মূকাভিনয়
আমরা মূকাভিনয় করি অনেকেই সারাক্ষণ,
আমাদের এ রকম করে যেতে হয় বহুকাল।
এত যে মূকাভিনেতা চুতষ্পার্শে আনাগোনা
করে নিত্য সারি সারি, তা দেখে অবাক মানি। তারা
হাঁটে, বসে, মাথা নাড়ে, কখনো দুদ্দাড় দেয় লাফ,
আবার ঝিমোয় কিছুক্ষণ। মাঝে মাঝে নেচে ওঠে
পুতুলের মতো ঠিক এবং ফুরোলে দম থামে
অকস্মাৎ কখনোবা নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকে গাঢ়
অন্ধকারে বহুক্ষণ, দেয়ালের আলেখ্য যেনবা।
আমি কি আলাদা কেউ? বস্তুত আমার প্রাতিস্বিক
ধরন রয়েছে কিছু-যেমন হাঁটার ভঙ্গি আর
সহসা আড়াল থেকে সকলের মুখোমুখি একা
দাঁড়ানোর ঢঙ কিংবা রৌদ্রের সহিত ব্যক্তিগত
যোগাযোগ, অন্ধকার টানেলে সুদীর্ঘ বসবাস।
আমিও মূকাভিনয় করি রাত্রিদিন। হাত-পা নাড়ি,
মাথায় চালাই হাত ঘন ঘন, ঠোঁট ফাঁক করে
হাসতে সচেষ্ট হই, চেয়ারে গা এলিয়ে মৃদুমন্দ
পা দোলাই বারংবার। অকস্মাৎ তীক্ষ্ণ আলো পড়ে
সারা মুখে, গাল বেয়ে পানি নামে। কেন এই উষ্ণ
জলধারা, কাউকেই জানাতে পারি না। প্রাণপণ
চেঁচিয়ে উঠতে চাই, শুধু ঠোঁট নড়ে এলোমেলো,
কখন হারিয়ে গেছে কণ্ঠস্বর, নিজেই জানি না।
কেবলি মূকাভিনয় করি এলেবেলে সারাক্ষণ,
এ রকম করে যেতে হবে দীর্ঘকাল, মনে হয়।
যখন আমার মৃত্যু হবে
যখন আমার মৃত্যু হবে, হবেই তো কোনো দিন,
তখন হয়তো তুমি রাত্রির শয্যায় ঘুমে লীন,
বালিশে স্খলিত খোঁপা, স্বপ্নময় ঘুমে অকস্মাৎ
উঠবে শরীর কেঁপে সুখঘোরে, পুরুষের হাত
তোমার কোমরে লগ্ন, সে-হাত দস্যুতা জানে খুব।
যখন আমাকে মৃত্যু অতর্কিতে বানাবে বেকুব,
তখনি হয়তো তুমি গল্পের আসরে বাছা বাছা
চালাক মন্তব্য দেবে ছুড়ে আর কাকে বলে বাঁচা
বলবে শিল্পিত সুরে। যখন আমার মৃত্যু হবে,
তখন হয়তো তুমি সমর্পিত দীপ্র কলরবে।
যখন আমার মৃত্যু হবে, হয়তোবা জানালার
বাইরে তাকাবে তুমি, একাকিনী যাবে বারান্দার
অন্ধকারে, আস্তেসুস্থে গাছপালা, নক্ষত্রের তোড়া
দেখবে, বসবে এক কোণে; সহসা নিঃসঙ্গ ঘোড়া
তোমার হৃদয় জুড়ে খুরে ওড়াবে রঙিন ধূলি
এবং তোমার দিকে ফ্লাওয়ার ভাসের ফুলগুলি
নিঃশব্দে থাকবে চেয়ে অপলক; হয়তোবা যাবে
খাবার টেবিলে তুমি, নিরিবিলি প্লেয়ারে বাজাবে
পুরোনো দিনের গান। সেকালের কোনো কোনো গান
একদা আমার মধ্যে দিত গ’ড়ে স্মৃতির উদ্যান।
যখন আমার মৃত্যু হবে, হয়তোবা দ্বিপ্রহরে
শুয়ে শুয়ে নব্য নভেলের স্বাদ নেবে, হা-হা স্বরে
বাতাস প্রবল যাবে বয়ে, একজন স্বপ্নময়
উদভ্রান্ত কবির কথা হয়তো পড়বে মনে। ভয়
পেয়ে টেনে দেবে পর্দা জানালার? হয়তোবা
ছেলেটা পাশের ঘরে একা বসে মেঘ, বনশোভা
আঁকবে খাতায় কিংবা ছুটে এসে ধরবে জড়িয়ে
তোমাকেই, তুমি পিঠে দীর্ঘ চুল কোমল ছড়িয়ে
চিত্রবৎ; যখন আমার সত্তা অসাড়, তুহিন,
তখন হয়তো তুমি বুনে যাবে উল ক্লান্তিহীন।
যখন টেবিলে ঝুঁকে থাকি
যখন টেবিলে ঝুঁকে থাকি,
একটি নির্জন দীর্ঘশ্বাস, যেন ক্লান্ত পথচারী কোনো
আমার ঘাড়ের ধু-ধু একাকী প্রান্তরে
আস্তেসুস্থে ছড়ায় তুষার।
যখন টেবিলে ঝুঁকে থাকি,
একটি সোনালি সিংহ, তার চকচকে কেশর-দোলানো স্ফীত
গলায় ফুলের মালা, আসে দেয়ালের পলেস্তারা ফুঁড়ে, মুখ
থেকে ব্যাঞ্জো, রত্নরাজি, প্রেমিকের দীপ্র চোখ, সুন্দরীর মুখ বের করে।
যখন টেবিলে ঝুঁকে থাকি,
আমার আপন ঘরে সহসা প্ল্যাটোর গুহা জাগে;
গুহায় অনেক ছায়া, কম্পমান, গুহাগাত্রে একজন তার
আধপোড়া সিগারেট চেপে ধরে, কেউবা ঝোলায় পাণ্ডুলিপি।
যখন টেবিলে ঝুঁকে থাকি,
স্বপ্নের সবুজ লনে চারজন নিপুণ খেলোয়াড়
টেনিস বলের সাথে ঘন ঘন লাফিয়ে বেড়ায়,
র্যা কেট বাদামি ভায়োলিন হয়ে শূন্যে নেচে ওঠে বারংবার।
যখন টেবিলে ঝুঁকে থাকি,
ত্র্যালবাম থেকে কিছু ফটোগ্রাফ প্রবল বেরিয়ে দৃষ্টিপথে
কয়েকটি মুখ হয়। একজন বলে, ‘আমি দুঃখ হয়ে পুড়েছি সর্বদা’,
‘আমি যন্ত্রণাকে ছুটি দিয়েছি দিঘিতে সন্ধেবেলা’, বলে অন্যজন।
যখন টেবিলে ঝুঁকে থাকি,
টেলিফোন দেয়ালের সঙ্গে কথা বলে, বই নৈঃসঙ্গের সাথে,
নিশীথের সাথে চক্ষুদ্বয়। কোত্থেকে কেমন পাখি এসে বলে-
আমি তো তোমার নই, কারো নই, পুনরায় স্বপ্নের চিতায় চলে যাব।
যখন টেবিলে ঝুঁকে থাকি,
সংবাদপত্রের রাশি রাশি কালো অক্ষর ছাপিয়ে
আট কলামের পরপারে কতিপয় শীর্ণ মুখ শূন্য থালা,
প’ড়ে থাকে; ছাদ গুলিবিদ্ধ মানুষের মতো করে আর্তনাদ।
যখন টেবিলে ঝুঁকে থাকি,
পৃথিবীর মানচিত্র পর্দার মতন ঝোলে জানালায়,
সাবমেরিনের চূড়ো মেঝেতে চকিতে দেখা দেয়,
আমার সম্মুখে ব’সে চুরুট ফোঁকেন তেরোজন রাষ্ট্রদূত।
যখন টেবিলে ঝুঁকে থাকি,
সকালবেলার মতো কারো হাত, যমজ সোনালি
আপেল এবং টেলিফোন, প্রজাপতি, ফটোগ্রাফ, আসবাব
গান গায়, গান গায় কবিতার জাগ্রত পঙ্ক্তির কানে কানে।
যতবার আমি
যতবার আমি আকাশ শব্দটা উচ্চারণ করতে চাই,
কিংবা বৃক্ষ বলে ডাক দিই,
ততবার তোমারই নাম বলে ফেলি।
জানালার বাইরে তাকিয়ে যখন বলতে যাই, হে শহর-
তখনও তোমার নাম বেজে ওঠে আমার কণ্ঠস্বরে।
কবিতার কিছু পঙ্ক্তি আউড়ে শান্তি পেতে চাইলে
আমি কেবলি তোমার নাম আবৃত্তি করতে থাকি।
স্বপ্ন, তুমি অকস্মাৎ ফুরিয়ে যাও কেন-এই প্রশ্ন করতে গিয়ে
এই নির্ঘুম রাত্তিরে স্বপ্নে কথা বলার মতো
বারবার জিগ্যেস করি, তুমি কেমন আছ?