তুই চোখে বন্ধ কর
তবে কি আমার চক্ষুদ্বয় বাস্তবিক অপরাধী?
কী লাভ দৃষ্টি খুঁত খুঁজে? আমি তো সৌন্দর্যবাদী,
অনাবাদী জমিনের স্তরে স্তরে ফুলের বিকাশ
সৃষ্টি করে নিই আর দীপ্র রক্ত-মাংসের উচ্ছ্বাস
দেখি কঙ্কালের কড়ি-সাদা হাড়ে। শবব্যবচ্ছেদ
করে যে নিকটে আসে তার সঙ্গে ত্র্যাপোলোর ভেদ
সহজে পাই না খুঁজে মাঝে মাঝে। আমার দু’চোখে
নাকি বড় বেশি ব্যাকুলতা খেলা করে, বলে লোকে।
বলো তো তোমরা কেন আমার চোখের অপরাধ
সর্বদা মুখস্থ করো? কেন শুধু বাধাও বিবাদ
আমার বোধের সঙ্গে? আমি গাছের ভিতরে গাছ
স্তনের আড়ালে ভিন্ন স্তন মাছের ভেতরে মাছ
দেখি বলে আমার এ চক্ষুদ্বয় অপরাধী আখ্যা
পায়, তবু রাত্রিময় সুনসান শ্মশানও কামাখ্যা
আমার দৃষ্টিতে আর কারো ঊরুভেজা ভেনাসের
সামুদ্রিক ঘ্রাণমাখা ঊরু। দৃশ্য দেখি বিনাশের।
যে মুখে সকাল মগ্ন, অপরাহ্ন সঙ্গীতমুখর,
রাত্রির নিঃশ্বাস বহমান, তার দিকে থরথর
হৃদয়ে প্রখর চেয়ে থাকি, বুঝি পড়লে পলক
দেখব না তাকে আর। অতীতের রুপোলি ঝলক,
বর্তমান, ভবিষ্যৎ চোখের সবুজে কম্পমান,
কবেকার একাকিনী স্রোত বয়ে যায় খরশান
আমার শরীর ছুঁয়ে, আমি হই নদী, ধু-ধু মাঠ;
কখনোবা পিপাসায় নিজের নিয়তি করি পাঠ
আমার চোখের নিচে জ্বলজ্বলে চোখের ভিতরে,
এবং কদম ফোটে সত্তার নিভৃত স্তরে স্তরে।
বাড়িকে ব্যথিত দেখি, পথকে প্রফুল্ল অতিশয়,
সুসময় ব্যেপে এলে, উৎসবের দীপাবলি নয়,
দেখি দুঃসময় দরজার কাছে রয়েছে দাঁড়িয়ে
ব্যগ্র অতিথির মতো। গেরস্থালি দেবে সে নাড়িয়ে।
যে আমার সঙ্গে থাকে অথবা থাকে না, দূরে থাকে,
যদি সে লুকায় মেঘে, গাছের ভিতরে, তবু তাকে
অক্লেশে দেখতে পাব-এই তো চোখের অপরাধ।
বুঝি তাই ওরা বলাবলি করে, লোকটা উন্মাদ।
সহজেই বাড়ে নিত্য আমার এ দেখার ভুবন-
দেখি কারো ধু-ধু জন্ম জন্মান্তরব্যাপী অনশন
অহর্নিশ জ্বলে সত্তাময়, কেউ দেয়ালে পেরেকে
ভীষণ রক্তাক্ত সাঁটা, কেউ কেউ স্বপ্ন ব্যতিরেকে
ঘোরে পথে বিপথে এবং সামনে তার ভগ্ন সেতু
দেখে কেঁপে ওঠে বারংবার। আমার দৃষ্টির হেতু
হয় না কারুর ক্ষতি। তাহলে একটি কণ্ঠস্বর
কেবলি আবৃত্তি করে কেন ‘তুই চোখ বন্ধ কর?’
দীর্ঘশ্বাস
শরীরের কত ধুলো লাগলে, কত কাঁটা বিঁধলে পায়ে
একটি দীর্ঘশ্বাস জন্ম হয়?
একটি দীর্ঘশ্বাস খুব বেশি
দীর্ঘ নয়, নিমেষেই শেষ হয়; অথচ তার জন্মলগ্ন
অতিশয় ইতিহাসময়। বিন্দু বিন্দু। বিষ ঝরে কণ্ঠনালিতে,
মোহন আগ্রহে তুমি হাত বাড়ালে
যার জন্যে, সে হারিয়ে গেল কুয়াশায়,
ভাবলে খোঁড়াতে খোঁড়াতে কোনোমতে
আরেকটু এগোলেই নেচে উঠবে প্রস্রবণ, কিন্তু
পদযুগ রক্তাক্ত করে সেখানে পৌঁছে দেখলে
ধুলোর পাহাড় ছাড়া কিছুই নেই;
এ রকম মুহূর্তেই একটি দীর্ঘশ্বাসের জন্ম হয়।
কতবার তুমি দীর্ঘশ্বাস ফেলেছ?
কতবার তোমার হৃদয়ে ঝাঁক ঝাঁক টিয়ের মৃত্যু হয়েছে?
তোমার মগজের ফুলের কেয়ারি শুকিয়ে গিয়েছে কতবার?
কতবার তোমার আকাঙ্ক্ষা করেছে আত্মহত্যা?
কতবার তুমি দীর্ঘশ্বাস ফেলেছ, কতবার?
যখন কোনো ঠোঁটের দিকে তোমার ওষ্ঠ ফুরোতেই
গোধূলির মতো বিদায়বেলা এসে যায়,
‘আবার হবে কি দেখা?’-এই নগ্ন ব্যাকুলতা
আবৃত্তি করেও যখন কোনো
স্পষ্ট উত্তর মেলে না,
যখন এক গা ধুলো নিয়ে, উষ্কখুষ্ক চুল আর
ভীষণ তৃষ্ণার্ত চোখ নিয়ে এসে দ্যাখো সে আসেনি,
তখন তোমার সত্তাময় কী শীতল দীর্ঘশ্বাস বয়।
নাছোড় অতিথি
বেশ কিছুদিন থেকে প্রত্যহ দেখছি পষ্ট তাকে।
আমার শোবার ঘরে শায়িত সে, স্পন্দনরহিত,
পতিত জমির মতো, যেখানে কখনো ফসলের
স্বর্ণশীষ গীতিকবিতার মতো করবে না গুঞ্জন।
কী করে এলো সে এই বেডরুমে, বলা মুশকিল।
আমার অস্বস্তি হয়ে সর্বক্ষণ আছে সে এখানে-
বড় বেশি নীল তার ঠোঁট, নাক, নখাগ্র বেবাক;
শরীরে কুঠার হানলেও নড়বে না এতটুকু।
সমস্ত শরীরে তার রাশি রাশি মাছির মতন
হিজিবিজি অক্ষরের ব্যান্ডেজ এবং হলদে কিছু
পাণ্ডুলিপি চুমু খাচ্ছে তাকে বারংবার, বুঝি তার
এমন চরম ঘুম ভাঙাতে ব্যাকুল। ঘরময়
মৃত্যুগন্ধ কর্পূরের মতো তীব্র। টেবিলে ডালিয়া,
ভাস-এ গোলাপের তোড়া; আমি ব্যাঞ্জো বাজিয়ে বাজিয়ে
নিদ্রিত মানুষটিকে বিস্মৃতির কন্দরে পাঠাতে
চাই প্রতিদিন, হায়, ব্যাঞ্জোধ্বনি, গোলাপ, ডালিয়া
থেকে মৃত্যুগন্ধ উঠে আসে। চেয়ে থাকি তার দিকে,
এই চেয়ে-থাকা যেন নিয়তি আমার। এতকাল
বলিনি কাউকে তার কথা। অতিশয় কৌতূহলী
প্রতিবেশীরাও আজও কিছুই পায়নি টের, শুধু
প্রত্যহ আমাকে দ্যাখে দূর থেকে আর কেউ কেউ
কখনো তাকায় আড়চোখে, পরস্পর কত কিছু
বলাবলি করে, চলে হাসাহাসি। আমার বিশ্বাস
সন্দেহ করে না ওরা কিছু। হয়তো ভাবে, ইদানীং
লোকটা বেজায় খাপছাড়া বটে, তা’ছাড়া মাথায়
কিছু ছিট ছিলই তো বরাবর। এটাই বাঁচোয়া।
এদিকে আমার বেডরুমে নিদ্রিত মানুষটির
পায়ে লতাগুল্ম জন্মে, শামুক বুকের শুষ্ক তটে।
কতদিন গেল কেটে, পুলিশকে দিইনি খবর-
যেন সে গোপন ব্যাধি, ভয়াবহ, কস্মিনকালেও
কাউকে যায় না বলা তার কথা। অথচ পাচ্ছি না
ভেবে কিছুতেই আজও কী করে লুকোব তাকে, কোন
পাতালে আসব রেখে। কখনো মাথার ঘাম পায়ে
ফেলে কংক্রিটের পুরু দেয়ালের অভ্যন্তরে তাকে
দুরু দুরু পুরে রাখি; যেমন ত্র্যালেন পো-র গল্পে
আছে, কখনোবা ব্লিচ করে হাওয়ায় মিলিয়ে দিই।
তবু সে আমার ঘরে শুয়ে থাকে সমস্ত শরীরে
ঘোর কালো নক্ষত্রের মতো অক্ষরের ভিড় নিয়ে।
তার পাশে ঠায় ব’সে থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়ে
কোনো কোনো স্তব্ধ মধ্যরাতে শাবল গাঁইতি হাতে
মেঝেতে সুড়ঙ্গ কেটে তাকে কাঁধে বয়ে নিয়ে যাই
সবার অলক্ষে বহুদূর একা-একা, পুঁতে আসি
মাটির অনেক নিচে। শিস্ দিতে দিতে ঘরে ফিরে
দেখি ঠাণ্ডা বিছানায় শায়িত সে নাছোড় অতিথি।