নিঃসঙ্গ শেরপা
পর্বতে উঠেই আমি পতাকা উড়িয়ে দেব ঠিক।
আরোহণে কী রকম কৃতী কিংবা আনাড়ি সে-কথা
অবান্তর, আরোহণই মুখ্য শুধু। চূড়ার সন্ধানে
উঠছি পর্বত বেয়ে ক্রামগত। দৃষ্টিতে এখন
বনশোভা নয়, নয় সমতলভূমির নিরালা
সৌন্দর্য অথবা ঘর গেরস্থালি। চক্ষুদ্বয়ে ভাসে
একটি শিখর শুধু দুর্গম শিখর সর্বক্ষণ।
কোনো প্রলোভন আর পারবে না ফেরাতে আমাকে।
মাঝে মাঝে ক্লান্ত লাগে, বড় অসহায়; পদযুগ
ক্ষতময়, তবু পাথরের বুকে লোহা ঠুকে ঠুকে
দড়ি বেয়ে উঠতেই হবে আরও বহুদূরে একা
অত্যন্ত বিপজ্জনকভাবে। অকস্মাৎ কখন যে
নামবে বিরূপ ধস, ভাবি প্রাণক্ষয়ী অবসাদে,
কখনো অকালমৃত শেরপাদের মনে পড়ে যায়।
নেকড়ের মুখে আফ্রোদিতি
হে নিশীথ, আজ আমি কিছুই করতে পারব না।
বই পড়া, চিঠি লেখা অথবা বন্ধুর পাশে ব’সে
নিবিড় আলাপ-আজ কিছুই হবে না। সারা রাত
নির্ঘুম কাটবে অতিশয়; আমি কি অসুস্থ তবে?
থার্মোমিটারের নেই প্রয়োজন; যদিও শরীর
পুড়ে যাচ্ছে তাপে, তবু নেবু পানি, বার্লি, তপ্ত জল
কমলালেবুর রস চাই না কিছুই আজ রাতে।
কোমল অনল আমি পান করে এসেছি এক্ষুণি।
আমার সম্মুখে ছিল একরাশ মদির স্নিগ্ধতা,
তবে আমি মিছেমিছি অনলের কথা কেন বলি?
রজনীগন্ধা কি আগুনের রেণু শিরায় শিরায়
তুমুল ছড়াতে পারে এই মতো, হে নিশীথ, বলো?
ঘর কি সমুদ্র হতে পারে? নইলে কী করে সেখানে
সহজেই আফ্রোদিতি আসে তার সমস্ত শরীরে
স্বপ্নের মতন ফেনা নিয়ে? যখন সে এলো ভেসে,
ঘরের দেয়াল মুছে গেল; গেল উবে আসবাব।
এ কাকে দেখেছি আমি? এত চেনা, তবুও কেমন
সুদূর অচেনা; তার কণ্ঠস্বরে কথা নয়, ঝরে
স্মৃতি, স্মৃতি গান হয় স্তব্ধতায়। সহসা বিদায়,
যেন স্বপ্ন জাতক্রোধে ছুড়ে দেয় ধুলায় আমাকে।
ব্যর্থ মানুষের মতো চেয়ে থাকি, ঘরের দেয়াল
ফিরে আসে, দেখি ঠিক মাথার ওপরে আছে ছাদ।
ত্র্যাশট্রেতে পোড়া সিগারেট, তার সত্তার সৌরভ
ঘরে, সে মুহূর্তে বন্ধ হতে পারত হৃদয়স্পন্দন।
আমি একজন রাগী মানুষের মতো আকাশকে
সে মুহূর্তে ছিঁড়ে-খুঁড়ে ফেলতে চেয়েছি। সূর্যাস্তকে
চেটেপুটে সাফ করে দিতে লাগে কতক্ষণ বলে
সেদিকেই দৌড়ে গেছি, দৌড়ুতে দৌড়ুতে ক্লান্ত বড়।
হে নিশীথ, আজ আমি কিছুই করতে পারব না।
আমার মগজে ফণিমনসার বন বেড়ে ওঠে,-
দেখি আমি পড়ে আছি যুদ্ধ-ধ্বস্ত পথে কী একাকী;
ভীষণ আহত আমি, নেকড়ের মুখে আফ্রোদিতি!
বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে
বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে একটি ব্রোঞ্জের মূর্তি, নিথর বিশাল,
মাটি ফুঁড়ে জেগে ওঠে গভীর রাত্তিরে!
মুখে শতাব্দীর গাঢ় বিশদ শ্যাওলা আর ভীষণ ফাটল,
যেন বেদনার রেখা। ব্রোঞ্জের অদ্ভুত চক্ষুদ্বয় খুব স্থির
চেয়ে থাকে অন্ধকারে; মনে হয়, ওরা কোনো দিন
দ্যাখেনি কিছুই,
যদিও দ্যাখার কথা ছিল শতাব্দীর মতোই ব্যাপক বহু কিছু।
কী যেন বলতে চায় সেই মূর্তি, কণ্ঠস্বর তার স্তব্ধতায়
টোকা দিতে চেয়ে
হাওয়ায় হারায়, দুটি হাত বুঝি ধরে রেখেছে অতীত কিছু।
ব্রোঞ্জমূর্তি প্রশ্ন চিহ্ন, উত্তরবিহীন; ঘাস ক্ষিপ্র চাটে তার পদযুগ।
বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে বনপোড়া একটি হরিণী
ছোটে দিগ্ধিদিক, তীব্র তৃষ্ণায় কাতর; জলাশয়ে মুখ রেখে
মরুর দুরন্ত দাহ মেখে নেয় বুকে এবং আপনকার
মাংস আর হাড়ের ভেতরে
সে ঘুমায় নিরিবিলি। বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে-জুয়ার টেবিলে
সহসা নক্ষত্র ঝরে, সন্ত সন্ত বলে জুয়াড়ীরা
শূন্যের উদ্দেশে
তোলে হাত, কখন যে হাত বেয়ে সাপ নেমে আসে,
উত্তেলনা হেতু
কিছুতে পায় না টের, ভাবে দ্রাক্ষালতা জীবনের
ওষ্ঠে দেবে ফেলে কিছু সোনালি মদিরা বেলাবেলি।
বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে ৫-মধ্যরাত্রির শহরে এক
সুনীল জাহাজ
সহজে প্রবেশ করে, নাবিকেরা গাঙচিল হয়ে
কলোনির, বাণিজ্যিক এলাকার ছাদে ছাদে ওড়ে,
একজন অন্ধ, ক্রূর, বণিকের হাতে বাজপাখি;
নগর পুলিশ অর্ফিয়ুস না কি বলে কেউ কেউ
করোটিতে তবলা বাজায়।
বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে মৃত শিশু মেঘে ভাসমান ক্ষমাহীন,
কার্পেটের তলা থেকে, জানালার পুরু পর্দা থেকে,
টেলিগ্রাম আর কিছু পুরোনো চিঠির তাড়া থেকে
এবং মাছের পেট থেকে নারী আর শিশু আসে ভেসে ভেসে,
মেহেদি পাতার ভিড় থেকে, বেলুনের ঝাঁক থেকে
নারী আর শিশু ভেসে আসে। বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে
পতাকার নিচে কত আহত প্রেমিক নতজানু
গোধূলিতে, চতুর্দিকে উন্মাদের পাদধ্বনি, কার সে বাঁশিতে
নস্টালজিয়ার মতো সুর, কী সুন্দর প্রাণী পথের ধুলায়
বিকলাঙ্গ, ক্লাউনের টুপি সবুজ ঘোড়ার পায়ে পায়ে ঘোরে,
ক্লাউন কফিনে ব’সে পিট পিট চেয়ে থাকে ভীষণ একাকী।
বৃষ্টি পড়ে রঙ-করা গালে তার, বৃষ্টি পড়ে মৃত্যুর পাহাড়ে।
বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে-কতিপয় লোক দেবদূতের নগ্নতা
বড় বেশি কাম্য ভেবে উন্মাদের মতো নগ্ন হয়ে যায়,
তরুণীর ওষ্ঠে বারবার চুমো খায় কর্কশ কঙ্কাল আর
লোহিত বনের ধারে পাথরের ঘোড়ায় সওয়ার
অত্যন্ত পাথুরে যোদ্ধা, স্তব্ধ অস্ত্রে চির-জ্যোৎস্না বয়।
বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে একজন অসুস্থ নৃপতি শয্যাশায়ী
একটি সোনালি খাটে, অলৌকিক ফলের আশায়
প্রহর ফুরায়, তাহলে কি দীপ নিভে যাবে গহন বেলায়?
কোন তেপান্তরে আজ হাঁপাচ্ছে বিশীর্ণ পক্ষীরাজ,
ভাবেন নৃপতি, চোখ বুজে আসে, তৃতীয় কুমার তার এখনও ফেরেনি!