এ কেমন কাল এল
এ কেমন কাল এল? দিনদুপুরেই নানা পাড়ায় ডাকাত
হানা দেয়, জাঁহাবাজ আগুনের জিভ চেটে খায়
শত গেরস্তের ঘরবাড়ি। অনুসূয়া, সুতপা, অরুণ, নিমাই পোড়া
বাস্তুভিটা ছেড়ে জীবনের ঘ্রাণ পেতে
ছোটে, ছোটে প্রাণপণে। হায়, এ কেমন
কাল এল উজাড় করতে শত শান্তিনিকেতন? খটখটে
রোদ কী করে যে হয়ে যায়
মানবমানবী-খেকো অমাবস্যা! শিশুরা লুকায়
নিরীহ, নীরক্ত মুখ মায়ের ভয়ার্ত বুকে। মৃত্যুতাড়িত আদম-
সন্তানেরা ছোটে বনবাদাড়ে, ভাগাড়ে।
তমাল গাছের ডাল, পাতা, ছায়া আজ বড়
শোকার্ত এখানে
বাঁশের বাঁশির সুর পলাতক-এখানে বসে না
যুবক যুবতী হাতে হাত রেখে; পাখিরা গায় না
আর গান, ক্রুর অস্ত্রবাজদের হুঙ্কারে আহত
শুভবোধ এবং শান্তির শুভ্র পতাকা পাশব পদাঘাতে
ধুলোয় গড়ায়, চারপাশে বোবা হাহাকার। যদি
পারতাম বুকে ঠাঁই দিতে লুণ্ঠিত, বিপন্ন এই
অসহায় আপনজনকে, যদি পারতাম
আমার ধর্ষিতা বোনদের বেদনার গাঢ় কালি মুছে দিতে।
দেব না মর্যাদা, প্রীতি, আশা, ভরসাকে
অশ্লীল উল্লাসে পুঁতে ফেলতে কাদায়
অথবা পাঠাতে কোনও ধূসর শ্মশানে-
জানি ফের পতাকা সুনিশ্চিত বিজয়ী মানবতার।
এই আর্ত বর্তমান
আমাদের আর্ত বর্তমান পাঁড় মাতালের মতো বক-বক
করছে, উঠেছে মেতে বে-ধড়ক মারপিটে, খুনখারাবিতে
প্রায়শই। কী-যে হয়, ফুটন্ত গোলাপ দেখলেও
আনন্দের তরঙ্গ জাগে না মনে, চোখ
চকিতে বিদ্রোহ করে; সাত তাড়াতাড়ি প্রায় দৌড়ে
অন্তরালে চলে যাই। নক্ষত্র কি ভাসমান মেঘ
কনওটাই জাগায় না অন্তরে আবেগ; মনে হয়,
দেখিনি কিছুই বেলা-অবেলায়, গাছের পাতার
কম্পন বেজায় ব্যর্থ হৃদয় দোলাতে, এমন কি
সুন্দরীতমার মুখ নিমেষেই পারে না ফোটাতে ফুল শোণিতে ফুল শোণিতে আমার!
আজকাল যখন ঘুমোতে চেষ্টা করি মধ্যরাতে
বাতিটা নিবিয়ে, ঘরময় কবন্ধেরা নেচে ওঠে, কেউ কেউ
টলতে টলতে আসে বিছানার অতি কাছে। কী করব ভেবে
পাই না, কেবল চোখ দু’টো বন্ধ করা রাখি ভীষণ নির্ঘুম
রাতে, ভোর আসে খুব দেরিতে, নিষ্প্রভ চারদিক।
কারা যেন ডাকছে আমাকে দূর দূরান্তের কুয়াশায় মিশে,
ডাকছে ব্যথিত কণ্ঠস্বরে; কথাগুলো
অস্পষ্ট বেজায়, শুধু পাথরের স্তূপে
চাপা দীর্ঘশ্বাস আর কম্পিত ফোঁপানি
আমাকে জড়িয়ে ধরে, যেন আমি প্রবাসী আপনজন। কী-যে
করি, ভেবে পাই না কিছুতে। কানে আসে, ‘বলতো কবি দা’, কেন
প্রলয়ের স্বেচ্ছাচারে বারবার আমাদের বাস্তুভিটা পুড়ে
ছাই হবে? কেন বীথি আর মেনকাকে ধর্ষিতার
টিকলি কপালে বয়ে বেড়াতেই হবে? কেন দেবনাথ আর
গৌতমের তাজা রক্তে ভেসে যাবে নিকানো উঠোন? হায়, শত
বর্ষাতেও মুছবে না এই রক্তধারা, মুছবে না
কস্মিনকালেও। বল কবি দা’ কী হবে আমাদের?’ পাথরের
মতোই নিশ্চুপ থাকব কী? হৃদয়ের ছোঁড়া তন্ত্রী
নিয়ে বলি, ‘শোনো বীথি, তোমাদেরই এই মাটি এই গাছপালা।
এক পাল পশু ধেয়ে আসছে
গোধূলি-স্নাত বারান্দায় খয়েরি পাখিটাকে দেখে
ভালো লাগল না কি মনের
গহনে ভয়ানক হিম হাওয়া বয়ে গেল, বুঝতে
পারিনি। মনে হলো, কারা যেন অত্যন্ত
তাড়াহুড়ো করে আমাকে মলিন স্ট্রেচারে শুইয়ে ঠেলে
নিয়ে চলেছে ঢিমে তালে। ডুবু-ডুবু সূর্য হিংস্র জন্তুর মুখ!
আমার শরীরের বিভিন্ন অংশে জোড়া-তালি-দেওয়া
আনাড়ি ব্যান্ডেজ ফ্যাল ফ্যাল তাকিয়ে দেখছে চারপাশের
রুক্ষ গাছগুলোকে। কী একটা করুণ সুর
ভেসে আসে কে জানে কোত্থেকে। আমার শরীর থেকে টুকরো
টুকরো কি খসে পড়ছে স্টেচারে? মাটিতে? এ আমি
কোথায় চলেছি? স্ট্রেচার-চালকদের প্রশ্ন করতে গিয়ে
ব্যর্থ হচ্ছি বারবার। তবে কি আমার গলা থেকে কোনও
আওয়াজ বেরুচ্ছে না? না কি ওরা কানে তুলো গুঁজে
রেখেছে ঢের আগে থেকে! এক রত্তি শক্তি নেই শরীরে,
অথচ লাফ দিয়ে মাটিতে দাঁড়াতে ভারি ইচ্ছে করছে।
একপাল পশু ধেয়ে আসছে স্ট্রেচারের দিকে, স্ট্রেচার
চালকরা নির্বিকার, মূক, চৈতন্যরহিত। ভেসে
চলেছি মেঘে, অনেকগুলো নখর আর দাঁত ছিঁড়ে খাচ্ছে
আমাকে। আমি এক লহমায় মেঘ হয়ে, পাখি হয়ে
স্পর্শ করতে চাইছি পূর্ণিমা-চাঁদকে। আমার হাতে ভয়ানক
গরম, পোড়া রুটি, মুখে এক টুকরো পুরতেই বালির মতো
ঝুরঝুরিয়ে পড়া যায়। দূরের মেঘ থেকে নষ্ট ফলের মতো
পড়ছি, পড়ছি, পড়ছি। কে যেন আমার পতন
রুখতে চাইছে তার সোনালি হাত বাড়িয়ে, সেই হাত
ছুঁতে পারছি না কিছুতেই। পড়ছি, পড়ছি, পড়ে চলেছি।
একজন শ্যামলের উক্তি
এখানে ভালোই আছি, বেশ ভালো আছি নানাবিধ
কীটপতঙ্গের মাঝে। কখনও কখনও
গা বেয়ে মসৃণ ওঠে তারা, ইচ্ছে হলে কেউ কেউ
হঠাৎ কামড়ে ধরে। তেমন কিছুই নয়, জ্বালা করে কয়েক মিনিট।
ছোট বড় গাছপালাদের স্নিগ্ধ, নিঃশর্ত সবুজ
মায়ায় ভালোই আছি ইদানীং। কোনও কোনও বন্য প্রাণী দূর
থেকে লক্ষ্য করে এই আহত আমাকে, কেউ কেউ
গা চেটে আমার ফিরে যায় প্রিয় সঙ্গীদের কাছে।
তোমাদের বান্ধব শ্যামল আমি, ভীরু এক নিরস্ত্র যুবক
এ দেশের, পলাতক পুর্বপুরুষের বাস্তুভিটা থেকে, যেখানে রয়েছে
নিঃস্পন্দ, নিষ্প্রাণ পড়ে বিধবা মা, হিংসা আর লালসা-তাড়িত
নরপশুদের সমবায়ী নিপীড়নে
আমার কুমারী বোনটির কলঙ্কিত, প্রতিবাদী লাশ-এই দৃশ্য
দেখে কাঁপে আকাশ এবং ভাঙা চাঁদ কান্নায় লুকায় মুখ!
এখানে ভালোই আছি গাছপালা, ঝোপঝাড় নানা
কীটপতঙ্গের, পাখি আর পশুদের
দয়ালু সংসারে। না রহিম, না বশির, না আমিন
তোমরা আমাকে আর ফিরে যেতে বলো না সেখানে,
আমি সেই শ্মশানে যাব না। এই ঘোর অবেলায়
যা বলছি, তার উৎস নয় কণ্ঠ। আমার দু’চোখ, লাঠিপিষ্ট
দশটি আঙুল, ভাঙা নাক আর থ্যাতলানো বুক
বিশ্বস্ত কথক এই নিরালায়। প্রিয় বন্ধুগণ, ফিরে যাও
আপন নিবাসে, নইলে তোমরা এখানে
আবিষ্কৃত হলে দ্রুত বনে যাবে পশুদের সহজ শিকার। কোন পশু?
তোমাদেরই প্রতিবেশী, মুখের আদলে
কিছু মিল থাকলেও আচরণে ওরা ঠিক নিখুত জল্লাদ।
যাও, ফিরে যাও ঘরে। তোমাদের প্রতি
নেই কোনও অভিমান, অনাস্থাও নেই। এখানে থাকব শুয়ে
একা রঙধনুর শয্যায়, আহ্লাদিত প্রজাপতি
নাচবে আমাকে ঘিরে, সুকোমল পাখির পালকে
মুছে যাবে খেদ, ক্লান্তি, দু’চোখের জলধারা আর
ভবঘুরে মেঘ গান শোনাবে ঈষৎ দূরে থেকে রয়ে সয়ে
এবং উঠবে সেরে আস্তেসুস্থে আমার বুকের
ক্ষতগুলি, এখানেই গড়ে নেব নিরালা সংসার।