- বইয়ের নামঃ ভগ্নস্তূপে গোলাপের হাসি
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অন্তরের গহন পাতালে
একদিন হেঁটে হেঁটে চলে গেলাম অনেক দূর
বিয়াবানে অভীষ্ট বস্তুর খোঁজে। হঠাৎ সবুজ
গাছগাছালির মধ্য থেকে ভেসে এল গাঢ় এক
কণ্ঠস্বর, ‘কিয়দ্দূরে একটি প্রাচীন কূপ আছে
তোমারই ব্যাকুল প্রতীক্ষায়, তার কাছে চলে যাও। কিছু পথ
হেঁটে ঠিক প্রাচীন কূপের কাছে গেলে, ‘এসো, এসো
আমার ভেতরে ডুব দাও। সেই ধ্বনি মেনে নিয়ে বারবার
ডুব দিয়ে শূন্য হাতে ফিরে এসে ফের হেঁটে চলি।
হেঁটে যেতে যেতে অনুভব করি, ক্লান্তির কুয়াশা
আমাকে ধরেছে ঘিরে। বৃশ্চিকের দংশনের কাতর, তবু হেঁটে
যাব যত পারা যায়। একটি নদীর কাছে পৌঁছতেই নদী
উজ্জ্বল জলজ কণ্ঠে বলে, ‘আমার গভীরে ডুবে দ্যাখো,
তুমি যা খুঁজছে পেয়ে যেতে পারো হে ক্লান্ত পথিক। বহুক্ষণ
নদীর গভীরে ডুবে বারবার শূন্যতা নিয়েই
ফিরে আসি। এ বঞ্চনা, এই প্রতারণা আর কত
সওয়া যায়? মনে হলো, চাঁদকে খুবলে খাচ্ছে ক্ষুধার্ত নেকড়ে।
অবসন্ন সত্তা গাঢ় নিদ্রায় ডোবার বাসনায়
কেমন উন্মুখ হয়ে ওঠে। চকিতে একটি ধ্বনি
আমার অন্তরে জেগে ওঠে, বেজে ওঠে, ‘ওহে ক্লান্ত পথচারী,
ইতস্তত ঘোরাঘুরি ছেড়েছুড়ে খুব নিরালায়
নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফজুল বচসা থেকে গাঢ়
ডুব দাও, বারবার ডুব দাও অন্তরের গহন পাতালে;
সন্ধানে টেনো না ছেদ কিছুতেই, তোমার অভীষ্ট
ঝলসে উঠবে চিদাকাশে, উদ্ভাসিত হবে তুমি।
অন্য দৃষ্টি
আমার চোখের আলো ক্ষীণ থেকে ক্রমে
ক্ষীণতর হচ্ছে, দিনে রাতে
অসুস্থ দু’চোখে নিয়মিত কমপক্ষে
ছ’বার ওষুধ দিতে হয় সাত বছরের কিছু অধিক সময় ধ’রে। টিয়া
নিয়মতি এ দায়িত্ব করছে পালন। কোনওদিন
বিরক্তির ঈষৎ কুঞ্চনও মুখে তার
দেখিনি, বরং চোখ দু’টো দৃষ্টিময় রাখার প্রয়াসে সুখী।
ওষুধ দেয়ার পরে চক্ষুদ্বয় ক’মিনিত বুজে
রাখতেই হয় প্রতিবার। খোলা চোখে সবকিছু
ক্রমশ আবছা হয়ে যাচ্ছে। লেখাপড়া
অনেক কঠিন বর্তমানে ক্ষুদ্রাক্ষর দেখি না মোটেই, লিখি
ঢের কষ্ট সয়ে; চোখে ওষুধের ফোঁটা
পড়লেই ক’মিনিট দৃষ্টিহীনতায় কেটে যায়।
তখন কিছুই আর বন্ধ দু’টি চোখে
তেমন ধোঁয়াট নয়। সাময়িক দৃষ্টিহীনতায়
দেখে ফেলি দু’টি রাঙা ফুলের মিলন। স্পষ্টতায়
সৃষ্টি হয় নানা দৃশ্য, চোখের পড়ে তরুণ-তরুণী
পরস্পর হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে
সুস্পষ্ট মিলিত হয় মহাদিগন্তের প্রতিভায়।
অমাবস্যা ছিঁড়ে জাগে
পালাও, পালিয়ে যাও,
পালাও, পালাতে থাকো,
পালাও, তোমার না পালিয়ে
রক্ষা নেই। দেখতে পাচ্ছ না, চারদিক থেকে ওরা
তোমাকে ধরবে ঘিরে, পালাও, পালাও।
পেছনে লোমশ হাত, খড়্গ এক্ষুণি পালাও।
এখন যেদিকে পারো আকাশে, পাতালে
প্রাণপণে ছুটে যাও, দড়ি যদি না-ও জোটে, হাত
সাপের দিকেই দ্রুত বাড়াও, এখন মানুষের চেয়ে জেগে
ওরাই অধিক নিরাপদ। অনর্থক
দেয় না ছোবল সাপও। অথচ হিংসার ব লল্গাহীন
খেলায় হেলায় মেতে ওঠে মানুষের তক্মা-আটা জীবগুলো!
গ্রামে-গঞ্জে শহরতলীতে, নারায়ণ, দীপঙ্কর, অরুণিমা
শঙ্কায় কাটায় দিনরাত; বনলতা, অরুন্ধতী
বস্ত্রহরণের ভয়ে কম্পমান অমাবস্যা রাতে। এখন তো
দ্বিপ্রহরই মধ্যরাতে হাহাকারে, অসহায় কান্নায় কুমারী
লুটায় মাটিতে ব্যাভিচারী নরপশুদের ক্লেদজ থাবার
স্পর্শে মূর্চ্ছা যায় আর চারদিক থেকে অকস্মাৎ রহমত, নুরুদ্দিন,
নির্ভীক মানুষ ছুটে আসে ভায়ের বোনের
লজ্জা নিবারণে আর তাড়াতে পশুর ঝাঁক শান্তিনিকেতন
থেকে, বুকে টেনে নেয় নারায়ণ, দীপঙ্কর, অসীমকে, হাত
রাকেহ বনলতা, প্রমীলার হাতে। অমাবস্যা ছিঁড়ে জাগে পূর্ণিমার চাঁদ।
আর কতদিন থাকব
এ পাড়ায় দশ বছর ধরে আছি
আর কতদিন থাকব, জানা নেই। দশ বছর
খুব কম সময় নয়, অথচ দুষ্টি বালকের মতো
হুট করে কীভাবে যে উধাও হলো
বলতে পারব না।
দশ বছর ধরে বাড়ির একটি কোণে একটি
ছোট ঘরে আমার দিনরাত কাটে। অথচ
কী অবাক কাণ্ড, আজ অব্দি একবারও
কোনো কোকিলের ডাক শুনিনি। কত যে কান পেতে
রয়েছি, শুধু বিড়ম্বনাই হয়েছে সার আর
আমাকে উপহাস করার জন্যেই যেন রোজ
আশেপাশে ক্রমাগত ডেকেছে কাক। তবে
খুব ভোরবেলা কোনও কোনও
পাখির কিচির-মিচির শুনেছি, এখনও শুনতে পাই।
এক যেন সেদিন বলল, এ পাড়ায় কোকিল দেখেছে।
বিশ্বাস করতে পারিনি, তা’হলে
দশ বছরে কোনও বসন্তেই কোকিলের গান কেন
ভেসে এল না আমার কানে, হৃদয়ে?
বৃক্ষ হন্তারকদের নির্দয়তা কোকিলদের
বিশ্রামকুঞ্জ ধ্বংস করে ফেলেছে। এ আমার গভীর বেদনা,
তবে কীটস-এর ‘ওড টু নাইটেঙ্গল’- এর মতো
কালজয়ী কবিতা কোকিলের গান বিষয়ে
না লিখেই মিশে যাব ধুলোয়, এই গভীরতম
বেদনা হৃদয়ে পুষে রাখতে হবে সকল সময়।
এ এক আজব খেলা
এ এক আজব খেলা দুনিয়াদারির
খেলার আড়ালে কত খেলা
কত ঝকমারি।
হুটোপুটি, লুটোপুটি চলে সারা বেলা,
নানাদিকে লাঠালাঠি চলে এক কাঠা
জমি নিয়ে, প্রাণ ঝরে গাছের পাতার মতো ধূলিঝড়ে।
এ খেলার অন্তরালে অন্য খেলা চলে,
এক কাঠা জমি, তেল নুন লাকড়ি যেখানে
অবান্তর। নিরিবিলি সে খেলা অধম
আমার মাথার অন্তঃপুরে চলে। সম্ভবত তার
একরত্তি দাম নেই কারও কাছে।
পেয়েছি কত যে দাগা, হাবিজাবি কত বেচাকেনা
চলে চারদিকে দেখি-এক কানা কয়,
বলেন লালন শুনি, আরেক কানারে,
চল দেখি যাই ভবপারে,
নিজে যে চেনে না পথ, অপরকে ঘন
কুয়াশায় দেখায় পথের দিশা অন্ধ ভরসায়।
নিজেকে চিনি না আজও, অথচ অন্যের
অন্তরের নির্ভুল খবরদারি করার ভড়ং
হাট-বাজারের ভিড়ে করছি জাহির। অকস্মাৎ
নিজের ভেতরে একজন ঘুমভাঙা কণ্ঠস্বরে
বলে কানে কানে-
অন্যদের ধোঁয়াশায় না রেখে বান্ধব
মরো বাঁচো নিজেকেই চুপিসারে সহি কথা বলো।
শোনো হে নজর দাও, তোমার মাথার সরোবরে
জ্যোৎস্নাময় জেল একজন রাজহাঁস
কাটছে সাঁতার, আর পাখা থেকে মুক্তো আর কত
অপরূপ নক্ষত্র ঝরছে অবিরাম, হে কবি অঞ্জলি ভরে নাও তুমি,
বৃথাই মরছ ঘেঁটে ধূলিকণা আর
ডাস্টবিন-উপচানো দুর্গন্ধ-ছড়ানো এঁটো কাঁটা!