয়েছি
কখনও কখনও ডুব দিয়েছি গভীরে
দুর্লভের খোঁজে, মৎস আমি ছোট বড় মাছের বাহার ছিল
চারপাশে আমি সঙ্গী ছিলাম ওদের।
মাঝে মাঝে ডুব-সাঁতার করেছে
ধন্য পূর্বসূরীদের মতো। আরো
কেউ কেউ সফলতা পেয়েছে এবং মৎসদের
সমাজে উল্লাসধ্বনি তরঙ্গে
উঠেছে তুমুল বেজে। হায়, কেউ নেই আজ,
কেউ কেউ স্থবিরতা নেয় মেনে, মজে আলস্যের মিহি স্তবে!
নিয়ত আমার ডুবসাঁতারের কালে দেখি কত
নিষ্প্রাণ, বেরঙ মাছ ভাসে আশেপাশে,
এক ঝাঁক নির্বুদ্ধিতা-কবলিত মাছ অতিশয়
ফরফরে; আকারে যদিও ক্ষুদে, হামেশা ভড়ং
বিশালের, ফাঁপা ওরা। মরা, পচা, ভাসমান মাছের দুর্গন্ধে
এবং ক্ষুদ্রের ধামালিতে টেকা দায়। ফলত গভীরে
ডুব দিয়ে সত্য, সুন্দরের, কল্যাণের
সাধনাই শ্রেয় ভাবি; ওপরে বাজুক ডঙ্কা ক্ষুদের, ফাঁপার।
যতদূর যেতে হয় যাব
পড়ে আছি নিঃসঙ্গ এখানে এই ধূ ধূ বিরানায়
কী জানি কখন থেকে, কবে থেকে। ঠিক মতো
চোখ খুলতেও অপারগ; কিছু কিছু
ধোঁয়াশার মতো প্রতিভাত আর অনেক কিছুই
বিলুপ্ত বেখাপ্পা অন্ধকারে। কয়েকটি বিটকেল মাছি খুব
বিরক্ত করছে, তাড়াবার ইচ্ছা মৃতপ্রায়। কী যেন পড়ল।
অদূরে, অদ্ভুত শব্দ যেন ভেসে আসে; পারব কি ফের উঠে
দাঁড়াতে গা ঝাড়া দিয়ে আর এই জনহীনতায়?
যদিও এখানে হিংস্র তিমির দাপট
দেখিয়ে চলেছে পুরোদমে, যদিও জ্যোৎস্নার প্রলম্বিত চুমো
মিলবে না শিগ্গির, যদিও কোনও পাখি
মুক্তকণ্ঠে গাইবে না গান, তবু পড়িমরি করে
হলেও আমাকে উঠি দাঁড়াতে হবে, পেতে হবে
আরাধ্য পথের দিশা; পারব তো গন্তব্যে পৌঁছুতে?
হেঁটে যেতে হবে বহুদূর প্রতারক সব পথপ্রদর্শকদের
ভ্রমচক্র ভেদ করে। একটি সোনালি পাখি বেদনার্ত গান
গেয়ে গেয়ে নিয়ে যাবে, মনে হয়, পোড়া বাস্তুভিটার কঙ্কাল
দেখাতে লুণ্ঠিত পাড়াগাঁর, ধর্ষিত নারীর
অমাবস্যাময় মুখ! আমি কি পারব আলো জ্বালাতে আবার
সেই সব মুখে? পারব কী কাঠগড়ায় করাতে দাঁড়
মানুষের ভেকধারী পশুদের? পারব কি ফুল ফোটাতে আবার বিরান বাগানে? যাব,
যতদূর যেতে হয় যাব।