কবন্ধ তাণ্ডব
আজকাল প্রায়শই অনিদ্রা-পীড়িত রাত কাটে। মাঝে-মাঝে
ধু ধু ক্লান্তি দু’চোখ বিছিয়ে দেয় কুয়াশার জাল
বিলম্বিত নিদ্রায় এবং দেখি আমি ভ্রাম্যমাণ
কাঁটাবনে বড় একা। আমার শরীর থেকে রক্ত
ঝরছে তো ঝরছেই আর পর মুহূর্তেই আমার মাথাটা
খাচ্ছে গিলে অর্ধেক- নেকড়েরূপী জীব।
আচমকা দুঃস্বপ্নের ধোঁয়া ছিঁড়ে জেগে
উঠেছি বলেই মনে হয় নাকি প্রকৃতই কোনো ঘোরে বন্দি
হয়ে আছি? সুতপা চাঞ্চল্যে তুমি সুললিত কৈশোরের বেড়া
ডিঙিয়ে যৌবনে পৌঁছে বুনেছিলে কত না স্বপ্নের অত্যুজ্জ্বল
মায়াজাল, ছিলে মগ্ন অপরূপ ঘোরে। সুতপা, তোমার আর
প্রমীলার পূর্বপুরুষেরা অবিরল
ঝরিয়েছে ঘাম এ দেশের শ্যামল মাটিতে। রোদে পুড়ে
অঝোর বৃষ্টিতে ভিজে ফলিয়েছে সোনালি ফসল। অবিনাশ,
তোমার জনক এই এলাকায় সুশৃঙ্খল বিদ্যানিকেতনে
মানুষ গড়ার কারিগর রূপে কাটালেন সারাটি জীবন
তবু, অবিনাশ, নিজ বাসভুমে নিজ চোখে তোমাকে দেখতে হলো
সহোদরা সুতপা এবং প্রমীলার কুমারীত্বহরণের
পৈশাচিক লীলা আর রক্তাপ্লুত বাবা মা’রে নিঃসাড় শরীর
বিধ্বস্ত বাস্তুভিটায়, ক্ষণকাল আগেও ছিল যা ছিমছাম,
রুচিশীল। প্রতিরোধ ভঙ্গুর, নিষ্ফল ছিল। সুতপা, প্রমীলা
পাথরের মতো ছিল নিথর, নিশ্চুপ; অবিনাশ, তুমি নিজে
ভীষণ আহত, প্রতিবেশীগণ ভীত, পলাতক। আমরাও
অতিশয় ব্যর্থ, অসহায়, যোজন-যোজন দূর থেকে ছুটে
এসে ঠিক পারিনি দাঁড়াতে তোমাদের পাশে
বাড়িয়ে মৈত্রীর হাত রুখে দিতে কবন্ধ তাণ্ডব। এ ব্যর্থতা
প্রেতচ্ছায়া হয়ে প্রায়শই জুড়ে দেবে বিভীষিকাময় নাচ,
আমরা ধিক্কারে বিদ্ধ করব নিয়ত নিজেদের।
কবির রক্ত
কখনও দূরের নীল, ভাসমান মেঘ, উড়ে-যাওয়া
পাখির ধূসর পঙ্ক্তি, সতেজ সবুজ
ফ্লাটের রেলিং ধরে দাঁড়ানো কিশোরী কিংবা পথের ভিখিরি
লোকটার মাথার জটিল কুঞ্জে সাড়া জাগায় এবং
রং-বেরঙের শব্দমালা তৈরি হয়। তবে তার
পায়ের তলার মাটি সবচেয়ে বেশি অর্থময় এবং গভীর পঙ্ক্তি
কে জানে কেমন গূঢ় রসায়নে সৃষ্টি করে কখনও নিমেষে
কখনও-বা সময়ের দীর্ঘ ব্যবধানে।
বারবার শুধু শব্দমালা তৈরি করা ছাড়া বিফল সে
অন্যসব কিছুতেই। প্রায়শ লোকটা
ঠেকায় আপন মাথা মৃত্তিকায়, কোনও কোনওদিন
চেয়ে থাকে ধূলিকণাদের দিকে-পথচারীদের
চোখে পড়ে কখনও সখনও। কেউ কেউ তাকে ঘোর
উন্মাদ ঠাউরে হেসে যে যায় গন্তব্যে চলে যায়,
কেউ-বা প্রলুব্ধ হয় ঢিল ছুঁড়ে দিতে। আপন গহনে সেই
অক্লান্ত ডুবুরি উদাসীন খুব হাসি-মশ্করার প্রতি।
এমন মৃত্তিকালগ্ন সত্তার সতেজ রক্তধারায় দেশের
মাটি ভাসাবার হিংস্র ফিকিরে মাতাল
কিছু লোক, এ-কথা জেনেছে কবি। কবিতার সিঁড়ি গড়বার
ফাঁকে ফাঁকে ভাবে সে বিষণ্নতায়, ‘যদি মাতৃভূমি
ভীষণ তৃষিত, তবে সেই ধূ ধূ পিপাসা মিটুক
শোণিতে আমার আর ফুটুক গোলাপ তার বুকে।‘
কিংবদন্তির কথা বলে যাবে
আখেরে চলেই গেলে কী শীতল নিস্তদ্ধতা একটি বছর
আপন নিবাসে রেখে মিলে গেলে মেঘে
অলীক পাখির মতো অনন্তের সীমাহীনতায়।
একটি কথাও তুমি বলোনি তোমার প্রিয়তমা
মণির উদগ্রীব কানে, কাকাতুয়া, তনয়া তোমার,
শোনেনি তোমার প্রিয় ডাক, শুনবে না কেউ আর।
না হয় ক’জন অর্বাচীন তোমার পবিত্র পোশাকের নাম
ধুলোয় লুটিয়েছিল, গিলে ছিল থোকা থোকা কাদা,
নিজেরাই করেছিল অপমান নিজেদের, কেন
তুমি উহাদের তুচ্ছ ভেবে ক্ষমাই করোনি তুচ্ছতর? কেন
নিজেকেই দিলে শাস্তি ক্রাইস্টের মতো?
আজ মেঘে মেঘে নিজে মেঘ দেখছো বান্ধব,
তোমার একান্ত প্রিয় খাতা কবিতা বিহনে আজ
কী ভীষণ ধূ ধূ! তোমার আপন ঘরটিতে
ভ্রমর এবং প্রজাপতি এসে ঘুরে ঘুরে ফিরে যাবে, তবু
হবে না কবিতা আর তোমার হাতের স্পর্শে,
কলমের কালির আভায়
মেঘে মেঘে ভেসে তবু তুমি
এ দেশের অগণিত মানুষকে কিংবদন্তির কথা বলে যাবে।
কেন যে উন্মাদ হয়ে যাইনি
সত্যি বলতে কী, এই উপসর্গ সাম্প্রতিক বটে-একাকীত্বে
ডুবে প্রিয় পুস্তকের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে কিংবা
কৃপণ আকাশে চোখ রেখে কিছু ভাবলে অথবা
কাঙ্ক্ষিত ইয়ার-বন্ধুদের মজলিশে মশগুল
থাকার কালেও আচমকা মনে হয়,
কেন যে উন্মাদ হয়ে যাইনি এখনও!
ভোরবেলা সংবাদপত্রের দিকে তাকালেই দু’চোখে কেমন
উদ্ভট সার্কাস, বিভীষিকা পাক খেতে থাকে
অবিরাম; অস্ত্রের বেলেল্লা জয়োল্লাস, যাদের সিঁথিতে আজও
সিঁদুরের ছোঁয়াটুকু লাগেনি, তাদের
সম্ভ্রম লুটেছে যারা সগৌরবে তারা
মুহূর্মুহু করে জয়ধ্বনি লুণ্ঠিত, আহত পাড়াগাঁয়।
এই যে প্রত্যহ আমি একালে কামাই দাড়ি, গোসলখানায়
পানি ঢালি গায়ে, নাস্তা খাই যথারীতি,
দিব্যি উপভোগ করি গাছের পাতার মৃদু নাচ-হায়, আজ
এসব কি সাজে আর? কেন যে উন্মাদ হয়ে যাইনি এখনও,
দেখছি ব্যথিত মানবতা যাচ্ছে হেঁটে, পায়ে যার
লোহার শেকল আর হাতে
হ্যান্ডকাফ, মাথা উঁচু কণ্ঠে শেকল ছেঁড়ার এক স্তিমিত প্রয়াস?
কোকিল মূক হয়ে থাকে
অতিশয়োক্তি হবে না, যদি বলি সময়টা ছিল
মাতাল, অন্তত আমার জন্য। সদর স্ট্রিটের
ল্যাম্পপোস্টে বসে-থাকা পাখি, পথের ধারে
ধুলোর ঘর-বানানো বালকের ঠোঁটের ভঙ্গি, মাটি
আর মামুলি তারের তৈরি ছোট্র বেহালায়
ফিল্মি গানের সুর-বাজানো পথিক শিল্পীর হাঁটার ছন্দ
আমাকে মুগ্ধ করতে খুবই। চা-খানায় ইয়ার-বন্ধুদের
আড্ডায় রোজানা শরিক হওয়া, নানা স্বপ্নের ফানুস ওড়ানো,
দূরের আসমানে মেঘে মেঘে সাঁতার কাটা
ছিল আমার নিত্যকার কাজ। আধুনিক কবিতায় নিয়ত
বুঁদ হয়ে থাকতে পেরেছি বলেই
পেয়েছি স্বর্গসুখ এবং প্রায়শ বেদনাবোধ দখল করেছে
আমাকে। সেই উদ্দামকালে যৌবনের দুপুরে
একজন তরুণী আমার দু’চোখে, হৃদয়ে ছড়িয়েছিল সাতরঙা স্বপ্নাভা।
প্রণয়-নিকুঞ্জে মিলিত হয়েও তরুণী সৃষ্টি করল উপেক্ষার মুদ্রা,
আমার অনাবিল স্বপ্ন ভেঙে-পড়া কাচের পাত্রের মতো
আর্তনাদ করে উঠলো। আজ এতকাল পরে হঠাৎ
কখনও মনে হয়, আমার জীবনের অতি সংক্ষিপ্ত সেই অধ্যায়
কত বছর আগেকার সমুদ্রতলে নিমজ্জিত নৌযানের মতোই
অতিশয় ক্ষয়া, বাতিল। হয়তো কালেভদ্রে
ভাবনার ঢেউয়ে ঢেউয়ে ভেসে উঠবে আর নিজের
প্রাচীন আহাম্মকির কথা মনে করে হাসিতে ফেটে পড়বে হৃদয়।
তারপর জীবনের নানা বাঁকে কত না মোহিনী-মুখ চকিতে
চন্দ্রিমা হয়ে মিশেছে অমাবস্যায়; শুধু গৌরীর
নিরুপম সত্তার আভা আজও বসন্তবাহার হয়ে প্রহরে
প্রহরে সুর বিস্তার করে। সত্যি-সত্যি জীবন
দেখিয়েছে কত না খেল, নেচেছি বানর কিংবা
ভালুকের মতো পাকা খিলাড়ির হাতে। মাঝে মাঝে
হঠাৎ বেঁকে বসেছি বটে। ফলত কিছু ব্যর্থতা কিছু সাফল্য
হেঁটে গেছে পরস্পর হাত ধরাধরি করে। এখন
আমার জীবন ঝুঁকেছে অস্তাচলে না, কোনো
হাহাকারকেই দেব না আমল, মাথা রাখব উঁচু সারাক্ষণ।
হিসেব নিকেশে দড় নই কোনওকালেই। কী খরায়,
কী স্নিগ্ধ বর্ষণে রয়েছি অবিচল জীবনের এই গোধূলি-লগ্নে
গৃহিণীর দিকে তাকিয়ে লক্ষ করি, একদা রূপকোমল মুখ
এখন কেমন এবড়ো-খেবড়ো জমির মতো। হঠাৎ কখনো
ইচ্ছে হয় হাত বুলিয়ে মসৃণ করে দিই। ঝড়-ঝাপটা তো
কম হয়নি ওর ওপর। ভাবি, যদি এই মুখ কোনো ইন্দ্রাজালে
সেই কবেকার বিকেল-ছোঁয়া বারান্দায় অথবা
বাসর-রাতের প্রস্ফুটিত চেহারায় রূপান্তরিত করতে পারতাম।
আজো কোনও কোনও রাতে আলো আঁধারিতে ওর গালে,
ঠোঁটে আঙুল বুলিয়ে দিই ব্যর্থ শিল্পীর ধরনে।
ঘুমে ভাসমান শরীরী যুগ্মতায় তুষার ঝরে, পাতাহারা
রুক্ষ গাছে কোকিল ডেকে উঠতে চেয়েও মূক হয়ে থাকে।