হাহাকারে বন্দি
একটা কেমন সুনীল পাত্র উড়ছে শুধু উড়ছে।
দূরের মেঘে বাস চলে যায়,
অস্তরাগে যাত্রী মেশে।
মেঘে মেঘে কিংবদন্তি, ঢেউয়ের মাথায়
বোতলবন্দি গল্প কিছু বেড়ায় নেচে,
রাজার মতো পা ঝুলিয়ে বসব আমি শূন্যে।
হাত রেখো না আমার বুকে, ক্ষত আবার জ্বলবে।
ঘোর অবেলায় দেখা হলো,
হৃদয় জুড়ে ঝরা পাতা।
চোখে চোখে নিমেষ ফুরোয়, হঠাৎ শুনি
কণ্ঠে ছেড়ে ঝরনাধারা বললে তুমি-
এই যে শোনো, ভালো লাগে তোমার কিছু পদ্য।
মুখচোরা তুই পদ্য আমার যারে উড়ে শীঘ্র,
তার বাগানে যারে উড়ে,
আস্তেসুস্থে করগে ভ্রমণ
তার সে ভীরু চোখের পাতায়, স্তনের ছায়ায়,
অনিদ্র হে পদ্য আমার আয় না তাকে
ঘুম পাড়িয়ে চুমো খাগে তার ঘুমন্ত ওষ্ঠে।
আবার কেন তৃষ্ণা আমার গ্রাস করেছে সদ্য।
জলের কাছে গেলে ত্বরিত
জল স’রে যার অনেক দূরে
তীরের দিকে হাত বাড়ালে তীর থাকে না,
তাকে দেয়া চুমু আমার শূন্যে মিলায়,
আমি ঊষর হাহাকারে একলা থাকি বন্দি।
হিসেবনবিশ
হিসেবী সে নয় তবু নিয়ত হিসেব করে কাটে তার বেলা।
নিজের বিবর্ণ ঘরে কী কী আসবাব আছে, ক’টি ফটোগ্রাফ,
মানচিত্র কিংবা কত বই, দেয়ালে কখন ক’টি পোকা থাকে,
যায় বালিরঙ টিকটিকির জঠরে-সে হিসেব করে।
কখনোবা সিগারেট ধরিয়ে সন্ধ্যাকে আস্তেসুস্থে
পোড়ায় চিতার মতো, তৃষ্ণায় কাতর হ’লে গলা
নিমেষে ভিজিয়ে দেয় স্বপ্নের শিশিরে। অন্তরালে
সংখ্যা লেখে, সংখ্যা কাটে, স্বপ্ন লেখে স্বপ্ন কাটে হিসেবনবিশ।
হিসেবে কোথাও কোনো গরমিল থাকা ভালো নয়
ভেবে সে খাতার প্রতি আনুগত্যে ফেরেশতার পাখার মতন
জ্বলজ্বলে হয়ে ওঠে। আঙুলের ডগায় নাচিয়ে কী নির্মল
গণিতের গুঁড়ো, পায়ে পায়ে বাজিয়ে করোটি হরিণের কত
মহামারী ভুলে থাকে, চলে যায় পার্কে; কতিপয় এলোমেলো
নষ্ট মানুষের হর্ষধ্বনি, হৈ হৈ অশ্লীলতা শুনে কাটে ঘোর।
ফিরে আসে, ঘরে ব’সে আশা লেখে, আশা কাটে হিসেবনবিশ।
সতেজ আকাঙ্ক্ষাগুলি নিঃশব্দে জীবনপাত করে আর্ত ঘরে!
এ শহরে শতকরা কত লোক সমকামী আর প্লেটনিক
প্রেমিক ক’জন,
পৌরসভা কত ট্রাক পেলে এ শহর হবে স্বপ্নের শহর,
জীবনানন্দীয় ঘাস কতটুকু জমি কার করেছে দখল
এ শহরে, ছায়াচ্ছন্ন শহরতলিতে,
একটি সপ্রাণ বসন্তের জন্যে ক’ডজন কোকিল দরকার,
গোর খোদকের কাছে কত লাশ জমা দিলে
সড়কের মুখ রক্ষা হবে,
টি এস এলিয়টের ধূসর ওয়েস্টকোট, ভালেরির নিরঞ্জন প্রশান্ত দস্তানা,
নেরুদার চিলিময় ইতিহাসরঞ্জিত জ্যাকেট ক’হাজার
সুপার পার্কেটে লভ্য, এ হিসেব মেলাতে ব্যস্ত হিসেবনবিশ।
রাত্রিদিন একা-একা সে হিসেব করে তেরো বর্গমাইল জায়গায়
ক’জন সৈনিক কুচকাওয়াজ করতে পারে সকালের রোদে,
পঁচিশ মিনিটে ঠিক ক’টি ট্রেঞ্চ খোঁড়া যায়, বঙ্গোপসাগর
ঢেকে দিতে ক’হাজার রণতরী লাগবে এবং অকস্মাৎ
আণবিক আক্রমণ শুরু হলে তেজস্ক্রিয় ভস্ম থেকে মানব শিশুকে
বাঁচাতে প্রত্যেক দেশে কত ভূগর্ভস্থ আশ্রয় শিবির চাই,
ক’কোটি রেডিও আর্তস্বরে কেবলি রটাবে সেই
আত্মা-শুষে-নেয়া দুঃসংবাদ বিস্ময়?
পূর্ব পুরুষের হলদে জাবেদা খাতার ভাঁজে ভাঁজে
হিসেবের ঘনারণ্যে বিস্তর প্রমাদ
প্রাগৈতিহাসিক কিছু প্রাণীর মতন প্রকাশিত।
হিসেবের ফাঁকে ফাঁকে কেমন বেরিয়ে পড়ে তাদের ভণ্ডামি,
লোলুপতা, প্রতারণা, শঠতা ইত্যাদি,
যেমন খুনির ফেলে-আসা হত্যাচিহ্ন অকুস্থলে। পূর্ব পুরুষের সব
দলিল, জাবেদা খাতা বড় গোলমেলে। ক্লান্ত হিসেবনবিশ
এতদিনে জেনে গেছে, উল্টা-পাল্টা দলিলের শুদ্ধ পাঠোদ্ধারে
প্রকৃত আগ্রহী হ’লে পুনরায় পুরোপুরি হিসেব-নিকেশ করা চাই।
নইলে পদে পদে
প্রাক্তন ভ্রান্তির জের টেনে যেতে হবে
ক্ষেতের আইলে, ত্র্যাভেন্যুতে মগজের কোষে পুরষানুক্রমে।
নড়বড়ে ঘরে ব’সে একাকী সে সংখ্যা লেখে, সংখ্যা কাটে আর
হাতির মতন স্মৃতি নিয়ে, নিপুণ দর্জির মতো
সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দ্যাখে কোন ঘরে কত হয় জমা;
তবুও হিসেব তার খুব হিজিবিজি হয়ে যায় বারংবার।
একক দশক আর শতক সহস্র, সব কিছু মাতলামি করে করে
মুছে যায়, জাবেদা খাতায়
চোখের জলের মতো কিছু দাগ লেগে থাকে শুধু।
না, তোমাকে দিয়ে এ হিসেব মেলানো সম্ভব নয়।
কখনো, বলে সে মনে-মনে। অথচ আবার একা-একা হাতে
স্বপ্ন গুঁজে বেশ ঝুঁকে সংখ্যা লেখে, সংখ্যা কাটে। তার চতুষ্পার্শ্বে
পূর্ণিমার উজ্জ্বলতা ছাড়া কিছু নেই, চলে স্বচ্ছতা ছাড়া
কিছু নেই; দেয়ালের গর্ত এবং চৌকাঠ থেকে
ব্যর্থতা কুড়িয়ে জেনে নেয় সত্য মানে যেশাসের গাধা আর
গণিতের গুঁড়ো তার পায়ে চুমু খেয়ে খেয়ে গভীর সংগীতময় হয়।
হে আমার দীর্ঘ উপবাস
কোথায় রাখবে চোখ হে আমার দীর্ঘ উপবাস?
তুমি তো গুহায় আছ দীর্ঘদিন যোগাযোগহীন;
ঘাড় বেয়ে নেমে গেছে রুক্ষ কটা চুল, ওষ্ঠ যেন
খরা-কবলিত মাটি চক্ষুদ্বয় ভীষণ উজ্জ্বল-
ক্রমাগত উপবাসে হে আমার দীর্ঘ উপবাস
এ রকমই হয়, এরকম কম্পমান নিশিদিন।
কোথায় রাখবে চোখ হে আমার দীর্ঘ উপবাস?
এতদিন ফলমূল অথবা তণ্ডুল আশেপাশে
দ্যাখোনি এবং কেউ দেয়নি তোমার হাতে তুলে
ভরা পাত্র টলটলে, আহার্য ও পানীয়ের ঘ্রাণ
তুমি ভুলে গিয়েছিলে। এখন তোমার গুহাগাত্রে
কেমন কোমল ছায়া, মৃদু ঝরনাধ্বনি যাচ্ছে শোনা।
অবিরল; তুমি চোখ মেলে দ্যাখো দ্রাক্ষালতা খুব
কাছে এসে এই বর্তমানের মতন আলিঙ্গন
করছে তোমাকে নিরিবিলি। অতীত সজীব প্রাণী হয়ে
শুঁকছে তোমার পদযুগ, বুঝি চেখে নিতে চায়
ত্বকের উত্তাপ কিছু কিংবা হাড়ে উত্তুরে বাতাস
ছড়িয়েছে কত হিম পরখ করার লোভ তার।
হে আমার দীর্ঘ উপবাস, কতকাল পরে যাবে
পরবাসে পুনরায়? তোমার অসামাজিক রীতি
নদীতীরে কিংবা বনে পায় সমর্থন। খরস্রোতে
চোখ রেখে নদী হও, পর্বতারোহীর নিঃসঙ্গতা
বুকে পুষে গিরিচূড়া হয়ে যাও; হও প্রতীক্ষায়
তীক্ষ্ণ আরও, যেন বঞ্চনাকে ভালোবেসে অকাতরে
খুলে দিতে পারো মুঠি। এখন তোমার খুব কাছে
কত কিছু লোভনীয় রূপে এসে যাচ্ছে সাবলীল;
কোথায় রাখবে চোখ হে আমার দীর্ঘ উপবাস?
থাকবে কি চোখ বুজে? যে তোমার ধু-ধু উপবাসে
বইয়ে দেবে জলধারা, সে যদি গুহায় ছুটে আসে?
যদি সে পরিবেশ করে বিষলতা বারংবার?