নেহারের জন্যে
নেহার, ছোট্র বোন আমার, বহুকাল পর
তোকে আবার মনে পড়ল। মনে পড়ল, তুই
আমার পেন্সিল আর কলম নিয়ে
মেতে উঠতি খেলায়। আমার খাতার পাতা
কী সব এঁকে ভরিয়ে তুলতি। জানি না তোর সেই
আঁকিবুকি অনেক পরে আমার খাতায়
পদ্যের পঙ্ক্তিমালা সাজানোর প্রেরণা জোগাত কিনা।
নেহার, তোর অমন সৌন্দর্য-ছড়ানো মুখটি
ফুল হয়ে ফোটার আগেই একটি কলিকে সংহার
করল মৃত্যু বড় আক্রোশে। তোকে ছিনিয়ে
নেয়া হলো আমার সান্নিধ্য থেকে।
আজ একটি উঁচু দরের পুরস্কার পাওয়ার সময়
বারবার তোর কথা মনে পড়ছিল আমার।
খেলায় মগ্ন হতি, সেই কমলেই আমি প্রথম
লিখতে শুরু করি তোর চলে যাওয়ার কথা। আমার
কেন জানি মনে হয় নেহার, তোর হাতের স্পর্শময়
কলম দিয়েই সবসময় কবিতা লিখছি। সেই কলম
আমার ওপর ভর করে, দেয় প্রবল ঝাঁকুনি।
রাত্রি আর প্রত্যুষের মিলন-মুহূর্তে যেন তোর
মধুর কণ্ঠস্বর ভেসে এল, ‘শোনো ভাইয়া, তুমি যে
এত বছর পরেও আমাকে মনে রেখেছ, এ আমার
মস্ত পাওয়া। জানো ভাইয়া, তুমি যখন আশ্চর্য-সুন্দর
কবিতার একটি পঙ্ক্তি রচনা করো, তখন আমি
সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে আলো ছড়াই। তোমার একটি
নতুন উপমা আমাকে হাওয়া বানিয়ে তোমার গালে
চুমো দিতে পাঠায়। তুমি যখন কোনও ব্যর্থ পঙ্ক্তি
লেখো, তখন আমার অশ্রু শিশিরবিন্দু হয়ে ঝরে
পোড়ো জমিতে। লিখে যাও ভাইয়া, আমাদের
সিএ কলমকে বিসর্জন দিও না কোনওদিন।
পারেনি খুবলে খেতে সৌন্দর্যকে
এইতো কিছুদিন ধরে কী-যে হয়েছে আমার, পাড়ার
না, না, শুধু পাড়ার নয়, প্রিয় এই শহরের সব একতলা, দোতলা
বাড়ি, দশতলা, এগারো তলা ফ্ল্যাট মুখ থুবড়ে
পড়েছে এখানে-সেখানে। অগণিত ধ্বংসস্তূপ
এবং বৃক্ষবিরল এই শহরের প্রতিটি গাছ
ভীষণ ক্রুদ্ধ কঙ্কাল যেন। নিজেকেই কেমন
অদ্ভত খাপছাড়া মনে হয়, যেন আমি সুদূর
কোনও শতাব্দী থেকে আচমকা এসে পড়েছি এখানে।
পুড়ে যাচ্ছে কেশরপ্রায় আমার চুল, পুড়ছে ভীষণ
আমার চোখ, মুখ, সারা শরীর
পুড়ছে, পায়ের তলার ন্যাংটো জমিন
আগুন-ঝরানো দগদগে ঘায়ের মতো তামা। পুড়ে যাচ্ছি,
আবার সেই সুদূর হাজার শতাব্দী আগের এক দুপুরে
অগ্নিবৃষ্টিতে ভস্মে রূপান্তরিত হয়েছিলাম যেমন। দৃষ্টি
থেকে মুছে গেছে দু’ দেশের সীমানায় অস্ত্রের ধমক, গায়েব
জাতিসংঘের নানা জাতির ভাষণ, ক্ষুদে দেশের বিলাপ।
এইতো নতুন শতাব্দীর শুরুতেই দেখছি আধপোড়া আমার
দিকে আবার তেড়ে আসছে ডাইনোসর, এক্ষুণি
গিলে ফেলবে আমাকে। আমি কি ছুটে যেতে পারবো
কোনও নিরাপদ গুহায়? দেখতে পাবো কি সেখানে কোনও
কোমল আলিঙ্গনের মোহিনী মুদ্রা? এইতো পায়ের তলায়
মৃত্তিকা কম্পমান, অদূরে পর্বত মুহুর্মুহু উগরে দিচ্ছে
আগুন; ফাঁক-হয়ে-যাওয়া জমিন গিলে ফেলছে
অগণন নর-নারীকে। প্রলয়ের কী উন্মত্ত নাচন!
ছুটছি আমি, ছুটছি প্রাণপণে নতুন মৃত্যুর দাঁত-নখের
সন্ত্রাস এড়ানোর আশায়। ছুটছি ছুটছি ভীষণ একা,
নিঃশ্বাস দ্রুত ফুরিয়ে আসছে, তবুও ছুটছি ছুটব। হঠাৎ দেখি,
কাছেই ভস্মস্তূপে কী তাজ্জব, তিনটি গোলাপ দুলছে
হাওয়ার চুমোয়, হাসছে নির্মল
অথচ রহস্যময় হাসি। জন্মান্ধ তাণ্ডবের
উৎকট চিৎকার, অপ্রতিরোধ্য ঝোড়ো ঝাপ্টা পারেনি
সেই হাসি মুছে ফেলতে, পারেনি খুবলে খেতে সৌন্দর্যকে।
প্রাত্যহিক
পটল বেগুন আলু আর ঝিঙা আর ফুলকপি
দেখছি
বরফকাতর বড় মাছ মাংস পেঁয়াজ মরিচ
দেখছি
মোটা মিহি কণ্ঠস্বর ক্রেতার কাকের
গুনছি
মাঝ মাসে মাইনের শেষ ক’টি টাকা
গুনছি
গোধূলিবেলায় ক্লান্ত চোখে
ঝিমুনি
আর রাতে স্তব্ধতার অমাবস্যা তাঁবু
খাটায়
বিপন্ন বিশ্বে নতুন সভ্যতার জন্যে
এমন মনেই হয়, হতে থাকে-দূর থেকে এক যেন আমাকে
ডাকছে ব্যাকুল। কে ডাকবে এই ঘোর অবেলায়
দিগন্ত ঝাঁকিয়ে খুব? একরত্তি শব্দ নেই, তবু
অস্তিত্ব-কাঁপানো কিছু শব্দহীন প্রবল গর্জন
আমাকে ভয়ার্ত করে, ঠেলে দেয় তীক্ষ্ম দাঁত-নখ অধ্যুষিত
অরণ্যের দিকে।
তা হ’লে কী করি, বলো? চোখ, কান বন্ধ করে নিজস্ব বালিশে
মুখ গুঁজে গৃহকোণে থাকব কি পড়ে
হতাশাপীড়িত বিষপান করে মানুষের মতো? অকস্মাৎ
গেস্টাপোর ধরনে আমার দরজায় যদি কেউ
কড়া নাড়ে জোরে কিংবা বাজায় কলিংবেল, তবে
কি করব, কেউ কি আমাকে যে করেই হোক বলে
দেবে ঠারেঠোরো? স্বস্তি শান্তি নেই সেই কবে থেকে
ঘরের ভেতর কাগজের খস্ খস্ শুনে কারও পায়ের অশুভ শব্দ ভেবে
কেঁপে উঠি
শীতার্ত পাতার মতো। গলা জুড়ে বালির সন্ত্রাস।
ভোরবেলা কারা এসে ঘরে ঢুকে পড়ে; চোখ দু’টি
কচলাতে কচলাতে দেখি,-কয়েকটি রুক্ষ পশু
মানুষের কণ্ঠস্বরে বলে, ‘এক্ষুণি বেরিয়ে যাও
এই ঘর ছেড়ে,
এখানে থাকার অধিকার বাজেয়াপ্ত হয়ে গেছে,
তুমি বনবাদাড়ে আস্তানা খুঁজে নাও।
বিভ্রান্ত, নির্বাক আমি চেয়ে থাকি হাবার ধরনে, ভয়ঙ্কর
ভূমিকম্প ভীষণ দুলিয়ে
এবং ঘুলিয়ে দেয় সবকিছু; তাসের ঘরের
মতো ধসে পড়ে চতুর্দিকে, ‘গীতবিতান’ এবং
গালিবের গজল নিমেষে মুছে যায়
থাবার আক্রোশে, সবখানে অশ্লীল চিৎকার আর
আমি নিজে ডুবে যাচ্ছি অতল বিষ্ঠায়। মনে হয়,
যুগযুগান্তর কাটে অথবা নিশ্চল সবকিছু।
এমন মনেই হয়, হতে থাকে আজকাল। তবু মাঝে মাঝে
একটি কি দু’টি পাখি রেলিঙে নিশ্চিন্ত বসে দোল
খেতে-খেতে আমাকে শুনিয়ে যায় গান। কী আশ্চর্য,
জানি না কোত্থেকে ভেসে আসে বাঁশির অমর্ত্য সুর
অন্তর্লোকে। চতুর্দিকে অনাচার, ভ্রষ্টাচার, হিংসার ফোঁসানি;
হায়, কবে আসবে বিপন্ন বিশ্বে নতুন সভ্যতা?