আমার ভেতরে এক বাঁশিঅলা
আমার ভেতরে এক বাঁশিঅলা বানিয়েছে তার
আপন নিবাস; সেখানে সে প্রতিদিন কী একাকী
তন্ময় বাজায় বাঁশি যখন তখন। রৌদ্রময়
দারুণ খরায় কিংবা গহন বর্ষায় তোলে সুর-
খুলে যায় অন্তহীন পথ, একাকী কে হাঁটে আর
ইচ্ছে হ’লে পথপ্রান্তে ছায়াকে খোঁচায় বাঁশি দিয়ে।
একজন সঙ্গী আছে তার, স্থূলোদর; মর্চেপড়া
পেরেকের মতো থাকে প’ড়ে এক কোণে কী নিঃসাড়।
যখন সে জেগে ওঠে, হৈ-হুল্লোড় করে বড় বেশি,
খাদ্য পেলে চক্ষুদ্বয় অতিশয় জ্বলজ্বলে হয়
তার, মাঝে-মধ্যে বলে, ‘অসীম তৃষ্ণায় বুক ফেটে
যাচ্ছে, দেখছ না। তার নখ বেড়ে যায় ক্রমাগত;
ঘুমোলে ভীষণ ডাকে নাক। বাঁশিঅলা সঙ্গীটিকে
নিয়ে সর্বক্ষণ খুব বিব্রত বলেই একা একা
পথ হাঁটে। কাক ডাকে, ঝরা পাতা দু’পায়ে মাড়িয়ে
যায় দূরে, যেন তার কোনো দুঃখ-কষ্ট নেই, যেন
হারাতে হয়নি কিছু কস্মিনকালেও। কানাকড়ি
পাবে না জেনেও স্তব্ধতার গালে গাল রেখে সুর
তোলে, মাঝে-মাঝে মনে পড়ে তার-সঙ্গীটির তীক্ষ্ণ
ক্ষুধা আছে, আছে তৃষ্ণা, আছে নিঃসঙ্গতা অন্তহীন।
আমার মুখস্থ হয়ে গেছে
আমার মুখস্থ হয়ে গেছে ধুলো, নুড়ি, ঝরা পাতা।
আজকাল বড় নত হয়ে চলি, মাথা
তোলা দায়। পোড়া মানব মাংসের গন্ধ শুঁকে শুঁকে
ক্লান্ত, শুতে যাই, অভ্যাসের দাস, ধুঁকে
ধুঁকে কোণঠাসা আর্ত পশুর মতন শুধু কাটাই সময়
আর বুলেটের গর্তময়
দেয়ালের মতো আকাশের দিকে চেয়ে থাকি, ঘুম
আসে না কিছুতে, পাড়া বেজায় নিঝুম।
আমার লোহিত ম্যান্ডোলিন
স্বপ্নের গহন লোকালয়ে একা হেঁটে যেতে যেতে
সেই কবে আমি পেয়েছিলাম একটি ম্যান্ডোলিন।
গভীর সোনালি ঝোপ থেকে রাজহাঁসের মতন
বাড়িয়ে নিস্তব্ধ গ্রীবা এসেছিল আমার নিকটে-
আমার আঙুলে চুমো খেয়ে একরাশ রইল ঝুলে
নিভৃত গলায় স্বপ্ন এবং অশ্রুত সুর নিয়ে।
কখনো বাজাই ওকে ভয়ে-ভয়ে, যেমন নিঃসঙ্গ
কেউ বন্দিনিবাসে বাজায় সুর খুব সাবধানে।
যখন পাখির রক্তে অজস্র বুদ্বুদ গান গায়,
সহসা ফুলের গন্ধে যখন ধুলায় প’ড়ে-থাকা
অত্যন্ত নীরব হাড় বেহালার আদল নিজেই
পেতে চায় অথবা যখন কোনো একাকী কুকুর
ডাগর চাঁদের দিকে মুখ তুলে প্রায় ভবঘুরে
প্রেমিকের মতো করে প্রহর যাপন, ম্যান্ডোলিন
দেয়ালের স্বপ্ন থেকে জেগে উঠে অন্য স্বপ্নে ডোবে,
রাত্রিকে পরায় কত সুরময় স্বপ্নিল কাতান।
যমজ ভায়ের মতো আমরা দু’জন সর্বদাই
আছি কাছাকাছি, অবিচ্ছিন্ন, আমি আর
আমার লোহিত ম্যান্ডোলিন। প্রহরে প্রহরে বাজে
সত্তা তার, সুরে কোন ভূগর্ভস্থ নগরের মৃত
কলরব, কোনো খ্রিস্টপূর্ব শতকের সুন্দরীর
সোনালি শরীর, দীর্ঘশ্বাস, খনি আর টানেলের
অন্ধকার, জাহাজের ভগ্নাংশ এবং পথরেখা
জেগে ওঠে; কখনোবা বর্তমান বাজে ম্যান্ডোলিনে।
কোনো কোনো শেষ রাতে প্রেমিকার ছায়ার মতন
একটি নিঃশব্দ সুর আমাকে মাতিয়ে রাখে খুব,
এখন সে দূরবর্তী গাছের আড়ালে যেন ক্লান্ত
ডোরাকাটা চাঁদ, চাঁদ অকস্মাৎ নামে ম্যান্ডোলিনে,
নাচে তারে তারে, কাঁদে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে, বারে বারে
বিহ্বল আমাকে নিয়ে যায় জনশূন্য এভেন্যুতে।
দেখি স্তব্ধ চৌরাস্তায় এক অলৌকিক অর্কেস্ট্রায়
বাজিয়ে চলেছি আমি আমার লোহিত ম্যান্ডোলিন।
তবে কি এখন আমি অস্তরাগে মাতাল বাদক?
আহত এ-যুগ ঘন ঘন ছুড়ছে পা যন্ত্রণায়,
কষে ফেনা, চোখে তার দুঃস্বপ্নের ক্রূর ঊর্ণাজাল
এবং সেবার্থে তার আসে দলে দলে অন্ধ নার্স
চতুর্দিকে থেকে-কালো, সাদা, পীত, বাদামি; একাকী
আমি ছুটি দিগ্ধিদিক, কখনোবা ভাবি ক্লান্ত মনে-
আগুন লাগুক বনে, নামুক ব্যাপক ধস পথে,
আমৃত্যু আমাকে ম্যান্ডোলিনে তুলতে হবে সুর।
একজন কবি শুধু
মগজে পাখির ঘ্রাণ, টানেলের অন্তর্গত রূপ, বংশীধ্বনি,
হৃদয়ে অনেক প্রতিধ্বনিময় স্তর নিয়ে ঘুমায় বলেই
হয়তো-বা স্বপ্নে তার জ্বলজ্বলে কালো নীল সবুজ বাদামি
এবং ফিরোজা ঘোড়া, ভেলা,
একটি ইস্পাতি বাড়ি, বেহুলার রাঙা চেলী, উজাড় খামার
মিশে যায় আর গোরখোদকের নিঃশ্বাস হঠাৎ
লাগে যেন গালে ভোরবেলাকার স্বপ্নে। দীর্ঘ ঘাসে
কোদাল ঘুমিয়ে থাকে কর্পূর আতর ইত্যাদির স্মৃতি নিয়ে,
কোদাল ঘুমিয়ে থাকে, স্মৃতির মতন সাদা হাড়
আর মাটিমাখা করোটির স্বপ্ন নিয়ে
কোদাল ঘুমিয়ে থাকে, যেমন শ্রমিক তার হাড়ভাঙা খাটুনির পর,
কোদাল ঘুমিয়ে থাকে চুম্বনরহিত শুষ্ক ওষ্ঠের মতন।
‘হয়তো-বা স্বপ্নে’ এই শব্দ ক’টি মনে-মনে আউড়ে সে
নিজের ভেতরে যে-স্তব্ধতা থাকে, তাকে
নিঃসঙ্গ স্বজন ভেবে গাংচিল গাংচিল বলে মনের দ্বীপের
মাটিতে দবিজ লেখে নিভৃত দলিল।
‘হয়তো’ শব্দটি যেন থরথর চোখের নিবিড় পক্ষচ্ছায়া,
রোদে কম্পমান,
জ্যোৎস্নায় নিথর।
কখনো পাতার শিহরণ হয়ে আর কখনো-বা মাছরাঙা
পাখিটির চোখ হয়ে হৃদয়স্পন্দন হয়ে সদ্য প্রেমিকের জেনেছে সে
‘হয়তো’ হারিয়ে-যাওয়া যুবতী বোনের
প্রত্যাবর্তনের
ছায়াচ্ছন্ন আহত প্রত্যাশা,
‘হয়তো’ বেকার যুবকের দ্রুত কর্মখালি বিজ্ঞাপন পাঠ,
‘হয়তো’ পদ্মার বুকে শেষ রাতে জেলেদের জাল,
‘হয়তো’ টেবিলে খুব ঝুঁকে-থাকা কবির খাতার সাদা পাতা,
‘হয়তো’ অনেক দূরে স্মৃতিবিস্মৃতি মধ্যবর্তী ডাকবাংলো,
‘হয়তো’ রোদের আঙুলের স্পর্শে চকিতে শিউরে-ওঠা হ্রদ,
‘হয়তো’ শারদ আকাশের নীলে স্বপ্নবিন্দুর মতন কিছু
চকচকে কবুতর,
‘হয়তো’ হেমন্ত গোধূলিতে গুহাহিত
স্তব্ধ টেলিফোন,
‘হয়তো’ আপন শহরের শেষপ্রান্তে পরিত্যক্ত বাসডিপো,
‘হয়তো’ নির্জন গোরস্থানে পড়ে-থাকা ভাঙা বাঁশি,
‘হয়তো’ প্রাচীন চীনে কবির গভীর
সংকেতে মেদুর কোনো হাইকুর আভা,
‘হয়তো’ সমুদ্রতীরে অভ্রে-গড়া নিরিবিলি স্বপ্নের ফ্যাক্টরি।
‘হয়তো’ এখনও তার জীবনকে খানিক দুলিয়ে দেয় বলে
একটি ঘুমন্ত
সিংহকে জাগায় ভায়োলিনে ছড় টেনে
এবং পাড়ায় ঘুম গণ্ডারকে গিটারের সুরে।
সিংহের কেশরে আস্তেসুস্থে স্বপ্ন রেখে, রেখে কিছু আকাঙ্ক্ষার
রাধাচূড়া
দ্যাখে সে কখনো কোনো কোনো হ্যাংলা কলমের নিচে
বাংলা ভাষা তীরবিদ্ধ পাখির মতোই
আর্তনাদ করে।
কখনো-বা ময়লা পোস্টকার্ড স্নেহাশিস, শুভাশিস হয়, হয়
ব্যাকুল কুশল,
ভিন্ন ভিন্ন পোস্টকার্ড বকুলের মতো ঘ্রাণ নিয়ে
যে যার গন্তব্যে যায়। কোনো কোনো কার্ড মৃত গাংচিলের মতো
বাক্সে পড়ে থাকে সর্বদাই।
স্ট্রিটকার নর্তকীর মতো ক্ষিপ্র মুদ্রায় চঞ্চল চৌরাস্তায়,
পুলিশের হাতে কিছু সজীব গোলাপ গান গায়, গান গায়,
ভিখিরি বালক রুক্ষ ফুটপাতে একটি দুঃখিত কবিতার
পঙ্ক্তির মতন একা দুর্দশার ছায়ায় ঘুমায়।
কবর খননকারী যেন কালপুরুষ, একাকী গোধূলিতে
বিড়ি ফোঁকে ঘন ঘন, ঘাম মোছে কপালের, কোদালের মুখে
হীরের ঝলক দেখে হেসে ওঠে অকস্মাৎ, পা ঠোকে মাটিতে,
হাত দুটি মেলে দেয় আসমানে, কী যে খোঁজে, আর
বানায় কিসের তোড়া করোটির মতো;
কবর খননকারী কান পেতে শোনে কত খুলির গজল
এবং কখনো নিজে খনখনে গলায় পুরোনো গান গায়, গান গায়…
তিনজন দীপ্র ফিল্ড মার্শাল ম্যাপের দিকে তাকাতে তাকাতে
কিংবা কালো কফি খেতে খেতে
বিপুল বেলুন হয়ে মহাশূন্যে জমালেন পাড়ি, মারহাবা!
পাঁচজন অবসরপ্রাপ্ত খোঁড়া সৈনিক চায়ের কাপ থেকে অতীতের ক্বাথ করে পান। সাতজন বাজিকর অপরাহ্নে
সোৎসাহে বাজিয়ে ভেঁপু প্রজাপতি হয় এবং সতের জন
গলা-ফোলা, মঞ্চপ্রিয় জননেতা কী মোহন মাতলামি শেখাতে শেখাতে
নিমেষে গড়েন কত হিতবাদী ক্লাব, নামে বঞ্চনার ধস।
একজন কবি শুধু বারবার পুড়ে গিয়ে কেমন ধূসর
ভস্ম ফুঁড়ে পুনরায় নিঃশঙ্ক ওঠেন বেঁচে সতেজ পালক
নিয়ে বুকে, তারপর ‘শব্দ গান হও’ বলে স্বপ্নের গ্যারাজে
ব’সে একা-একা
লেখেন অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ কী তন্ময় রূপান্তরে।
পাশে তার চিতাবাঘ, ভায়োলিন এবং একটি সাদা হরিণ ঘুমায়।