দুই প্রান্ত
সে ট্রাউজারের খোলা খোলা যমজ পকেটে হাত পুরে
চকচকে মোকাসিন পায়ে হেঁটে যাচ্ছে দিব্যি শিস
দিয়ে প্রিয় আজিজ সুপার মার্কেটের দিকে। সূর্য ঘুমে ঢলে পড়ে।
(বয়স্ক জনক সে যুবার লাঙলে জমিন চষে ঘর্মাক্ত শরীরে আর
জননী জাঙলে খোঁজে উনুন তাতানো সরঞ্জাম।)
সে যুবা নিশ্চিত শাহবাগ ভালোবেসে, এক তার
অপরূপ ঝুলন্ত উদ্যান মনে হয়, কখনও সুদূর অতীতের কোনও
ঝলমলে কাঙ্ক্ষিত সরাইখানা ঢের ভ্রমণের পর। এই
বইয়ের দোকানপাট, ফটোগ্রাফ, রেকর্ড ক্যাসেট ইত্যাদি
জনপ্রিয় পসরা সাজিয়ে বসা সব আয়োজন
যুবকের চেতনায় বস্তুত আরব্য রজনীর
রূপ-রহস্যের ঘ্রাণ নিয়ে আসে কখনও সখনও।
(যুবকের পিতা প্রতিদিন সাত-সকালে ঘুমের
বাজারে গরুর দুধ বিক্রি করে পুত্রের খরচ
চালাতে শহরে। ছেলেটির শিক্ষার আলোয় স্লাত
করবার সাধনায় নিরক্ষর জনক এবং জননীর
নিরস্তর কী প্রাণান্তকর ধীর নীরব সংগ্রাম।)
সে যুবক ল্যাম্পপোস্টে আয়েশে হেলান দিয়ে দ্যাখে
পূর্ণিমা চাঁদকে দ্রুত চেটে-পুটে খাচ্ছে অতিকায়
বুভুক্ষু বেবুন। যুবা যায় কবিদের উতরোল
আড্ডায় এবং দিশি মদের বস্তিতে
ক্রমশ নরক গুলজার। রাত গাঢ় হলে যুবা
নির্বিঘ্ন পল্লীতে গিয়ে বেছে নেবে যে-কোনও রঙিন তরুণীকে।
(তখন গেরামে তার শ্রমশ্রান্ত জনক জননী সন্তানের
ব্যয়বহনের ভাবময় নিষ্প্রদীপ ঘরে ঘুমে ঢলে পড়ে।)
দূর্মর আকাঙ্ক্ষা
আমি তো আপনকার ডেরা থেকে দূরে, বহুদূরে,
শতশত ক্রোশ দূরে চলে
এসেছি তখন এই সমুদ্র কিনারে,
যেখানে তরঙ্গগুলি প্রবল ঝাঁপিয়ে পড়ে আর্মির ধরনে-
যে সমুদ্রতীরে মাইকেল মধূসূদন একদা রেখেছেন পদযুগ
ধূসর অতীতে, মনে পড়ে। আমি আজ অবেলায়
এলাম অসুস্থ দু’চোখের নিরাময় আশা করে। তারাহারা
আকাশ কি একেবারে বাতিল কাগজ? অবান্তর, মূল্যহীন?
আমিই তো বলেছি সেদিন,
‘শিশুকে রেখো না দূরে, কাছে টেনে নাও’,
অথচ আমারই কাণ্ড দ্যাখো, বড় প্রিয়
দু’টি শিশুকেই বড় দূরে ফেলে রেখে
এসেছি এখানে, বসে আমি একা, আমাকে জড়িয়ে
রয়েছে বিষণ্ন নীরবতা।
কাঁকড়ার মতো ভয় কী হিংস্র দখল করে নেয়,-
যদি দৃষ্টি নিভে যায় একেবারে, যদি কাউকেই
দেখতে না পাই আর, যদি
আখেরে না ফিরে যেতে পারি আপন ডেরায় তবে
কী হবে? কী হবে? দৃষ্টি ফিরে পাই আর না-ই পাই,
নিজের ডেরায় গিয়ে শিশুদের বুকে নিতে চাই।
ধীমান কিষান
দুপুরে পাড়াগাঁর শোকার্ত উঠোনে একজন জননীর
লাশ আর প্রতিহত, রুদ্ধ ক্যামেরার নূর রসায়ন
মাতৃহারা যুবকের অন্তর্গত গহনে আবার
জন্ম দেয় আরেক সন্তান-একই শরীরে দু’জন বসবাস
করে ক্রমান্বয়ে একজন হতে থাকে। জেনে যায়,
বহু বাধা নিশ্চিত ডিঙোতে হবে ঝরিয়ে বিস্তর স্বেদকণা।
দূর পাড়াগাঁর মাটি চিরে ফসল ফলায় আর
গ্রন্থাগারে নানা গ্রন্থ থেকে সু-প্রচুর বীজ করে আহরণ,
প্রত্যহ মনের জমি চষে সত্যের সন্ধানে মাতে
অবিচল ধীমান কিষান আর বাঁধার দেয়াল
তাসের ঘরের মতো ঝরে যায়; অমাবস্যা রূপান্তরে
কখনও চাঁদের আলো, কখনও রোদ্দুর।
কখনও দেখিনি তাকে, তবু মনে হয়, সে সন্ধানী
আলোকিত পুরুষ আমার
আত্মার আত্মীয়; আজ এই সর্বগ্রসী
সঙ্কটে দেখছি একজন যাচ্ছে হেঁটে লামচরি
গাঁয়ের বিজন পথে নদীর তীরে, হাটে-মাঠে, নগরে-বন্দরে
সেই ঋদ্ধ হিংস্র অন্ধকার গুহায় হানছে
ক্রমাগত আলোর কুঠার, হেনে যাবে বহুকাল। তাকে আজ
স্যালিউট করে গুণী, মানসিক খরায় পীড়িত নরনারী।
নিঃসঙ্গ খনন
প্রগাঢ় নিঃসঙ্গতায় সময়কে বয়ে যেতে দেয় বহুক্ষণ
লোকটা গাছের নিচে। দেখছে না নীল
ঘাসের কুসুম, ভাসমান মেঘমালা, পাখির উড়াল, শুধু
নিজের ভেতরে সুগভীর
তাকিয়ে রয়েছে, দ্যাখে একজন লোক অবিরাম
খুঁড়ছে অন্তর তার। মাঝে মাঝে অন্তর্গত
কাজল মৃত্তিকাখণ্ড করছে পরখ দূরে
সুতীক্ষ্ম অভিনিবেশে শেষে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিতে।
খুঁড়ছে, খুঁড়ছে নিজেকেই অন্বিষ্ট হীরকখণ্ড সুনিশ্চিত
করতলগত করে নিতে; সময়ের জাল তাকে
ঘিরে ধরে, নিরুপায় খোদক কেবলি
খননে ভীষণ মেতে থাকে। চোখে তার
ক্লান্তির কুয়াশা জমে, হিম
ঘুমের চাদরে সমাচ্ছন্ন নিঃসঙ্গ খননকারী, কী নিথর
শরীর, মগজ আর নিস্তব্ধ হৃদয়। কিয়দ্দূরে
অনন্যা হীরকখণ্ড হাসে শুধু কৌতুকমিশ্রিত হাসি।
নিত্য বেশি টানে
আজকাল কেন যে এমন হয় প্রায়
আমার অজ্ঞাতে, বোঝা দায়। জন্ম এই শহরেই,
তবু মনে পড়ে ঘন ঘন প্রজাপতিময় ক্ষেত,
একটি পুকুর, ভেজা ঘাট, বাঁশবাগানের গাঢ়
ঘোমটার ফাঁকে লাজনম্র রূপসী বধূর মুখ-
মণ্ডলের মতো চাঁদ, প্রবীণ চাচার
মধুর আজান দাদাজানের বানানো মসজিদে
নিবিড় দাঁড়িয়ে আর কোনও পথিকের চলে যাওয়া
পুকুরের পাড় ঘেঁষে। শহরে আমার ছোট ঘরে
পাড়াতলী গেরামের স্মৃতিজাগানিয়া বংশীধ্বনি ভেসে আসে।
মনে পড়ে, খুব বেশি মনে পড়ে মেঘনাতীরের
পাড়াতলী, তবু বছরের পর বছর যাই না সেই গাঁয়।
আমার এ জন্মশহর ঢাকা আর পিতা,
পিতামহদের রৌদ্র-জ্যোৎস্না-ছায়াময়, আজও বিদ্যুৎবিহীন
প্রগাঢ় রহস্যছাওয়া পাড়াগাঁর দোটানায় বাঁচি। ইদানীং
পাড়াতলী পুরানো স্মৃতির মতো নিত্য বেশি টানে।
নীরব অতিথি
নিজের অসুস্থ শরীরটাকে কোনও মতে বিছানা থেকে
সরিয়ে নিয়ে রাখলাম টেবিল-ঘেঁসা চেয়ারে।
টেবিলে গচ্ছিত খাতা আর কলম
তাকাল আমার দিকে। ওদের চোখে জিজ্ঞাসা,-‘ক’দিন
কেন পাইনি তোমার হাতের স্পর্শ? কেন তুমি নিশ্চুপ?’
কলমটিকে হাতে নিয়ে
খেলায় মেতে উঠি। না, শব্দরচনার খেলা নয়, ওকে
স্পর্শের সামান্য উষ্ণতা দেওয়াই আমার উদ্দেশ্য। কলমের
অভিমান ঝুলেই থাকে ওর মুখমণ্ডলে, খাতা
নিশ্চুপ, শীতল লাশের মতো শুয়ে থাকে এক পাশে।
হঠাৎ একটি ফুটন্ত গোলাপ নর্তকীর ধরনে নাচের মুদ্রা
রচনা করে আমার কানে রাঙা ঠোঁটে
ছুঁইয়ে বলে, ‘কবি, তুমি আমার সঙ্গিনী হারাবার বেদনাকে
প্রস্ফুটিত করো তোমার খাতায়। পাখির কথা ফুরোতেই
একটি ছুটে-আসা নক্ষত্রের রুপালি বায়না
ঝলসে ওঠে, ‘কবি, তুমি আমার স্পন্দিত সৌন্দর্যকে
দীর্ঘজীবী করো তোমার সৃষ্টিতে।
প্রত্যেকের উক্তি আমাকে আন্দোলিত করে, আমি
দুলতে থাকি গোলাপের আনন্দিত নৃত্যের আভায়,
হলদে পাখির বিষণ্নতার ছায়ায়, নক্ষত্রের
সৌন্দর্যের স্পন্দনে! ওদের স্বপ্ন, সাধ
প্রবল আলোড়িত করে আমাকে। জানালার বাইরে
তাকিয়ে আসমানের অপরূপ নগ্নতায়
মিশে যেতে যেতে গোলাপের উচ্ছ্বসিত যৌবন, হলদে পাখির
বিষণ্নতা, নক্ষত্রের স্পন্দিত রূপ আমাকে
অতিশয় চঞ্চল করে। মনে হয়, এই মুহূর্তে
ওদের নিয়ে পৌঁছে যাব কবিতার কাঙ্ক্ষিত ঘাটে।
কে আমার দরজায় এসে দাঁড়ায়? একজন কঙ্কালসার
প্রৌঢ়, পরনে যার ছোঁড়া পিরাণ, ক্ষুধা-জ্বলজ্বলে
দু’টো চোখ, ভয়ানক ক্লিষ্ট অনাহারে,
নিশ্চুপ, অপেক্ষা-কাতর। অসুস্থ আমি
চেয়ার ছেড়ে মানিব্যাগ খুঁজি। দশ টাকার একটি নোট
বের করেই দেখি, সেই নীরব অতিথি উধাও।
তৎক্ষণাৎ কবিতার খাতা টেনে নিয়ে লিখতে
শুরু করি দ্রুত ভূতগ্রস্ততায়। গোলাপ, পাখি, নক্ষত্র
হারিয়ে যায় কোথায়, শুধু নেই হঠাৎ গায়েব-হয়ে যাওয়া
কঙ্কালসার অতিথির উপস্থিতি রূপায়িত খাতার পাতায়।