- বইয়ের নামঃ বাংলাদেশ স্বপ্ন দেখে
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অচেনার মধ্যে এই ডেকে যাওয়া
মারাত্মক ভুল হয়ে গেছে কি তোমার? প্রমাদের পাশাপাশি
থেকে তুমি নিজে
প্রমাদ গুনেছ কতবার, মনে পড়ে? উদ্ধার-রহিত তুমি
এবং স্বভাবদোষে প্রতিটি সকালবেলা সন্ধ্যা পান করো।
আনন্দোমেলাকে কালো ব্যাজ পরিয়ে বানাও দীর্ঘ শোকসভা
বারংবার আর
সমাজে থেকেও তুমি ভীষণ অসামাজিক, রুক্ষ হয়ে যাচ্ছ,
একাকীর চেয়েও একাকী।
তবে কি তোমার
নৈরাশের কেশপাশে বন্দি হতে ভালো লেগেছিল?
কী যে ভালো লাগে আর লাগে না তোমার, বোঝা দায়।
কখনো ফুলের পাশে দাঁড়াও এভাবে, যেন ফুল
ছাড়া কিছু আর নেই পৃথিবীতে, কখনোবা ক্রোধে
পুষ্পের ঘাতক হয়ে ঘোরো একা বাগানে বাগানে।
ঘোড়ার কেশরে হাত ডুবিয়ে দাঁড়াতে ভালো লাগে?
ভালো লাগে অন্ধকার ঘরে হুকে-আটকানো কোনো
কঙ্কালের দোলা কিংবা নীলিমায় বামন এবং
অপ্সরীর মেলামেশা? কোথাও ঘুণের কিছু চিহ্ন
দেখলে তোমার মুখ বিরক্তির কুশে ঢেকে যায়,
ভালোবাসাবাসি নিয়ে কেউ আদিখ্যেতা করলেই
তাকাও বঙ্কিম, ক্রূর হেসে ওঠো, আবার নিজেই
ভালোবাসা মানুষের প্রকৃত পতাকা জ্বলজ্বলে
বলে মগ্ন হও প্রেমে। টিন আর সিসার জঞ্জাল
ফুঁড়ে ক্লান্ত পরিবেশে একটি সারস এলে তুমি
ফিরিয়ে নেবে কি চোখ? হত্যাকারী হবে কি পাখির?
বুঝি ভালো লাগে খুব করোটিতে স্বপ্নের কম্পন।
এখানে তোমার কেউ নেই,
সেখানে তোমার কেউ নেই,
কোথাও তোমার কেউ নেই,
ব্যাপক ‘নেই’-এর মধ্যে যাকে
একান্ত তোমার বলে ভাব, সেও কি তোমার কেউ?
তুমি তো অবহেলিত অতিশয়, যেন বাংলা ভাষা। সেই কালো
অবহেলা মুছে নিতে পারে যে ওষ্ঠে অমাবস্যা দ্রুত
ঘনায় বেকলি।
তুমি তো বোতলে বাণী বন্দি করে দিয়েছ ভাসিয়ে লোনা জলে-
তরঙ্গে তরঙ্গে নেচে কোথায় যে যাবে কে তা জানে। কোনো দিন
হয়তো পড়বে
কারো আবিষ্কারপ্রিয় হাতে অথবা হারিয়ে যাবে দূরে চিরতরে।
এক্ষুণি বিদায় নিতে চাও? তুমি রুমাল উড়িয়ে চলে যাবে
এত শীঘ্র নিরুদ্দেশে? কেন যাবে এই পার্ক আর ঝলমলে
রেস্তোরাঁ বন্ধুর ডেরা, নিজস্ব চেয়ার,
বিমান, বলাকা ছেড়ে? অলৌকিক ঘণ্টার মতন
কারো কণ্ঠস্বর, বৃষ্টিভেজা নৈশ পথ, কত গীতিকবিতার
সোনালি কম্পন ছেড়ে নিরিবিলি সিঁড়ির গোলাপ
বারান্দা, পুরোনো চিঠি, ব্যাংক নোট, স্বপ্নময় টেলিফোন ছেড়ে
কেন যাবে এমন একাকী?
মৃত্যু ছাড়া সব কিছু মুঠি থেকে ঝরে যায় বলে
এক্ষুণি বিদায় নিতে চাও?
শহীদ মিনার আর ধারালো অস্ত্রের মতো মুক্তিযুদ্ধের গৌরব আর
স্বাধীনতা ছেড়ে দূরে বহুদূরে চলে যেতে চাও?
পুরোনো গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে ডাকছ ক্রমাগত,
আকাশ বধির,
ডাকছ, ডাকছ তুমি গলা ছেড়ে, হাওয়া মুছে ফেলে ডাক,
তোমার প্রবল ডাক প্রতিধ্বনি হয়ে ফেরে কিছুকাল, নদী উদাসীন,
নিয়ত ডাকছ তুমি, তোমার সে ডাক
খেয়ে ফেলে গাছ।
এ-ও কি তোমার ভুলে? না থেমো না, বেলাবেলি এই ডেকে যাওয়া
অচেনার মধ্যে এই ডেকে-যাওয়া গান হয়ে ঘুরবে
হয়তো মাঝে মাঝে।
অন্ধ দেয়ালের সাথে
তবে কি যাইনি ভুলে? এতদিনে সব কিছু ফিকে
হয়ে গেলে, খুব শূন্য পাখির বাসার মতো মন
হয়ে গেলে খড়কুটোহীন কার কী বলার ছিল?
সুদূর সকাল ডাকে, দুপুর হাঁপায় ঘন ঘন,
বিকেল হরিণ হয়ে আসে, খুরে তার বনস্থলী,
ঝিল, দিকচিহ্ন প্রকাশিত। রাত্রি, যেন ক্লিওপেট্রা,
অঙ্গবাস খুলে ফেলে অমর আকাঙ্ক্ষাগুলি করে
উন্মোচন, বুকে ক্ষুদ্র সাপের দংশন জেগে থাকে।
করতল থেকে কত বিশ্ব নিচে ভীষণ গড়ায়,
চোখের পাতায় ব্যেপে আসে সুনসান কত যুগ।
চায়ের সময় হল, সিগারেট কই? দেশলাই
প্রতিবার অতিশয় ব্যস্ত হয়ে খুঁজতেই হয়
পকেটে টেবিলে কিংবা একান্ত দেরাজে। সিগারেটে
আগুন ধরাতে গিয়ে অকস্মাৎ কী অন্যমস্ক
হয়ে পড়ি, পুনরায় তড়িঘড়ি ফস করে কাঠি
জ্বালাই এবং দূরে তাকাই ট্যুরিস্টবৎ আর
সহসা নিজের ট্রাউজারে, দেখি লেগে আছে কিছু
চোরকাঁটা কবেকার। মায়া লাগে, সস্নেহে বুলোই
হাত সেই শুকনো নৈসর্গিক কণাগুলির ওপর।
চায়ের পেয়ালা ঠাণ্ডা, আগুনের ফুলকি শিরাপুঞ্জে।
অতীত বাড়ায় গলা হৃদয়ের ভেতরে, যেন সে
রাজহাঁস, চঞ্চু ঘষে ঊরুতে আমার, ডানা তার
কেবলি আমাকে ডাকে মোহিনী স্বপ্নের ছায়াচ্ছন্ন
সুদূর নিবাসে, রাজহাঁসের নয়ন সারাক্ষণ
নিবদ্ধ আমার দিকে, বুঝি স্পষ্ট দেখে নিতে চায়
বেলাবেলি কতটুকু আমি আছি আমার ভেতরে?
তার গীতপ্রায় গ্রীবা ছুঁয়ে বলি-পথ যত দূরে
চলে যাক, হোক দীর্ঘ দুঃস্বপ্নের রাত্রির মতন,
হোক যত ভাঙাচোরা, পথ, তবু পথ চিরদিন
আমাকে শোনাও তুমি পান্থনিবাসের কলস্বর।
এখনও বিকেলে হেঁটে যেতে যেতে কেন বারংবার
পিছনে তাকাই ফিরে? কেন মন মরুর মতন
হয়ে যায় অকস্মাৎ? আছে কি এমন কেউ যার
শরীর স্পন্দিত হচ্ছে একা ঘরে এখন আমারই
পথ চেয়ে সারাক্ষণ? নাকি অন্তর্গত দুর্বলতা
ডেকে নিয়ে যেতে চায় যাত্রার বিন্দুতে পুনরায়?
উদ্দীপনা যত টেনে নিয়ে যাক দূরে মাঝে-মাঝে
পিছনে তাকাতে হয় আর কিছু দীর্ঘশ্বাস ফেলে
প্রতিবাদহীন চলে যেতে হয়-কোথায় যে যাওয়া-
অতিক্রম করে বৃক্ষশ্রেণী, ফুটপাত, লেক, সাঁকো।
কতিপয় উপরাজ ল্যাম্পপোস্ট পেরিয়ে এই যাওয়া
স্বপ্নের ভেতরে হেঁটে যাওয়ার মতন মনে হয়-
যেন আমি বড়ো বুনো লতাগুল্মময় পৌরাণিক
সমাধি ফলক থেকে সমাধি ফলকে যাচ্ছি একা!
যে-হাত এগিয়ে আসে করমর্দনের অভিলাষে,
সে-হাত বালির তৈরি, ঝরে যায় নিঃসীম সৈকতে।
ব্যাকুল আবৃত্তি করি প্রেমকথা কর্কশ আঁধারে
আর ভাবি আছে কেউ সুনিশ্চিত সেখানে আড়ালে,
অথচ পাই না সাড়া কিছুতেই। তবে কি এভাবে
অন্ধ দেয়ালের সাথে কথা বলে যাব একা একা?