কোথায় চলেছি
কোথায় চলেছি এই ঘুটঘুটে অন্ধকারে? জানি না
কতটা
পথ আরো বাকি; এদিকে তো পথিকের
পাথের ফুরিয়ে এল প্রায়। নাছোড় তেষ্টায়
শুকিয়ে এসেছে গলা, এক ফোঁটা পানি নেই এখানে
কোথাও।
খানিক জিরিয়ে নেব, তার জো গায়েব। পড়ি মরি
কদম বাড়াতে হবে প্রতি মুহূর্তেই। যতক্ষণ
বুকে জীবনের ধুকধুকি আছে, ভবিষ্যৎ পাশা
খেলবে চালিয়ে যেতে হবে নিত্যদিন, মুখে হাসি
ফুটিয়ে রাখার রঙচঙে ভড়ং সাজিয়ে আজও।
কীসে যেন হঠাৎ ঠোকর খাই, মানুষের হাড়
নাকি অন্য কিছু আচমকা
আমাকে দেখতে চায় ভয়। মনে হয়, চারদিকে
থেকে মাতালের মতো টলতে টলতে
আসছে আমার দিকে কতিপয় সফেদ কঙ্কাল। জেগে উঠি,
মেরুদণ্ডে ভীষণ শীতল জলধারা বয়ে যায়।
মাথা ঘোরে প্রচণ্ড গতিতে, খাবি খাই খরাপীড়িত
মাটিতে।
কখন যে চেতনা পেলাম ফিরে, বলা মুশকিল;
জেগে দেখি
অপরূপ আসমান সস্নেহে আমাকে
করাচ্ছে কোমল স্নান সত্তায় জ্যোতিধারা মেখে।
এই যে বলছি স্মিত কথা, এসব কি সত্য নাকি
স্বপ্নের ভগ্নাংশ কোনও? অথবা পাঁচালি
কাল্পনিক?
খুঁজছি সেই যুবাকে
খুঁজছি সেই যুবাকে, যে এক প্রসন্ন বিকেলে
আমাকে দেখিয়েছিল হারিয়ে-যাওয়া আমার
সদ্য-কৈশোরের ঈষৎ ঝলক। একা একা
হাঁটছিলাম, বয়সের ভারে ক্লান্ত, কিন্তু কী এক প্রত্যাশার
তাড়নায় ঘুরে বেড়াচ্ছি দৃষ্টিকে জাগ্রত রেখে।
কিছুক্ষণের জন্যে পাওয়া সেই যুবককে
পুনর্বার হারিয়ে ফেলার ব্যর্থতা
বয়ে বেড়ানো আমার সাধ্যাতীত। নিষ্প্রাণ হয়ে যাব।
যখন দেখেছি কোনও ঝকঝক তরুণকে, তাকে
এভাবে পরখ করছি যে, সে আমাকে কোনও
তালেবর গোয়েন্দা ঠাউরে নিতে পারত! লজ্জিত আমি
দ্রুত পালিয়ে মান বাঁচাই।
আমি যে তরুণের খোঁজে আজ এমন দিশেহারা,
সে তার অজান্তে আমার স্মৃতিকে
মোহন চঞ্চল করে তুলেছে, এমন এক সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছে,
যা আমার হৃদয়ে অতি-পুরাতন রৌদ্র-জ্যোৎস্নাকে
নব্য রূপায়ণে ঢেলে সাজিয়েছে। ওর
তরুণ কণ্ঠস্বরে ছিল যমজ সৌন্দর্যের রূপকথা!
সে আমাকে গুনিয়েছিল গাছপালাময়
দীর্ঘ এক গলির কথা, অপরূপ প্রশন্ত এক
দাওয়ার কথা, দুই যমজ সুন্দরী বালিকার কণ্ঠস্বরে
আরবী শব্দাবলীর সুর, ওস্তাদজীর গম্ভীর আবৃত্তি
আর একজন কৌতূহলী বালকের মুগ্ধ, সতেজ দৃষ্টি। নিষ্পাপ
নৈকট্যের যমজ আভা আজও এক প্রায়-বৃদ্ধকে
কোনো ধ্রুপদী সঙ্গীতের সুরের মতো
আলিঙ্গন করে। সেই প্রায়-বুড়ো লোকটা
উদ্ভ্রান্তের মতো খুঁজে বেড়াচ্ছে সত্য ঘটনাবলীর
বর্ণনাকারী তরুণকে, যে কোথায় হারিয়ে গেল, কে জানে!
গাঁও গেরামের লোক
গাঁও গেরামের এক লোক
শহুরে বাজার থেকে কেনে
ছোট ফ্রক, লুঙ্গি, নীল শাড়ি,
পাশ ঘেঁষে দূরন্ত মিছিল
নানান স্লোগান হেঁকে যায়,
গাঁও গেরামের লোক কিছু
না বুঝেই ভিড়ে মিশে যায়
এলোমেলো ভাঙচুর, গুলি
রাতে গাঁও গেরামের লোক
এক মর্গে শীতল ঘুমায়।
ঘরবাড়ি
এ শহরে আমার একটি ছোটখাটো, শাদাসিধা
আস্তানা রয়েছে, যাকে লোকে
প্রথামতো বাড়ি বলে থাকে। সেখানে আমার এক
জীবনসঙ্গিনী, একজন পুত্র, পুত্রবধূ
এবং দু’জন পৌত্রী আছে। উপরন্তু বুড়োসুড়ো
আমিও বাসিন্দা বটে। কোনওমতে দিন কেটে যায়;
ক’বছর আগে কল্যাণী ছায়ার মতো
উপস্থিতি ছিল জননীর। মাঝে মাঝে
আত্মীয় স্বজন আর বন্ধুবান্ধব আসেন, কথাবার্তা চলে
যথারীতি; স্বল্পভাষী আমি বেশি চুপচাপ থাকি।
কোনও কোনও দিন মনে হয়, একজন
করুণ উদ্বাস্তু আমি, সম্বলবিহীন। ঘোর অমাবস্যাময়
চতুর্দিক, ভয়ানক শূন্যতা এবং স্তব্ধতার হাহাকারে
শুধু এক মুঠো ধুলো হয়ে আছি ধূ ধূ পরিচয়হীনতায়।
ঘরে-ফেরানো গানের জন্যে
আমি কোনও দিগ্বিজয়ী সম্রাট নই, নই তো কোনও পরাক্রান্ত
ভূ-স্বামী, একম কি জাঁদুবেল কোনও রাজনীতিবিদ অথবা
দাপট-দেখানো আমলাও আমাকে বলা যাবে না, তবু সমুদ্র
প্রায় অষ্টপ্রহর চামর দোলাচ্ছে আমারই উদ্দেশে যেন আরাম
আয়েশে কাটে আমার সময়। শুধু তাই নয়, এইমাত্র সমুদ্রের
বুক ছেড়ে পূর্ণিমা-চাঁদ হঠাৎ লাফিয়ে উঠে তার নিরুপম মুখ
বাড়ালো চেন্নাইস্থ আমার অস্থায়ী আস্তানা বিশ্ববিদ্যালয়ের
অতিথিশালার উঁচু ঘরের দরাজ জানালায়। ‘স্বাগতম’ বলে
চমকে ওঠে আমার দু’চোখ আর হৃদপিণ্ড। এমন মুহূর্তে ওকে
চন্দ্র নয়, চন্দ্রা, বলে ডাকতে ভারি সাধ হলো। তার স্বর্গীয়
রুপোলি চুম্বন আমি গাঢ় অনুভব করলাম আমার তৃষ্ণার্ত
ওষ্ঠে, যেন একটি গীতিকবিতা জন্ম নিল মহা মুহূর্তে।
চাঁদ ডুবে গেলে চাঁদিনীর স্মৃতি জেগে রয়। এখন এই
মুহূর্তে আমার মনে কয়েকটি প্রিয় মুখ চাঁদের চেয়েও অধিক
প্রাধান্যে ভাস্বর-এই তো দু’জন শিশু নয়না আর দীপিতা আমাকে
জড়িয়ে ধরেছে আনন্দর ঝর্ণা ঝরিয়ে। আমি ব্যাকুল চুমোয়
আচ্ছন্ন করি ওদের হঠাৎ কী-যে হলো, অকস্মাৎ জ্যোৎস্নাকে
খুন করে অন্ধকার ছেয়ে যায় চতুর্দিকে সন্ত্রাসীর মতো। কবে
আবার খুঁজে পাব অভীষ্ট রোদ্দুর কিংবা জ্যোৎস্নাধারা
যেখানে আজ যেতে চাইছি প্রবল ব্যাকুলতায়, সেই গন্তব্যের
দিকচিহ্ন খুঁজে পাচ্ছি না কেন? সমুদ্রের জ্যোৎস্নাময় ঢেউগুলি মুছে
গেছে, কয়েকটি কঙ্কালসার গাছ দাঁড়িয়ে আছে নিষ্কম্প,
দরিদ্র। সরে যাচ্ছি দূরে, কোন্ সুদূরে? তোমরা যেতে দিওনা
আমাকে। আমার হাত ধরো, গাও ঘরে-ফেরানো গান।