যদি তুমি আসো
খুব ভোরবেলা উন্মুখ দুটি চোখ মেলে রাখি,
যদি তুমি আসো।
চৈত্র দুপুরে চোখ পুড়ে যায়, তবু চেয়ে থাকি,
যদি তুমি আসো।
কখনো গাছের পাশে গাছ হয়ে দাঁড়াই একাকী,
যদি তুমি আসো।
সন্ধ্যার বুকে হৃদয় আমার ছটফটে পাখি,
যদি তুমি আসো।
অন্ধকারের কেমন আবীর দুটি চোখে মাখি,
যদি তুমি আসো।
মধ্যরাত্রে স্বপ্নের স্বরে বারবার ডাকি,
যদি তুমি আসো।
বস্তুত আমি প্রহরে প্রহরে অনিদ্রা চাখি,
যদি তুমি আসো।
সে কোন গোপন জ্যোৎস্না-ঝালরে নৈরাশ ঢাকি,
যদি তুমি আসো।
রেস্তোরাঁর একটি টেবিলে
ওরা ক’জন যে ছিল রেস্তোরাঁর একটি টেবিলে
সেদিন, পড়ে না মনে। কেউ লম্বা, খর্বকায় কেউ,
মসৃণ কামানো কারো গাল, কারো মুখ যেন ঝোপ,
এক্ষুণি বেরিয়ে এলো বলে খরগোশ কিংবা পাখি।
একজন অনর্গল কথা বলে, অন্যজন বড়
বেশি চুপচাপ, কেউ মাথা নাড়ে ঘন ঘন, যার
পরনে পাঞ্জাবি তার বুঝি নস্যি নেয়ার অভ্যাস।
কেউ দ্রুত কী যে লেখে খুব ঝুঁকে, কেউবা টেবিলে
নিপুণ বাজায় তাল, কেউ শূন্য চায়ের বাটিতে
প্রাচীন রাজার বাড়ি দ্যাখে, রেস্তোরাঁয় অন্ধকার
ফুঁড়ে আফ্রোদিতি এলো ভেবে কেউ বারবার ওঠে
কাঠের চেয়ার ছেড়ে, কেউবা ভীষণ খিস্তি করে।
কারো দুঃখী মুখে ওড়ে এলোমেলো স্বপ্নভস্ম কত।
সময়ের হাতে সমর্পিত, বিচ্ছিন্নতা বোধে ক্ষিপ্ত
ওরা কী-যে বলাবলি করেছিল সেদিন সন্ধ্যায়
রেস্তোরাঁয়, মনে নেই শুধু মনে পড়ে প্রত্যেকেই
বলেছিল-সবাইকে যেতে হবে, কেন যেতে হবে?
শতাব্দীর বিদীর্ণ হৃদয় থেকে
প্রত্যেকের কাছ থেকে আপনার সুখের অভাব
লুকিয়ে রাখাই চিরদিন
আমার স্বভাব।
কখনো চলতি পথে যখন জিজ্ঞেস করে কেউ
ভাবলেশহীন
বাড়িয়ে গেরস্ত হাত, ‘কেমন কাটছে দিন ইদানীং’, বলে-
ভালো, বেশ ভালো, পুনরায় পথ চলি
নিপুণ গোপন রেখে আমার প্রকৃত মনোভাব।
একদা স্বপ্নিল করিডরে যার শরীরের চন্দ্রোদয় দেখে
ছিলাম আচ্ছন্ন সারাক্ষণ তাকে ঝিল, ঝাউগাছ,
অথবা সোনালি মাছ
প্রাচীন হ্রদের কিংবা পাখি রূপে হৃদয়ের অভ্যন্তরে রেখে
বস্তুত সংসারকানা আজও আমি। আগে
অথবা অনেক পরে-কখনো সময় খুব করে প্রতারণা-
স্মৃতিকে গোধূলি শেষে বনভোজনের পোড়া কাঠ, বাসি খাদ্যকণা
ভেবে আপাতত এই অদ্ভুত শহরে করি বসবাস
কখনো বিরাগে, কখনো-বা অনুরাগে।
জানালার কাছে এসে শুনি ফুটপাত, গাছপালা,
পাবলিক লাইব্রেরি, নিউ মার্কেটের বাণিজ্যিক
পথ ল্যাম্পপোস্ট যেন স্বপ্নভঙ্গজনিত বিষাদে
ফেলে দীর্ঘশ্বাস।
যন্ত্রণা আমার অস্তিত্বের রুক্ষ বিদীর্ণ ভূ-ভাগে
নিয়ত প্রগাঢ় লেখে তার হিজিবিজি বর্ণমালা।
সহসা কখন কী-যে হারিয়ে ব্যাকুল দিগ্ধিদিক
কেবলি খুঁজতে থাকি। ফের বাঁশি বাজাবে কি উধাও বিশ্বাস
নিষ্ফলা প্রান্তরে, দগ্ধ বনে, জনশূন্য নদীতীরে,
অসুস্থ শহরে?
অনাহীরী শিশু আর পঙ্গু নারীদের সাদা পাখি নেবে তুলে
চঞ্চুর আশ্রয়? অনাথের ক্ষতি নিরিবিলি ঝরে
নক্ষত্রের আলো, তুমি কপটতা ছেড়ে দূস্থ ভিড়ে
মিশে গিয়ে জেনে নাও জগৎ-সংসার কবিতার
খাতা কিনা। সুখ চাই সুখ চাই বলে সত্তার নিভৃত মূলে
কখনো এনো না ডেকে বিষপিঁপড়ের ঝাঁক; তুমি
দূরত্ব আবৃত্তি করে যখন নিকটে চলে আসো কারো, তার
লতাগুল্মময় মনোভূমি
দুলে ওঠে, সোহাগের সিংহাসনে ব’সে পা দোলানো ভালো লাগে,
ভালো লাগে কবেকার ক্ষতচিহ্নে জ্যোৎস্নাধারা বয়ে
যেতে দেখে অবসরে। হঠাৎ আবার মগজের কোষে জাগে
পদহীন ভিখিরি দল, বন্ধ ঘরে কে এক উন্মাদ ভয়ে
জড়ো-সড়ো কিংবা নোংরা নখে দেয়ালে থেকে রোদ
মুছে ফেলবার জেদে দাঁতে দাঁতে ঘষে। ঘুরে দেখি, ডানপাশে
আর্কাইভ জেগে ওঠে-প্রাচীন দ্রব্যের স্তূপ থেকে
আস্তে একাকিনী নারী, কবে যেন হয়েছিল দেখা, উঠে আসে
ছড়িয়ে স্মৃতির মসলিন; একজন দার্শনিক মূল্যবোধ
বিষয়ে ভাবিত, হাতে তাঁর নষ্ট সভ্যতার ভগ্নাংশ, বিবেকে
প্রভূত পীড়ন, অলিন্দের খোলা হাওয়া চাই বলে
জংধরা চেয়ারের কাছ থেকে বাঁ দিকে দাঁড়ান সরে; কবি
করোটিতে সুরা পান করে খসখসে পাণ্ডুলিপি জ্বলজ্বলে
পাখির মতন দেন ছেড়ে। আর্কাইভে আরো কত মুখচ্ছবি
প্রাচীনতা ভেদ করে ঘাসে ঘাসে, আকাশে আকাশে
কেবলি রটাতে চায় বার্তা, একজন প্রেমিকের
মৃতদেহ গোলাপের গুচ্ছ হয়, ঝরে যায় ক্লান্ত প্রহরের
সঙ্গীত ফুরোলে, হে আমার আপন করুণ বিউগল
বাজো, বেজে ওঠো এ বিশদ সূর্যাস্তের ক্ষণে গভীর আশ্বাসে,
চেয়ে দ্যাখো শতাব্দীর বিদীর্ণ হৃদয় থেকে রক্তবিন্দু ঝরে অবিরল।
সে এক খননকারী
একমনে সে খুঁড়তে থাকে, খুঁড়তে থাকে মাটি।
অমন করে কেন যে সে অষ্টপ্রহর
খুঁড়ছে মাটি একা একা,
কেউ জানে না।
একমনে সে খুঁড়তে থাকে, খুঁড়তে থাকে মাটি।
মাঝে-মধ্যে কান পাতে সে মাটির অনেক নিচে
শোনার মতো গল্প কিছু আছে নাকি?
পোকামাকড়; হাড়ের গুঁড়ো
বলবে কিছু?
যখন তখন ওকে ঘিরে দাঁড়ায় এসে ওরা।
নখ দিয়ে তার মাটি খোঁড়া দ্যাখে সবিস্ময়ে।
অমন করে ক’হাত মাটি খুঁড়লে মেলে
খুব-লুকোনো স্মৃতিকণা?
কেইবা জানে?
কাউকে তুলে আনবে সেকি মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে?
রোদকে বাজায় দশ আঙুলে পুশিদা এক সুরে।
শেকড়-বাকড় উপড়ে ফেলে, পা মেলে দ্যায়
অনেক দূরে-যেন সে ঐ
আকাশ ছোঁবে।
জ্যোৎস্না চেটে নেয় তুলে সে রাতের শরীর থেকে।
ছায়ার ভেতর ছায়া হয়ে লুকিয়ে থাকে একা।
হঠাৎ কখন ছায়া ঝেড়ে নোংরা নখে
কিসের ঘোরে খুঁড়তে থাকে
শক্ত মাটি।
ছায়ার ভেতর ছায়া খোঁড়ে, কেমন খননকারী?
কখন আবার খুঁড়তে থাকে অক্ষিগোলক দুটি,
খুঁড়তে থাকে নিজের রুক্ষ বুকের পাঁজর,
খুঁড়তে থাকে শরীরটাকে।
কেউ জানে না।
গভীরভাবে নিজেকে সে খঁড়তে থাকে শুধু।