তবুও বাঁচতে চাই
ক’বছর কেটে গেছে, পথের নিস্পৃহ ধুলোকণা
ছোঁয়য় না আমার পদযুগ। আমার শুভর্থীগণ
খোলাপথে হেঁটে যেতে করেন বারণ বারবার।
কেননা তাদের মতে, বহুরূপী বিপদের ঝুঁকি
ফাঁদ পেতে আছে
আমার উদ্দেশে চারদিকে। ধাবমান মোটরের
গুহা থেকে রাইফেল অথবা কুঠার
কিংবা আচমকা কোনও পথচারীর ভীষণ চকচকে
ছোরা বড় বেশি রক্তপায়ী হয়ে উঠবে আমার
কোনও নীলনকশার নির্দেশে
তাহ’লে কি মেঘে মেঘে হাঁটব একাকী? সন্ধ্যারাতে
উঠব আড্ডায় মেতে অতিদূর নক্ষত্রপাড়ায়
মধ্যবিত্ত জীবন রক্ষার অসম্ভব তাড়নায়? কিন্তু এই
বিপন্ন মানুষ আমি কীভাবে থাকব প্রিয়জন
আর এই শিশুদের ছেড়ে যাদের কাঙ্ক্ষিত সান্নিধ্যের স্নিগ্ধ
তাপ নিত্য করি উপভোগ? খাঁটি বন্ধুদের মুখ
দেখতে পাব না, বুদ্ধিদীপ্ত কথা শ্রুতির বাইরে
থাকবে সর্বদা, ভাবাটাই মুশকিল। এখানেই
এই হট্রাগোলে, এই হাঙ্গামায়, প্রিয়জনদের
ভালোবাসা, আন্তরিকতার অপরূপ সুঘ্রাণে বাঁচতে চাই।
তেজি পতাকা
কেন যে বার বার হোঁচট খাচ্ছি, যাচ্ছি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে
ভুল পথে? কেন আমার সকল স্বপ্ন
দুঃস্বপ্ন হয়ে যায়? আনন্দের কলি ফুল হওয়ার আগেই ঝরে যায়
ধুলোয়, ঝরার মুহূর্তে ভুল হয়ে
কীটদলকে আমন্ত্রণ জানায়। পাথরে
ঠোকর খেতে খেতে দু’পা ভীষণ জখমি। মরা জ্যোৎস্নায়
রক্ত বিন্দুগুলো নক্ষত্র হওয়ার ভড়ং-এ মশগুল, আমি
রক্তপিপাসু মাকড়সার জালে আটকে পড়ে থাকি।
ইচ্ছে হয় এক ঝটকায় হিংস্র জাল ছিঁড়ে
বেরিয়ে আসি খোলা হাওয়ায়, সতেজ সবুজে
আঁজলা ভরে পান করে ঝর্ণাধারা মেটাই তৃষ্ণা,
ধুয়ে ফেলি সকল ক্ষত, ভোরের তাজা আলোয়
রূপান্তরিত হই নব্য মানবে। যার হাত পাহাড়
টলিয়ে জর্জরিত জমিনে ফলাবে ফসল এবং
হতাশায় নুয়ে পড়া, ঘুমে বিহ্বল পথিকদের জাগিয়ে তুলবে।
অথচ আমার সময় বড় কম। উপহাস, ধিক্কার, চরম ঘৃণা
আমার উদ্যামের অঙ্করটিকে ছিঁড়ে ডাস্টবিনে
ছুঁড়ে দেয় ক্ষুধার্ত কুকুরের খাদ্য হওয়ার জন্যে! আমার
ব্যাকুল আবেদন, আমার স্বপ্নের মহিমার কথা,
যুগবদলের ব্যাকুলতা আগ্রাহ্য থেকে যায় অনেকের কাছে;
আমার স্বপ্ন ছেঁড়া ন্যাকড়ার মতো মুখ থুবড়ে
পড়ে থাকে ধুলোয়। চকিতে ক্লান্ত চোখে পড়ে, তিনজন
আগ্রহী কিশোর আমার স্বপ্ন কুড়িয়ে নিয়ে তেজি পতাকা বানায়।
তোমরা পালিয়ে যাবে?
পালাবে? পালিয়ে যাবে? আখেরে পালিয়ে যেতে চাও?
ভাবছো কি না পালিয়ে রক্ত রক্ষা নেই আর
নিজ বাসভূমে? হায়, এই
ঘরদোর, নিকানো উঠোন, স্নিগ্ধ বাগানের শোভা,
দোলনা, পুকুর-ঘাট এবং শিশিরভেজা ঘাস
আর বাঁশবাগানের মাথার ওপর চাঁদ ফেলে
কোথায় পালাবে তুমি? জানি আতঙ্কের ডামাডোলে
দড়ি ভেবে সাপের দিকেই তুমি বাড়াবে কম্পিত দু’টি হাত।
কী করে ভাবছ তুমি, তোমরা করছ ভুল এই
ভিটেমাটি ছেড়ে অজানার দিকে ছুটে গিয়ে? আমি
নিজেই বিশদ জেনে গিয়েছি এখন বিষধর
সাপ কিছু কিছু মানুষের চেয়ে ঢের বেশি নিরাপদ। সাপও
অনর্থক দেয় না ছোবল কাউকেই,
অথচ হিংসার বল্গাহীন
খেলায় হেলায় মেতে ওঠে মানুষের তক্মা-আঁটা
জীবগুলো। বলো শ্যাম, বলো অনিমেষ,
তোমরা পালিয়ে যাবে? আমার মিনতি শোনা, তোমরা যেও না,
এখনই দাঁড়াও রুখে দলে দলে। ধনধান্যে পুষ্পে ভরা এই
দেশ তোমাদের। চেয়ে দ্যাখো, এইসব গাছপালা,
নদি-নালা, পথঘাট শুভবাদী তোমাদের উপস্থিতি চায়।
দিগন্তের অন্তরালে
বড় ম্লান বেশ দেখে আমার মুকুন্দরাম হেসে
বললেন, ‘শোনো হে, নাও এই ফতুয়া আমার’ এই
দান সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করে পথ চলি ফের সূর্যাস্তের
দিকে মুখ রেখে; অদূরেই ছিলেন অপেক্ষমাণ উৎফুল্ল ভারতচন্দ্র,
এগিয়ে দিলেন যিনি উত্তরীয় তাঁর
দীন পথিকের হাতে। আমি করজোড়ে করি নিবেদন-
আমি এ দানের যোগ্য নই, কবি। দাতা গুটিয়ে নিলেন হাত।
রৌদ্রের চুম্বনে পথ লাজরাঙা হয়।
খানিক পরেই দেখি, পদ্মপুকুরের ধারে সুললিত সুরে
তন্ময় আউড়ে চলেছেন পদাবলি বিদ্যাপতি। হতদরিদ্র আমাকে
দেখে ধ্যান ভেঙে গেলে, তিনি গলার মুক্তোর হার
আমাকে করেন দান অকাতরে। একান্ত কৃতার্থ আমি বলি,
এ হার আমার কণ্ঠে কখনও পাবে না শোভা কবি,
এ দান ফিরিয়ে নিন, বলে পুনরায় যাত্রা করি
সূর্যাস্তের দিকে মুখ রেখে। তাড়াতাড়ি
উড়িয়ে প্রচুর ধুলো দিগন্তের দিকে অগ্রসর হতে থাকি।
তবে কি সাগরদাঁড়ি আমার দৃষ্টিতে
‘স্বাগতম’ পোস্টার এঁকে দিয়েছে চকিতে? চোখে পড়ে
কপোতাক্ষ তীরে মাইকেল প্রগাঢ় অমিত্রাক্ষর ছন্দে
স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করছেন, হাতে তাঁর মদিরার
রঙিন পেয়ালা আর আমাকে দেখেই আমন্ত্রণ
জানালেন, ‘ওকে ফেলো, সতত যে সুরা পান করি,
তার কিছু করবে কি টেস্ট? হ্যাভ সাম, দিচ্ছি আমার ফরার্সি স্কার্ফ,
হ্যাভ দিস্ স্মল গিফ্ট। নো, থ্যাঙ্কস স্যার, আপনার
সঙ্গে হ্যান্ডসেক করলেই ধন্য হবো বলে নিজ পথ ধরি।
হেঁটে হেঁটে পরিশ্রান্ত, অথচ মঙ্গলালোকে পৌঁছে
যাই, দেখি রবীন্দ্রনাথের মুখ উদিত সূর্যের মতো। তাঁর
মেটে রঙ আলখেল্লাটিকে চুম্বন করার সঙ্গে কবিকণ্ঠ জাগে-
‘কী প্রার্থনা তোমার পথিক? কবি সার্বভৌম; শুধু আপনার
খানিক চরণধূলি ছাড়া আর চাই না কিছুই।
আখেরে অপরিসীম নগ্নতার আভায় প্রোজ্জ্বল
দীনবেশী আমি যাত্রা করি দিগন্তের অন্তরালে দিগন্তরে।