ঘাসের সবুজ ঘ্রাণ
এ রকমই হয় নাকি? হঠাৎ দরজা
বন্ধ হয়ে যায় জোরে মুখের ওপর। এভাবেই
কাটে বেশ কিছুকাল। মনে পড়ে কত কথা, কত
নিবিড় ঘটনা বারবার পুরনো সুরের মতো।
কিছু স্মৃতি মুছে যায়, কোনও কোনও স্মৃতি
বিশ্বস্ত বন্ধুর মতো কিছুতেই যায় না কোথাও সরে,
সঙ্গ দেয় সুখে দুঃখে, রুক্ষ রোদে, তুমুল বৃষ্টিতে
ছাতা মেলে ধরে।
আবার ডেকেছ তুমি সব উম্মা ঝেড়ে ফেলে, দিয়েছ দুয়ার
খুলে, যেন চলে আসি দ্বিধাহীন, অথচ এখন কয়েকটি নিষ্ঠুর বাদুড়
দরজা আগলে রাখে রক্ত চোষার আশায়; তবু
তোমার নিকট যেতে বড় সাধ হয়। প্রতীক্ষার
কাল বড় দীর্ঘ, কাঠ ঠোকরার মতো রক্ত মাংস ছিঁড়ে নেয়।
পারি না তোমার কাছে যেতে। মনে পড়ে,
গুরুজনদের দৃষ্টি এড়িয়ে আমরা
কতদিন চলে গেছি গোধূলি বেলায় দূরে কোনও
জনহীন মাঠে আর নিয়েছি সবুজ ঘ্রাণ সতেজ ঘাসের,
কতকাল দেখি না তোমাকে, ইচ্ছে হয় একবার
দেখে আসি পরমুহূর্তেই ইচ্ছে উবে যায়; শুধু
দু’টি চোখ, শাদা হাত, ডুরে শাড়ি
এবং মাঠের নম্র ঘাস মনে পড়ে।
ঘুরতে ঘুরতে
ঘুরতে, ঘুরতে,
ঘুরতে, ঘুরতে
ঘুরতে, ঘুরতে
যাই, চলে যাই-যেতে থাকি,
কোথায় যে যাই
নানা অলিগলি, খোলা রাস্তা
দরদালানের ভিড় পেরিয়ে অনেক
দূরে বিয়াবানে, নদীতীরে
চলে যাই, যাই হেঁটে হেঁটে। ঘাম মুছি,
বসে পড়ি বটমূলে। পাখিরা ভীষণ বোবা, সাঁই সাঁই হাওয়া।
আমার ভেতরে একজন নড়ে ওঠে,
কথা বলে, ভাষা তার কিছু বুঝি, কিছু বা বুঝি না; আচমকা
বাইরে বেরিয়ে আসে, হাত পাতে। আজব লোকটা
কী চায় আমার কাছে? আমার কিছুই
নেই, অল্পস্বল্প স্বপ্ন ব্যতীত এখন।
আমার স্বপ্নে কি তার ক্ষুধাগ্নি নিভবে?
খরখরে লোকটা জ্বলজ্বলে দৃষ্টি তার
গভীর স্থাপন করে দু’চোখে আমার
‘তোমার স্বপ্নই করো দান, আমি কিছু
স্বপ্ন চাই, আর্তনাদ, হাহাকার চাই
আর হু হু দীর্ঘশ্বাস-প্রসূত সঙ্গীত
চাই, বড় বেশি চাই;
‘নিজেকে উজাড় করে দাও, বলে সে চকিতে নেচে
ওঠে, পড়ে থাকি নিশ্চেতন, একা, পরিচয়হীন।
চর তাকে ডেকে আনে
চর তাকে ডেকে আনে, নদীর সজল হাওয়া তার
যৌবনের ঘ্রাণময় প্রফুল্ল শরীরে, ছলছল
জল তার নগ্ন পদতলে
ক্রমাগত অপরূপ চুমো খায়। তরুণী ছিল না
চরে একা, নিকটের ছিল কয়েকটি পাখি আর
সঙ্গে ছিল তিনজন চটুল তরুণ। অকস্মাৎ, কী-যে হলো
উচ্ছল তরুণ ওর সঙ্গীগণ বনের পশুর
রূপ ধরে সন্ত্রস্ত নারীর
সম্ভ্রম লুণ্ঠনে মাতে। নখরের, সুতীক্ষ্ম দাঁতের
দংশনে কোমল সৌন্দর্যকে ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলে আর
গোধূলি, নদীর ঢেউ, পাখি, চর, ক্ষোভে, তীক্ষ্ম ক্রোধে,
বেদনায় স্তম্ভিত ভীষণ।
চেন্নাইয়ের এক প্রত্যূষে
চেন্নাইয়ের প্রত্যূষের সুনীল আকাশ সাবলীল
মিশে যায় সকালে ঢাকার নিভে-ব্লু আসমানে। মনে পড়ে,
শ্যামলীর বাড়িতে এখন
ওরা ঘুমে অচেতন; সম্ভবত টিয়া রান্নাঘরে
প্রাতরাশ তৈরি করে জিরোচ্ছে খানিক। দীপিতা কি বিছানার
ওমটুকু ছেড়ে চোখ কচলাতে কচলাতে খুঁজছে মায়ের
কোলের আশ্রয়? এইমাত্র গলিপথে কেউ কেউ
বেরিয়েছে বাড়ি ছেড়ে স্বাস্থ্যের সন্ধানে সুবাতাসে।
জানিনা কখন কোন্ ক্ষণে ঘরে ফিরে
যাব এই নীল সমুদ্দুর, এই অটো-অধ্যুষিত
পথ, এই জরুরি শঙ্কর নেত্রালয়, অপারেশানের
উদ্বেগমথিত প্রহরের অবসানে। এই অতিথিশালায়
ঘুম থেকে জেগে শুনি কাকের কোরাস,
কখনও কখনও ভেসে আসে যেন কোকিলের গান
প্রত্যূষের নিঝুম প্রহরে। এ আমার
বিভ্রম হ’লেও ক্ষতি নেই, শুয়ে শুয়ে ঘরে ফেরার মুহূর্তে গুণি।
অকস্মাৎ মনে হয়, ভেলা আমি ভাসিয়েছি সমুদ্রের বুকে,
গন্তব্য অজানা আর পাথেয় কিছুই নেই, শুধু
এক সংজ্ঞাহীন চঞ্চলতা বাইরে এনেছে টেনে
ভেঙে চুরমার হলে ভেলা, ভোজ্য হবো কিছু জলজ প্রাণীর।
জনৈক পথচারী
একজন পথচারী বটবৃক্ষতলে
কাপড়ের থলেটা গচ্ছিত
রেখে গেল দিঘির কিনারে দ্রুত পায়ে
পিপাসা মেটাতে, যেন তার পথ
চলাতেই গভীর আনন্দ পুনরায়।
বিকেলের আলো মুছে সন্ধ্যা
কী দ্রুত দখল করে বটবৃক্ষটিকে।
অনুপস্থিত সে পথিকের ছিন্নভিন্ন পুঁটলিটি
প্রায় শূন্য, কিছু মুড়ি, একটি পুতুল
পড়ে থাকে শোকগাথা হয়ে।
জন্মদিনে ভেজা চোখ
এখন আমার ঘরে সমুদ্রের ঢেউ নৃত্যপর, ফিসফিসে
কথা বলে সুন্দরবনের গাছপালা, নানারঙা
পাখি রয়ে সয়ে সুর ঝরায় এবং
টেবিলে ঘুমিয়ে থাকা কবিতার খাতা
অকস্মাৎ জেগে উঠে লাজনম্র আমন্ত্রণ জানায় উৎসুক
কলমকে। একজন প্রজাপতি ‘জন্মদিন শুভ হোক’ বলে
হেসে উড়ে দূরে চলে যায়; অনুপস্থিত মায়ের
কল্যাণী হাতের স্পর্শ থেকে মহরুম পুত্রের দু’চোখ ভেজা।
জ্যোৎস্নাময়ী
ইদানিং কী-যে হয় ঘন ঘন, বুঝে
উঠতে পারি না কিছুতেই। আসমানি
পূর্ণিমা-চাঁদের মুখ চোখ পড়লেও অকস্মাৎ
চারদিকে ঘোর অমাবস্যা ছেয়ে যায়।
পূর্ণিমা শব্দটি শাদা কাগজে লেখার ভাবনায়
চকিতে উল্লাপাড়ার পূর্ণিমার মুখ
দৃষ্টিপথে এসে পড়ে। পূর্ণিমা, হে বোন আমাদের
নরপশুদের বন্য থাবা।
তোমার সত্তায় কালো ছড়ালেও, ঘোর আঁধারেও
তুমি পরিস্ফুট পুষ্প, জ্যোৎস্নাময়ী।
ডুবে যেতে যেতে
অন্তর্গত নৈঃসঙ্গে আমার দিন যায়, তুমুল ভিড়েও আমি
নৈঃসঙ্গের তুষার-তুফানে ডুবে থাকি। কখনও নেকড়ে টুঁটি
চেপে ধরে; দিন তো যাবেই চলে, যেভাবেই হোক কেটে যাবে,
কখনও হয়তো চক্রাকার ঘুরে ঘুরে
কখনও-বা ধুঁকে ধুঁকে। স্বস্তি নেই, শান্তি নেই, মাথার উপর
সর্বদা ঝুলবে তৈরি মনে, ঘরে থাকা
হবে দায় আতঙ্কের থাবার সন্ত্রাসে।
তবুও তোমার কথা মনে পড়ে, মনে পড়ে অতীত দিনের
ঝলমলে কত না প্রহর কাটিয়েছি
আমরা দু’জন স্বর্গতুল্য স্থানে, যেখানে পাখিরা গানে
সাজিয়ে দিয়েছে অনুরাগে আমাদের
অনন্য মিলনক্ষেত্র। তোমার চুম্বনে
অমরতা পেয়ে গেছি ভেবে গাঢ় আলিঙ্গনে বেঁধেছি তোমাকে।
চকিতে কে যেন ভেংচি কেটে আমাদের অপরূপ
বাসর গুঁড়িয়ে হো হো হেসে ওঠে, আমি
ভীষণ জখমি এক সৈনিকের মতো পড়ে থাকি এক কোণে
কর্কশ ধুলোয় আর বিপন্ন আমাকে
ঘিরে কতিপয় নৃত্যপর অর্ধেক মানুষ আর
অর্ধেক ভয়াল পশু। চারপাশে অগণিত হাড়,
করোটি ছড়ানো। নাচ থেকে গেলে অর্ধপশু আর
অর্ধ-মানুষেরা দাঁত নখ খিঁচিয়ে এগিয়ে আসে
আর আমি ভীষণ প্রমাদ গুণে হাল
ছেড়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করি, প্রখর দুর্গন্ধে ডুবে
যেতে যেতে শুনি অসহায়, ভীত গোপার করুণ
আর্তনাদ, চারদিকে হাতড়াই, যদি হাতিয়ার পেয়ে যাই।