বিচ্ছেদ
কোনো কোনো দিন
গভীর রাত্তিরে ঘুম ভেঙে গেলে, প্রায়শই ভাঙে আজকাল,
নিজেকে ভীষণ একা লাগে। যেন আমি
প্রাচীন ধ্বংসস্তূপে অত্যন্ত ভেতর থেকে জেগে
প্রথম দেখছি পৃথিবীকে।
‘কে তুমি এখানে এই আঁধার নিবাসে ব’সে আছে’,-
নিজেকেই প্রশ্ন করে খুব
বিচলিত হই। কাকে যেন ডেকে ডেকে
হৃদয়ের গলা ফেটে যায়, রক্তস্রোতে
আকাঙ্ক্ষার নৌকাডুবি বারংবার। অকস্মাৎ স্মৃতি,
প্রধান ফোয়ারা বুঝি এভেন্যুর, উচ্ছ্বসিত হয়! পলাতক
স্বপ্নেরা কখনো দূরে শূন্য উঠোনের
বৃষ্টিজালে ধরা-পড়া মাছ,
কখনোবা ধাবমান ঘোড়ার কেশরে মুক্তোমালা।
কেবলি বাড়াই হাত জাল আর কেশরের দিকে,
হাত ঝুলে থাকে
ফাঁসির মঞ্চের কোনো মৃতের জিভের মতো। কেউ,
মনে হয়, ছোরা থেকে নিচ্ছে মুছে রক্তের চিৎকার,
নিচ্ছে ধুয়ে অস্থিরতা বৃষ্টির গহন
জলে; ধু-ধু অন্ধকারে আমার কেবল ব’সে থাকা, চেয়ে থাকা,
কেউবা বিচ্ছেদ শব্দটিকে ঠেলে দেয়
আমার জানালা দিয়ে।
সারা রাত একা
জানালার চোখ থেকে টপকে টপকে পড়ে জল।
ভোট দেব
তোমার ভোটাধিকার আছে বলে ক’জন নিঝুম প্রজাপতি
ক্যানভাসারের মতো উড়ে যায় গহন দুপুরে
আমার চুলের গুচ্ছ ছুঁয়ে, কান ছুঁয়ে।
ব্যালটবাক্সের গায়ে বহুবর্ণ স্বপ্নের কামিজ ঢিলেঢালা,
নানান প্রতীক ওড়ে চতুর্দিকে। স্বর্ণকণ্ঠ পাখিরা এখন
কেবলি স্লোগান গায়, পরীদের নাচ জমে ওঠে
বেবাক ব্যালটবাক্স ঘিরে। ভোট দিন ভোট দিন
বলে দেবদূত কতিপয় পা দোলান দূরে অলীক কার্নিশে!
সহসা বিলোন তারা রঙিন পুস্তকা, ম্যানিফেস্টো;
করি না কখনো পাঠ। সেসব কাগজ, মনে হয়,
নীলিমায় উড়ে যাওয়া ভালো;
ওরা মেঘে গেলে পাবে ভিন্ন অবয়ব,
কিছুটা সত্যতা পেতে পারে।
কতবার ভোটকেন্দ্র ছেড়ে আমি
এসেছি নিজের খুব কাছে ফিরে, পা মেলে আপন
হৃদয়ে একলা চত্বরে,
নতুন প্যাকেট থেকে তাজা সিগারেট বের করে
খানিক ভেবেছি কারো কথা, ধোঁয়া ছেড়ে
ভেসেছি সমুদ্রে হোমারের আর যেহেতু ইউলিসিস নই,
এসেছি আবার ফিরে জীর্ণ ঘরে মশার গুঞ্জনে,
স্বপ্নের চিবুক ধরে শুয়ে থাকি, কখনো চেয়ারে ঢুলি আর
অকস্মাৎ তড়িঘড়ি ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা চাই বলে করি পায়চারি ঘরময়।
কখনো আমাকে ক্ষিপ্র শোঁকে স্বপ্ন, যেমন শশক লতাগুল্ম।
তবু আমি ভোটকেন্দ্রে যাব, বসব সহাস্য মুখে
নতুন কাপড়-ঘেরা এলাকায় প্রীত ম্যাজিশিয়ানের মতো,
হঠাৎ উড়িয়ে দেব রুমাল, পায়রা।
ব্যালট পেপারে খুব ঝুঁকে
আমি ভালোবাসাকেই ভোট দিয়ে ঘরে
কিংবা পার্কে যাব শিস বাজাতে বাজাতে।
মধ্যরাতে
পুরোনো দেয়াল ঘড়ি আওড়ায় গাঢ় মধ্যরাত,
মধ্যরাত শিরাপুঞ্জে বোনে সুর, যেনবা সরোদ
ঝংকৃত গুণীর হাতে। তন্দ্রার চুম্বন চোখে, হাত
থেকে আস্তে খসে যায় আক্ষরিক দান্তের নরক।
আমি কি হারাচ্ছি পথ মধ্যপথে? হায়রে নির্বোধ,
কেন তুই নিশীথকে করিস বিশ্বাস? কেন তোর
ঘরে এত মৃত গাংচিলের ভিড়? এ কেমন ঘোর
সত্তাময়? নিষ্প্রদীপ হৃদয়ের জটিল সড়ক।
অকস্মাৎ দেখি, গাংচিলের স্তূপ ফুঁড়ে তুমি এই
মধ্যরাতে অন্ধকার ঘরে এলে, আমি অনশনে
কম্পমান; রাত্রি-রাত্রি গন্ধ সারা শরীরে তোমার-
চোখে জ্যোৎস্নাপায়ী ট্রেঞ্চ, সেতু, বাগানের ফলভার
এবং নির্জন পথ। ছুটে যাই, বাঁধি আলিঙ্গনে,
ওষ্ঠের শিশির নিই। তারপর নেই, তুমি নেই।
মর্সিয়া
নিমেষেই প্রকৃতি ও মানুষের চোখ মুখ সুনসান, সিয়া,
চোখের, গাছের পাতা লতাগুল্ম কী ব্যাপক গাইছে মর্সিয়া!
মানুষ এসেই যায়
বহুদিন ধরে যাচ্ছি,কখনো আনন্দে, কখনোবা কায়ক্লেশে
অত্যন্ত কাতর পথ হাঁটি। মাঝে-মধ্যে
পান্থনিবাসের প্রেতায়িত নিরালায়
থাকি মধ্যরাতে; মধ্যরাতে মগজের
ভেতরে বেড়াল হয়ে ঘুমোয় পেলব, নিরিবিলি।
বহুদিন ধরে যাচ্ছি, কখনো হঠাৎ কোনোখানে
যাত্রা থেকে গেলে দ্বিপ্রহরে
কিংবা গোধূলিতে
আশেপাশে কুয়োতলা, কল খুঁজে নিই, জলপান করে দীর্ঘ
স্মৃতির মতন পথরেখা
স্মৃতিতে মিশিয়ে, অন্য তৃষ্ণা নিয়ে, আবার নিঃসঙ্গ পথচারী
আমার ফেরার কথা ছিল নিশীথের মৃত্তিকায়
কামিনী ঝরার আগে। সেই কবে রজনীগন্ধাকে
কথা দিয়ে চলে গেছি কতদিন ভাবলেশহীন,
কাঁটার খতরা ছিল পদে পদে, অথচ আমার
সৌজন্যসম্মত ভঙ্গি খায়নি কখনো টোল; শুধু
প্রত্যাবর্তনের গান ভুলে
অচেনা পথের দিকে চোখ রাখি বারংবার, সামনে বাড়াই
পদযুগ; পদযুগ ধূলিময়, বীণাধ্বনি, স্বপ্নের মহলে
মখমলে ঢাকা। মমতায় প্লুত কোনো মৃত্তিকায়
শেকড় লাগে না; এক বিন্দু থেকে আরেক বিন্দুতে
চলে যেতে হয় বলে চলে যাওয়া? অস্থায়ী ডেরায়
রাত্রিশেষে কাঠখড় ভস্মীভূত হ’লে, পাখিদের পাড়া খুব
নিঝুম বিবশ হ’লে শবব্যবচ্ছেদ মনে করে
আমি কি মুছি না চোখ? থাক,
শোকগাথা রচনায় কাজ নেই। রিক্ততার রুক্ষ তপোবনে
কেটে গেছে বহু বেলা, তপোক্লেস বেড়ে যায় ক্রমাগত; এবার সত্তার
সম্ভ্রম বাঁচিয়ে অন্ধকার
পথের আড়ালে পথ খুঁজে নেব, খুঁজব দিগন্তের অশ্বপাল।
আমার ফেলার কথা ছিল বনস্থলী থেকে খুব
কান্তিমান সাদা ঘোড়া বেরিয়ে আসার আগে; আমি
প্রত্যাবর্তনের প্রতিশ্রুতি রাখিনি বলে ওরা
সেই কবে থেকে ব’সে আছে পথপ্রান্তে, নদীতীরে।
মাঠে তাঁবু, কেউ কেউ অপেক্ষায় কাবু সন্ধ্যালোকে।
ওদের সবার জন্যে বীজ নিয়ে আসব বলেই
দিগন্তের দিকে মুখ রেখে ব’সে আছে বহুজন।
কেউ কেউ হাই তোলে, চুল টানে; ধনুকের ছিলার মতন
কেউ কেউ। মরমীয়াবাদী যেন কেউ কেউ, ওদের দু’চোখে
প্রতীক্ষার মতো কত প্রহর গড়িয়ে যায়, যায় নিত্য যায়।
‘সে আসবে’ বলে অনেকেই গল্পে মাতে, গেরস্থালি
ছিন্নমূল মানুষের গন্ধে ভরপুর। জ্যোৎস্না আর গীতধারা
একই স্রোতে মিশে যায়, কখনো দোলনা দুলে ওঠে
ঘুমপাড়ানিয়া গানে। আকাশ কবির
খাতার মতন সম্ভাবনাময়, কেউ দূর আকাশের দিকে
আঙুল দেখিয়ে বলে,-‘এই তো আমার কাঁথা, রুপোলি নকশায়
অর্থময়, আমি এর অনন্ত ঔদাস্য
সমর্থন করি। একজন বৃদ্ধ বলে,
প্রান্তরে দাঁড়িয়ে বলে, ‘যে গেছে সে প্রতারক,
আসবে না কস্মিনকালেও;
‘যদি সে কখনো আসে, আমার মাথায় মাবুদের
‘লানত আসবে নেমে, লিখে রাখো তোমরা সবাই।
একজন নারী তার চুলরাশি মেঘময় সন্ধ্যায় ছড়িয়ে
বলে মৃদুস্বরে, ‘যে গেছে সে বিশ্বাসঘাতক
‘হৃদয়ে পাথর তার, চক্ষুদ্বয় দাগাপ্রিয় খুব,
‘আসবে না, আমি চুল ছিঁড়ে নদীতীরে উন্মাদিনী হয়ে ছুটে
‘বেড়ালেও আসবে না খল, প্রবঞ্চক।
আমার ফেরার কথা ছিল পাখির চোখের মতো
লোকশ্রুত নৌকো ঘাটে লাগার আগেই।
ওদের ক্ষেতের জন্যে বীজ অত্যন্ত স্বপ্নিল হয়ে
প্রগাঢ় রয়েছে জমা আমার মুঠোয়, যতদিন যায় বীজ তত স্বপ্ন হয়।
সর্বদা জমিন ডাকে, বীজ কী প্রবল ছুটে যেতে চায় শূন্য
মৃত্তিকার প্রতি
আমার মুঠোর খোসা ছিঁড়ে। বীজ নিয়ে এসে দেখি
আমার আপন প্রত্যাবর্তনের পথে, রাত্তিরেই ফেরা, কোনো
মশালের চিহ্ন নেই, বাদ্যরব নেই, নেই নারীর বিস্ময়।
জমিনে ছিটিয়ে বীজ আমি স্বপ্ন হই, বীজ স্বপ্ন, স্বপ্ন সোঁদা
ধান গন্ধময়, বীজ মরালের ওড়াউড়ি, নিদ্রায় কাতর
ওদের ঘুমন্ত ওষ্ঠে, গালে বীজ চুমো খায়। প্রত্যাবর্তনের
পথে আমি দেখি এক কবির কঙ্কাল বর্ষাভেজা
হাওয়ায় দোদুল্যমান যূথিবনে, তার অক্ষিগর্ত যেন গায় গান-
মানুষ এসেই যায় শেষে নিরুদ্দেশ থেকে মানুষের আপন নিবাসে।