শুষে নেয় পোড়া মাটি
হঠাৎ আমার পায়ের তলার মাটি ভয়ঙ্কর
কম্পমান এবং আসমান চিরে ভেসে আসে
প্রদীপ কাকাবাবুর আর্তনাদ, শোভা কাকি-মার কান্না,
বোন ললিতার গোঙানি। হৃদয়-বিদারক
ধ্বনি সম্প্রদায় বলছে, ‘কোথায় তুমি আজিজ?’ স্তম্ভিত,
ত্বরিত ছুটে গেলাম প্রদীপ কাকার বাড়ির দিকে।
এ কোন দৃশ্য দেখতে হলো আমাকে? প্রৌঢ় প্রদীপ কাকা
মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন আঙিনায়,
রক্তাক্ত শরীর, ভস্মাভূত বসতবাড়ি, শোভা কাকি-মা পাশেই
মুখ থুবড়ে পড়ে গোঙাচ্ছেন। বোন ললিতা কোথায়? অদূরে
ঝোপঝাড়ে ওর অচেতন শরীর। পূর্ণিমা লুপ্ত
হিংস্র অমাবস্যার যৌনাচারে!
কিংকর্তব্যবিমূঢ় এই আজিজ, এই পাথর-আমি, পাথরের
চোখ ফেটে বেরুনো ক’ফোটা পানি শুষে নেয় পোড়া মাটি।
সভ্যতার কাছে এই সওয়াল আমার
কী এক আত্মা-কাঁপানো ভয়ের কামড় হামেশা
খেয়েই চলেছি। বুঝি না কোন্ অপরাধে ছুঁচো, ইঁদুর, এমনকী
লাল পিঁপড়েও অস্তিত্বে দিচ্ছে হানা, যেন খেল-তামাশা
পেয়ে গেছে নিখরচায়। পাঁচ মিনিটও শান্তি দোলায় না হাতপাখা,
স্বস্তি ভুলেও রাখে না অধর ওষ্ঠে আমার। কেউ কি
আমাকে বলে দেবে কোন মোড়লের বাড়া ভাতে
ছিটিয়েছি ছাই? কোনও গেরস্তের ভিটায়
ঘুঘু চরাবার কল্পনাও তো ঘেঁষেনি মনের কোণে।
যদি নারী, শিশুর হাসি, ইয়ার বন্ধু, শান্তিপ্রিয়
মানবসমাজকে ভালোবাসা অপরাধ হয়,
যদি দুপুরের চকচকে ধারালো রোদ্দুর, চরাচর স্নিগ্ধ-করা জ্যোৎস্না,
শ্রাবণের মেঘ, জলধারা, মুক্তাঙ্গনের পুষ্পবিকাশ, পাখির উড়াল
আমাকে পুলকিত করে, আমার হবে কসুর গুনাহ্?-
হাজার বছরের সভ্যতার কাছে এই সওয়াল আমার।
তবে কেন আমাকে কাফকার নায়কের মতোই।
কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে যখন তখন,
লুকিয়ে বেড়াতে হবে দিগ্ধিদিক? কেন হিংস্র আঙুলগুলো
দহলিজে বসে ফরমান রটিয়ে
টিপে মারতে চাইবে আমার পরান-ভোমরাকে?
আমার স্বপ্ন, সাধ, কলম কেড়ে নিতে চাইবে এক ঝটকায়?
সূর্যোদয়, গোধূলিময় আকাশ, নদী আর নক্ষত্রসমাজকে
ব্যাকুল প্রশ্ন করি, আর কত রাত নির্ঘুম
কাটাব লাল চোখ নিয়ে? কখন বইবে অপরূপ
নহর খরা-পীড়িত জমিনে? কখন আসবে সেই প্রহর;
যখন অশুভের হুঙ্কার স্তব্ধতায় হবে লীন,
যুদ্ধবাজদের হাতে রাইফেলের বদলে থাকবে
সুরভিময় ফুলের তোড়া? মিলনের বাঁশি? অভ্যাসবশত স্বপ্নে
ভেসে বেড়াই আবছা ময়ূরপঙ্খি ভেলায়।
স্বপ্নভঙ্গের ইতিহাস দীর্ঘ অতিশয়, তবুও
মহাপুরুষদের বাণী থেকে শান্তির আভা বিচ্ছুরিত হয়, হতে
থাকবে চিরকাল। দেখি, অবাধ প্রান্তরে প্রশান্ত আলোয়
বালক বালিকারা হরিণ হরিণীর গলায় লগ্ন, মগ্ন খেলায়।
এটাই সত্য হলে, তবে কেন ঢিল খাব, ক্রুশবিদ্ধ হব?
হাজার বছরের সভ্যতার কাছে এই সওয়াল আমার।
হাই মিস্টার রাহমান
হাই মিস্টার রাহমান, ভোরবেলা থেকে মধ্যরাত অব্দি
আকাশ পাতাল এক করেও আপনার
সাধের কবিতার খাতার পাতায় একটি নতুন পঙ্ক্তিও
বসাতে পারলেন না। অথচ জনাব ঘুম থেকে
জেগে উঠেই তাড়াহুড়ো করে চায়ের কাপ নিয়ে
বসলেন; ধোঁয়ার লতিয়ে ওঠার দিকে খানিক নজরও
দিলেন না, দেখলেন না পেয়ালার রূপ। একবারও
তাকালেন না জানালার বাইরের ফুলের ঐশ্বার্যে
নুয়ে-পড়া গাছটির দিকে। অদূরে
পাখা কাঁপানো পজাপতিটাও
আপনার দৃষ্টির বাইরে রয়ে গেল, স্যার। আপনি কিছু
মনে করবেন না, নিষ্প্রাণ প্রস্তরমূর্তিবৎ ছিলেন!
জানি, একটি কবিতা লেখার তাড়া ছিল আপনার
অথচ কোনও কোনও ভোরবেলা ধূমায়িত
চায়ের পেয়ালার রূপ আপনার অনেক সময় কী সুন্দর
আদায় করে নিয়েছে, কবি। একটি গুবরে-পোকার ধীর গতি
আপনাকে কোনও নতুন ছন্দের সন্ধান দিয়েছে।
খুব সহজেই যেন খেলা হয়ে গেছে একটি প্রকৃত নতুন কবিতা।
আজ কেন কবিতার খাতার পাতা ধু ধু মরুভূমি?
জনাব রাহমান, এ এক জবর তেলেসমাতি সওয়াল!
অকূল দরিয়া বয়ে চলেছে নানারূপে পাতালে
অপরূপ রত্ন কত বিরাজ করে, কে কখন কী নিয়ে যায়,
বলতে পারে না কেউ। আপনিও ডোবান ঘড়া, কবি।
হয়তো গহন পাতাল ছোঁবে বার বার সেই ঘড়া,
ছড়াবে আলোর ছটা।