Site icon BnBoi.Com

বন্দী শিবির থেকে – শামসুর রাহমান

বন্দী শিবির থেকে - শামসুর রাহমান

আন্তিগোনে

শহর-মরু বিজন বড়,
নীরব তো সব গায়ক পাখি।
আন্তিগোনে, আন্তিগোনে
রুক্ষ পথে ব্যাকুল ডাকি।

প্রেত নগরী নগ্ন, ফাঁকা,
নেই যে ভালো একটি প্রাণী।
দরদালানে, রাস্তা ঘাটে
ভাসছে শুধু মৃতের ঘ্রাণই।
আন্তিগোনে নামেই যেন
একলা চলার করুণ পথ।
আন্তিগোনে তুমিই জানি
বস্তু-ছেঁড়া নীল শপথ।

সান্ত্রী-সেপাই দিক পাহারা,
নগর-জোড়া থাক না ত্রাস।
তোমায় তবু শংকা কোনো
পারেনিকো করতে গ্রাস।

প্রহরীদের চোখ এড়িয়ে
খুঁড়লে মাটি ক্ষিপ্র হাতে,
সোদর তোমার তাই তো পেল
ক্ষণিক কবর ভুল প্রভাতে।

কোন সাহসে হেলায় তুমি
উড়িয়ে দিলে রাজার বিধান?
কিসের টানে রুদ্ধ গুহায়
আনলে টেনে দারুণ নিদান?

জানতে ক্রূর ক্রেয়োন তোমার
একনায়কী দণ্ড দেবে,
মৃত্যুপুরে দেবে ঠেলে-
দেখলে না তো একটু ভেবে।

সহোদরের ছিন্ন শরীর
করলে আড়াল সংগোপনে।
সৎকার সে তো উপলক্ষ,
অন্য কিছু ছিল মনে।

আন্তিগোনে দ্যাখো চেয়ে-
একটি দুটি নয়কো মোটে,
হাজার হাজার মৃতদেহ
পথের ধুলায় ভীষণ লোটে।

রৌদ্রে শুকার রক্তধারা,
মাংস ছেঁড়ে শবাহারী,
কে দেবে গোর দুর্বিপাকে?
নেই যে তুমি উদার নারী।

আমাদের মৃত্যু আসে

আমাদের মৃত্যু আসে ঝোপে ঝাড়ে নদী নালা খালে
আমাদের মৃত্যু আসে কন্দরে কন্দরে
আমাদের মৃত্যু আসে পাট ক্ষেতে আলে
গ্রামে গঞ্জে শহরের বন্দরে
আমাদের মৃত্যু আসে মাঠে
পথে ঘাটে ঘরে
আমাদের মৃত্যু আসে হাটে
সুডৌল ট্রাফিক আইল্যান্ডে ধু-ধু চরে

আমাদের মৃত্যু আসে কাদায় মাটিতে
আমাদের মৃত্যু আসে ধুলায় ধুলায় ঘাসে ঘাসে
পরিখায় বিবরে ঘাঁটিতে
আমাদের মৃত্যু আস বরিশাল, নোয়াখালী, কুষ্টিয়া, ঢাকায়
আমাদের মৃত্যু আসে কুমিল্লা, সিলেট, চাটগাঁয়
আমাদের মৃত্যু আসে প্লেনে চেপে, জাহাজ বোঝাই করে আসে
আমাদের মৃত্যু আসে সুপরিকল্পিত নকশারূপে
আমাদের মৃত্যু আসে ইসলামাবাদ থেকে
আমাদের মৃত্যু আসে কারবাইনে বারুদের স্তূপে
আমাদের মৃত্যু বিউগলে যায় ডেকে

আমারও সৈনিক ছিল

আমারও সৈনিক ছিল কিছু-
মাথায় লোহার টুপি, সবুজ ইউনিফরম পরা,
হাতে রাইফেল। শৈশবের বারান্দায় নিরিবিলি
কল টিপে দম
দিলেই চকিতে ওরা কুচ-
কাওয়াজে উঠত মেতে। কি নিরীহ ভঙ্গি-
মুখে হাসি আঁটা। থেমে যেত
দম ফুরুলেই। আমি বড়
ভালোবাসতাম শৈশবের
সেই সৈন্যদের।
একদা হঠাৎ
আমার অনুজ
একটি সৈন্যের ঘাড় ভেঙে ফেলেছিল বলে আমি
তার সঙ্গে তিন
আড়ি দিয়েছিলাম আজও তা মনে পড়ে।
আমার সুদূর শৈশবের
ক্ষুদে সৈনিকেরা আজ যেন তিন ডাইনীর মন্ত্রে
ভয়ানক দীর্ঘকায় হয়ে ট্রাকে জিপে
শহরে টহল দিচ্ছে। যখন তখন
তেড়ে আসে আমার দিকেই
উঁচিয়ে মেশিনগান আর আমি পালিয়ে বেড়াই
জাঁহাবাজ সৈন্যদের দৃষ্টি থেকে দূরে।
কী আশ্চর্য এখন ওদের প্রত্যেকের ঘাড়
গাছের ডালের মতো মটমট ভাঙতে পারলে
আমি ভারি আনন্দ পেতাম।

উদ্ধার

কখনো বারান্দা থেকে চমৎকার ডাগর গোলাপ
দেখে, কখনো-বা
ছায়ার প্রলেপ দেখে চৈত্রের দুপুরে
কিংবা দারুমূর্তি দেখে সিদ্ধার্থের শেলফ-এর ওপর
মনে করতাম,
যুদ্ধের বিপক্ষে আমি, আজীবন বড় শান্তিপ্রিয়।
যখন আমার ছোট্র মেয়ে
এক কোণে বসে
পুতুলকে সাজায় যতনে, হেসে ওঠে
ভালুকের নাচ দেখে, চালায় মোটর, রেলগাড়ি
ঘরময়, ভাবি,
যুদ্ধের বিপক্ষে আমি, আজীবন বড় শান্তিপ্রিয়।

যখন গৃহিণী সংসারের কাজ সেরে
অন্য সাজে রাত্রিবেলা পাশে এসে এলিয়ে পড়েন,
অতীতকে উস্‌কে দেন কেমন মাধুর্যে
অরব বচনাতীত, ভাবি-
যুদ্ধের বিপক্ষে আমি, আজীবন বড় শান্তিপ্রিয়।

আজন্ম যুদ্ধকে করি ঘৃণা।
অস্ত্রের ঝনঝনা
ধমনীর রক্তের ধারায়
ধরায়নি নেশা কোনো দিন।
যদিও ছিলেন পিতা সুদক্ষ শিকারি
নদীর কিনারে আর হাঁসময় বিলে,
মারিনি কখনো পাখি একটিও বাগিয়ে বন্দুকে

নৌকোর গলুই থেকে অথবা দাঁড়িয়ে
একগলা জলে। বাস্তবিক
কস্মিনকালেও আমি ছুঁইনি কার্তুজ।

গান্ধিবাদী নই, তবু হিংসাকে ডরাই
চিরদিন; বাধলে লড়াই কোনোখানে
বিষাদে নিমগ্ন হই। আজন্ম যুদ্ধকে করি ঘৃণা।
মারী আর মন্বন্তর লোকশ্রুত ঘোড়সওয়ারের
মতোই যুদ্ধের অনুগামী। আবালবৃদ্ধবনিতা
মৃত্যুর কন্দরে পড়ে গড়িয়ে গড়িয়ে
অবিরাম। মূল্যবোধ নামক বৃক্ষের
প্রাচীন শিকড় যায় ছিঁড়ে, ধ্বংস
চতুর্দিকে বাজায় দুন্দুভি।
আজন্ম যুদ্ধকে করি ঘৃণা।

বিষম দখলিকৃত এ ছিন্ন শহরে
পুত্রহীন বৃদ্ধ ভদ্রলোকটিকে জিজ্ঞেস করুন,
সৈনিক ধর্ষিতা তরুণীকে
জিজ্ঞেস করুন,
যন্ত্রণাজর্জর ঐ বাণীহীন বিমর্ষ কবিকে
জিজ্ঞেস করুন,
বাঙালি শবের স্তূপ দেখে দেখে যিনি
বিড়বিড় করছেন সারাক্ষণ, কখনো হাসিতে
কখনো কান্নায় পড়ছেন ভেঙে-তাকে
জিজ্ঞেস করুন,
দগ্ধ, স্তব্ধ পাড়ার নিঃসঙ্গ যে ছেলেটা
বুলেটের ঝড়ে
জননীকে হারিয়ে সম্প্রতি খাপছাড়া
ঘোরে ইতস্তত, তাকে জিজ্ঞেস করুন,
হায়, শান্তিপ্রিয় ভদ্রজন,
এখন বলবে তারা সমস্বরে, ষুদ্ধই উদ্ধার।

 উদ্বাস্তু

আমি কি কখনো জানতাম এত দ্রুত
শহরের চেনা দৃশ্যাবলি লুপ্ত হয়ে যাবে? একটি রাত্রিরে
আমার সারাটা মাথা বিষম রুপালি হয়ে যাবে?
কেমন বদলে গেছি অতি দ্রুত নিজেরই অজ্ঞাতে।
আমার চাদ্দিকে দরদালান কেবলি যাচ্ছে ধসে,
আমার সম্মুখে
এবং পেছনে
দেয়াল পড়ছে ভেঙে একে একে, যেন
মাতাল জুয়াড়ী কেউ নিপুণ হেলায়
হাতের প্রতিটি তাশ দিচ্ছে ছুড়ে। আমি
কত ধ্বংসস্তুপের ভেতর দিয়ে হাঁটি
করাল বেলায়। জনসাধারণ ছিন্ন
মালার মুক্তোর মতো বিক্ষিপ্ত চৌদিকে।
সমস্ত শহর আজ ভয়াবহ শবাগার এক। কোনোমতে
দম নিই দমবন্ধ ঘরে। জমে না কোথাও আড্ডা,
রেস্তোরাঁ বিজন। গ্রন্থে নেই মন, আপাতত জ্ঞানার্জন বড়
অপ্রয়োজনীয় ঠেকে। ঘর ছেড়ে পথে

পা বাড়াতে ভয় পাই। যেদিকেই যাই,
ডাইনে অথবা বাঁয়ে, বিষণ্ন স্বদেশে বিদেশীরা
ঘোরে রাজবেশে। রেস্তোরাঁয়, পার্কে, অলিতে-গলিতে
শহরতলিতে শুধু ভিনদেশী ভাষা যাচ্ছে শোনা।
বস্তুত বিষণ্ন এ শহরে হত্যাময় এ শহরে
স্বদেশীর চেয়ে বিদেশীর সংখ্যা বেশি। নাগরিক
অধিকারহীন পথ হাঁটি, ঘাড় নিচু, ঘাড়ে মাথা
আছে কি বা নেই বোঝা যায়। এই মাথার ওপর
আততায়ী, শাসক সবার
আছে পাকাপোক্ত অধিকার। কেবল আমারই নেই।

যদিও যাইনি পরবাসে, তবু আমি
বিষণ্ন উদ্বাস্তু একজন। ক্লান্ত মনে ধরে ঘুণ, শুধু ঘুণ।

এখানে দরজা ছিল

এখানে দরজা ছিল, দরজার ওপর মাধবী-
লতার একান্ত শোভা। বারান্দায় টব, সাইকেল
ছিল, তিন চাকা-অলা, সবুজ কথক একজন
দ্বারবন্দি। রান্নাঘরে থেকে উঠত রেশমী ধোঁয়া।

মখমল গায়ে কেউ, এঁটোকাঁটাজীবী, অন্ধকারে
রাখত কখনো জ্বেলে এক জোড়া চোখ। ভোরবেলা
খবর কাগজে মগ্ন কে নীরব বিশ্ব-পর্যটক
অকস্মাৎ তাকাতেন কাকময় দেয়ালের দিকে।

ভাবতেন শৈশবের মাঠ, বল-হারানোর খেদ
বাজত নতুন হয়ে। মুহূর্তে মুহূর্তে শুধু বল
হারাতেই থাকে, কোনো হুইসিল পারে না রুখতে।
ক্ষতির খাতায় হিজিবিজি অঙ্কগুলি নৃত্যপর।

এখানে দরজা ছিল, দরজায় ওপর মাধবী-
লতার একান্ত শোভা। এখন এখানে কিছু নেই,
কিচ্ছু নেই। শুধু এক বেকুর দেয়াল, শেল-খাওয়া,
কেমন দাঁড়ানো, একা। কতিপয় কলঙ্কিত ইট
আছে পড়ে ইতস্তত। বাঁ দিকে তাকালে ভাঙাচোরা
একটি পুতুল পাবে, তা ছাড়া এখানে কিছু নেই।

ভগ্নস্তূপে স্থির আমি ধ্বংসচিহ্ন নিজেই যেনবা;
ভস্ম নাড়ি জুতো দিয়ে, যদি ছাই থেকে অকস্মাৎ
জেগে ওঠে অবিনাশী কোনো পাখি, যদি দেখা যায়
কাবুর হাসির ছটা, উন্মীলিত স্নেহ, ভালোবাসা।

এরপরও

এরপরও আর ক’জন থাকবে টিকে?
ক’জন পারবে মৃত্যুকে দিতে ফাঁকি?
বিদ্বজ্জন দেশে নেই আর বাকি।
একি হত্যার তাণ্ডব চৌদিকে!

বন্ধুরা ক্রমে যাচ্ছেন দূরে সরে-
কেউ কেউ মৃত, অনেকে দেশান্তরী।
এই দুর্যোগে আমি কোন পথ ধরি?
কাঁটাতারে মুখ থুবড়ে থাকব পড়ে?

মৃত্যুর সাথে দাবা খেলি প্রায়-মৃত।
কোথাও একটি চেনা মুখ যদি দেখি,
বিস্মিত ভাবি, সত্যি ঘটনা একি?
করি সন্দেহ কাউকে দেখলে প্রীত।

আতংকময় শহরে অবিশ্রাম
মানুষ ঝরছে, যেন সব পচা ফল!
এখন ব্যক্তিগত চিঠি ঝলমল
করলে স্বস্তি, পেলে কোন টেলিগ্রাম।

কাঁটাতার

কাঁটাতার, কাঁটাতার।
ড্রাগনের বিষদাঁতের মতন
চৌদিকে কী যে সন্ত্রাস ছোড়ে
কাঁটাতার, কাঁটাতার।

কালো কাঁটাতারে, হায়,
বাঁধা পড়ে আছি আষ্টেপৃষ্ঠে;
চোখে-মুখে-হাতে, ক্ষণিক স্বপ্নে
কাঁটাতার, কাঁটাতার।

কাঁটাতারময় খুন।
যৌথ রক্ত ঝরছে কেবল,
চোখগুলো কাঁটাতারের আড়ালে
অন্য চোখের মতো।

এ ব্যাপক কাঁটাতারে
জীবন ঝুলছে, যেন ক্রুশকাঠ;
শহরে শহরে, ধু-ধু প্রান্তরে
কাঁটাতার, কাঁটাতার।

কাঁটাতারে বাঁধা চোখ।
ঘাসের ডগায়, এমনকি ঐ
তুচ্ছ কাকের দিকেও এখন
তাকাই না কিছুতেই।
কাঁটাতার, কাঁটাতার।
শুধু চেয়ে থাকি পায়রা রঙের
ভবিষ্যতের দিকে অপলক্ষ।
মুছবে কি কাঁটাতারে?

কাক

গ্রাম্য পথে পদচিহ্ন নেই। গোঠে গরু
নেই কোনো, রাখাল উধাও,রুক্ষ সরু
আল খাঁ-খাঁ, পথপার্শ্বে বৃক্ষেরা নির্বাক
নগ্ন রৌদ্র চতুর্দিকে, স্পন্দমান কাক, শুধু কাক।

কিছুই নেই

‌কী আছে আমার আজ? এমন কিছুই নেই যার
হিরন্ময়তায় দেবতার
দ্যুতি হবে ম্লান আর বিত্তবানগণ
হবেন আমার প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ।

বান্ধববর্জিত আমি, গুণীরা করেন অবহেলা
সর্বক্ষণ, ইতর সংসর্গে কাটে বেলা
এখন আমার। কেউ ডুগডুগি বাজায়,
করতালি দেয় আমার চান্দিকে, কেউ যায়
চলে বাঁকা দৃষ্টি ছুড়ে, কেউ দেয় শিস
যেন জাদুকরের বানর আমি আছি অহর্নিশ
খেলার দড়িতে বাঁধা। ভুল
খেলা দেখোনোর ফলে সারাক্ষণ দিতেছি মাশুল।

কী আছে আমার আজ? কিছু নেই, শুধু
বিভারিক্ত ধু-ধু,
পথপ্রান্তে আছি পড়ে, পরিত্যক্ত একা;
প্রার্থিত জনের দেখা
মেলে না কখনো। এমনকি কবিতাও
নিয়েছে ফিরিয়ে দৃষ্টি। নেই যেন কোথাও
সান্ত্বনার অমল উদ্যান। আমি আজ
আবহক্কুট প্রায়, কম্পমান, বাতাস বড়ই জাঁহাবাজ।

গেরিলা

দেখতে কেমন তুমি? কী রকম পোশাক-আশাক
পরে করো চলাফেরা? মাথায় আছে কি জটাজাল?
পেছনে দেখতে পাব জ্যোতিশ্চক্র সন্তের মতন?
টুপিতে পালক গুঁজে অথবা জবরজং ঢোলা
পাজামা কামিজ গায়ে মগডালে একা শিস দাও
পাখির মতন কিংবা চাখানায় বসো ছায়াচ্ছন্ন।
দেখতে কেমন তুমি?-অনেকেই প্রশ্ন করে, খোঁজে
কুলুজি তোমার আঁতিপাঁতি। তোমার সন্ধানে ঘোরে
ঝানু গুপ্তচর, সৈন্য, পাড়ায় পাড়ায়। তন্ন তন্ন
করে খোঁজে প্রতি ঘর। পারলে নীলিমা চিরে বের
করত তোমাকে ওরা, দিত ডুব গহন পাতালে।
তুমি আর ভবিষ্যৎ যাচ্ছ হাত ধরে পরস্পর।

সর্বত্র তোমার পদধ্বনি শুনি, দুঃখ-তাড়ানিয়া;
তুমি তো আমার ভাই, হে নতুন, সন্তান আমার।

গ্রামীণ

কেন তবে রক্তে উঠেছিল ঝড় উথাল পাথাল?
আমি তো ছিলাম দূরে অতিশয় শান্ত গ্রামে তাল-
তমালের ভিড়ে, মাঠে, নিসর্গের উদার ডেরায়।
কখনো দেখেছি আর্ত চোখে, হায়, ঘরের বেড়ায়
বেজায় ধরেছে ঘুণ, খুঁটি নড়বড়ে। তবু শক্ত
মুঠোয় লাঙল ধরে চষেছি কাজল জমি, রক্ত।
অবাধ্য শিশুর মতো হ’ত নতুন শস্যের ঘ্রাণে।
নোলক উঠত দুলে যার চিড়ে-কোটা তালে, প্রাণে
যে জন ফোটাত ফুল চম্পক আঙুলে, তার মুখ
ইঁদারার পাশে, ঘাটে দেখলেই হৃদয় কিংশুক।

হে রাখাল, হে দোতারা তোমাদের কাছ থেকে দূরে
কখনো পারিনি যেতে। আলুথালু পরাণ বধূরে
ফেলে রেখে গৃহকোণে বিরান কোথাও দরবেশী
আস্তানায় কম্বলে ঢাকিনি দেহ কিংবা পরদেশী
হইনি কড়ির লোভে। কেন তবে সহস্র বাসুকি
তুলল ফণা আমার তরুণ রক্তে? কেন ঠোকাঠুকি
অস্ত্রোশস্ত্রেও মগজের কোষে কোষে? আমিও হঠাৎ
কেন গণ্ডগ্রামে অস্ত্রাগারে ক্ষিপ্র বাড়ালাম হাত?
কখনো শুনিনি কোনো নেতার বক্তৃতা, কোনো দিন
যাইনি মিছিলে, হাতে তুলিনি নিশান। গণচীন,
মার্কিন মুল্লুক কার কেবা শক্র-মিত্র, এই তথ্যে
ঘামাইনি মাথা। আমার কী কাজ কূট তর্কে, তত্ত্বে?
যাকে ভালোবাসি সে যেন পুকুরে ঘাটে ঘড়া রোজ
নিঃশঙ্ক ভাসাতে পারে, যেন এই দুরন্ত ফিরোজ,
আমার সোদর, যেতে পারে হাটে হাওয়ায় হাওয়ায়,
বাজান টানতে পারে হুঁকো খুব নিশ্চিন্তে দাওয়ায়,
তাই মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও এই এঁদো গণ্ডগ্রামে
ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম কী দূর্বার সশস্ত্র সংগ্রামে।

 জনৈক পাঠান সৈনিক

কখনো জঙ্গলে কখনোবা খানাখন্দে ইতস্তত
বাঙ্কারে অথবা ক্যাম্পে উঁচিয়ে বন্দুক
ঘামে রক্তের গন্ধে কী প্রকার আছি
সর্বদা হত্যায় বুঁদ হয়ে-
বলা অবান্তর।
আমার স্মৃতিতে কোনো নিশান দোলে না
ক্ষণে ক্ষণে, দোলে না কামান কারবাইন।
এখন স্মৃতিতে
আমার সুদূর গ্রাম, ছোট ঘর, শিশু
চিঠি হাতে অশ্রুময় বিবি জেগে ওঠে বার বার
আলেখ্য স্বরূপ। দেয় হাতছানি আমার আপন সরহদ।
কেমন নিঃসঙ্গ লাগে মধ্যে-মধ্যে, যখন তাকাই
ডবকা নদীর দিকে, যুগল পাখির দিকে দূরে।

এ মুল্লুকে জিপসির মতো ঘোরে মৌত, বড় ক্ষিপ্র;
হচ্ছে ফৌত বেশুমার লোক, বড় নিরস্ত্র নিরীহ,
দেহাতি, শহুরে, দিনরাত। গ্রামে গ্রামে
দেয় হানা সাঁজোয়া বাহিনী, মানে আমরাই। যুবা,
বৃদ্ধ, নারী, শিশু
শিকার সবাই-চোখ বুজে ছুড়ি গুলি ঝাঁক ঝাঁক।
মনে হয়, যেন আমি নিজেই কাবিল।
কিছু বুঝি আর না-ই বুঝি, এটুকু ভালোই বুঝি
আমাদের সাধের এ রাষ্ট্র পচা মাছের মতন
ভীষণ দুর্গন্ধময় আর
ক্ষমতান্ধ শাসকের গদি সামলাতে
আমরা কাতারবন্দি ফৌজ সর্বদাই।

যে ক্যাপ্টেন আমাকে এগোতে বলে শুধু
বিপক্ষের দিকে,
হোক সে নিরস্ত্র কিংবা সশস্ত্র তুখোড়,
দেয় ঠেলে গায়েবী মৃত্যুর ঝোপঝাড়ে
নদীতে নালায়,
সে কি মিত্র কখনো আমার?
শক্র সে আমার সন্তানের,
আমার শয্যার শক্র সুনিশ্চিত জানি।

যুদ্ধে পক্ষ-বিপক্ষ থাকেই চিরকাল।
অথচ বুঝি না কিছুতেই
আমার মৃত্যুর পরে ফের
কোন দলে থাকব এই গুলিবিদ্ধ আমি?

তার উক্তি

এখন বালাই নেই র্ক্ষুৎ পিপাসার। গলাবন্ধ
কোটের দরকার ফুরিয়েছে এই শীতে। আত্মরক্ষা অর্থহীন,
অস্ত্রও লাগে না তাই। দেখুন সবাই সাদা চোখে
কিংবা ক্যামেরার যান্ত্রিক ওপার থেকে,
শহরের এক কোণে, শনাক্তের পরপারে উপাধিবিহীন
কেমন নিস্পৃহ শুয়ে আছি, কী প্রকার নিশ্চেতন,
রায়ের বাজারে।
এই যে করোটি দেখছেন, একদা এটাই ছিল
স্বীকৃত আমার দামি মাথা আর সেই মাথার ভেতর
নানাবিধ চিন্তা পুঞ্জ পুঞ্জ
মেঘের মতন সূর্যোদয় কি সূর্যাস্তে
মোহন রঙিন
এবং গভীর বিবেচনা-
সেখানে ফ্রয়েড, কার্ল মার্কস, রিল্কে, ডস্টয়ভস্কির
শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে ছিল না বাধা কোনো।
এই যে যমজ লাঠি, সরু, সাদা, এরাই আমার
দুটি বাহু, কোনো দিন কী আবেগে ধরত জড়িয়ে
দয়িতাকে। আর এই শূন্য জায়গাটায়
স্পন্দিত হৃৎপিণ্ড ছিল, যা ওরা নিয়েছে উপড়ে পাশব আক্রোশে
আর এই মাত্র যেটা লোভাতুর কুকুর শেয়াল
পালাল সাবাড় করে, একেই তো জানতাম আমার নিজস্ব
কণ্ঠ বলে, যে-কণ্ঠে ধ্বনিত হত বারংবার অসত্য অন্যায়
ইত্যাদির বিরুদ্ধে ঝাঁঝালো প্রতিবাদ, যে-কণ্ঠে ধ্বনিত হত
কল্যাণের, প্রগতির কী সজীব জিন্দাবাদ আর স্বাধীনতা, স্বাধীনতা।
এ জন্যেই জীবনের বৈমাত্রের দ্বিপ্রহরে হলাম কংকাল।

তার কোট

কী করত সে? যদি প্রশ্ন তোলে কেউ, বলা যায়, প্রায়শ নিশ্চুপ
থাকত কোথাও বসে। ক্রিয়ায় পাখির মতো অথবা গাছের অনুরূপ
ছিল সে-ও; হাতে প্রজাপতি এসে অনায়াস ঢঙে
মুহূর্তগুলোকে তার অনুবাদ করে নানা রঙে
উড়ে যেত। বিন্দুভর্তি বোর্ডের মতন
নৌকোময় নদী দেখে কখনো কাটত বেলা, বন
উপবন যেন তার পায়ে পায়ে লগ্ন আর হাজার হাজার
পাখি তাকে পাখিময়তার
বৃত্তান্ত শুনিয়ে যেত প্রত্যহ দু’বেলা। জানতাম
সে নয় সাধক কোনো সন্ত জটাধারী, পেশিও সুদৃঢ় থাম
নয় কোনো কর্মে বলিয়ান। জগৎ-সংসার
ছিল কি ছিল না সত্য অনুভবে, বোঝা দায়; তবু ক্ষুরধার
সত্যের সান্নিধ্যে যেতে চেয়েছিল বুঝি,
তাই আজও ঘাসে ঘাসে মরালপঙ্‌ক্তিতে তাকে খুঁজি।

এভাবে কুড়াত কুটো কিংবা নুড়ি, যেন কোন প্রাচীন রানীর
রত্নহার করতলগত তার, শহুরে পানির
ফোয়ারা শোনাত তাকে জলকিন্নরীর কত গান
বার বার, তার হাতে মাইক চকিতে কী অম্লান
অর্ফিয়ুস-বাঁশি হয়ে যেত। থাকত সে রোজ প্রতীক্ষায়
মোড়ে মোড়ে, যদি কেউ ডাকে ছলচ্ছল আকাঙ্ক্ষায়।

পরনে পুরোনো কোট শীতগ্রীষ্মে, নক্ষত্র প্রতিম
ছিদ্র ছিল কোটময়; বর্ণ তার পীত না রক্তিম,
বলা মুশকিল; সে তো পথবাসী। যখন উজাড় হ’ল পথ,
মেশিন গানের বন্য বর্বর চিৎকারে লুপ্ত সকল শপথ,

সে থাকে দাঁড়িয়ে অবিচল কী অবুঝ দৃষ্টি মেলে
চতুর্দিকে। পলায়ন অর্থহীন ভেবে অবহেলে

পকেট উল্টিয়ে দেয় চৌরাস্তায়-রাজার মুকুট,
স্বর্গের সোনালি নকশা ঝরে যায়, কোথায় কু’ফুট
জায়গায় ঘুমায় কারা, বুঝি ভাবল সে; দেখি
হঠাৎ মাথার খুলি তার চাঁদ হলো নীলিমায় এবং সাবেকি
কোট তার টুকরো টুকরো পড়ল ছড়িয়ে কী ব্যাপক, প্রতি খণ্ডে বরাভয়
স্ফুলিঙ্গ-অক্ষরে লেখা ‘আমি মৃত্যুঞ্জয়’।

তুমি বলেছিলে

দাউ দাউ পুড়ে যাচ্ছে ঐ নয়াবাজার।
পুড়ছে দোকানপাট, কাঠ,
লোহালক্কড়ের স্তূপ, মসজিদ এবং মন্দির।
দাউ দাউ পুড়ে যাচ্ছে ঐ নয়াবাজার।

বিষম পুড়ছে চতুর্দিকে ঘরবাড়ি।
পুড়ছে টিয়ের খাঁচা, রবীন্দ্র রচনাবলি, মিষ্টান্ন ভাণ্ডার,
মানচিত্র, পুরোনো দলিল।
মৌচাকে আগুন দিলে যেমন সশব্দে
সাধের আশ্রয়ত্যাগী হয়
মৌমাছির ঝাঁক
তেমনি সবাই
পালাচ্ছে শহর ছেড়ে দিগ্ধিদিক। নবজাতককে
বুকে নিয়ে উদ্ভ্রান্ত জননী
বনপোড়া হরিণীর মতো যাচ্ছে ছুটে।

অদূরে গুলির শব্দ, রাস্তা চষে জঙ্গি জিপ। আর্ত
শব্দ সবখানে। আমাদের দুজনের
মুখে আগুনের খরতাপ। আলিঙ্গনে থরথর
তুমি বলেছিলে,
‘আমাকে বাঁচাও এই বর্বর আগুন থেকে, আমাকে বাঁচাও’
আমাকে লুকিয়ে ফেল চোখের পাতায়
বুকের অতলে কিংবা একান্ত পাঁজরে,
শুষে নাও নিমেষে আমাকে
চুম্বনে চুম্বনে।

দাউ দাউ পুড়ে যাচ্ছে ঐ নয়াবাজার,
আমাদের চৌদিকে আগুন,
গুলির ইস্পাতি শিলাবৃষ্টি অবিরাম।
তুমি বলেছিলে,
‘আমাকে বাঁচাও।‘
অসহায় আমি তা-ও বলতে পারিনি।

তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা

তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা,
তোমাকে পাওয়ার জন্যে
আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়?
আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন?

তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা,
সকিনা বিবির কপাল ভাঙলো,
সিঁথির সিঁদুর মুছে গেল হরিদাসীর।
তুমি আসবে বলে হে স্বাধীনতা,
শহরের বুকে জলপাই রঙের ট্যাঙ্ক এলো
দানবের মত চিৎকার করতে করতে,
তুমি আসবে বলে হে স্বাধীনতা,
ছাত্রাবাস, বস্তি উজাড় হল। রিকয়েললেস রাইফেল
আর মেশিনগান খই ফোটালো যত্রতত্র।
তুমি আসবে বলে ছাই হল গ্রামের পর গ্রাম।
তুমি আসবে বলে বিধ্বস্ত পাড়ায় প্রভুর বাস্তুভিটার
ভগ্নস্তূপে দাঁড়িয়ে একটানা আর্তনাদ করল একটা কুকুর।
তুমি আসবে বলে হে স্বাধীনতা
অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের উপর।
তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা, তোমাকে পাওয়ার জন্যে
আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়?
আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন?

স্বাধীনতা, তোমার জন্যে এক থুত্থুরে বুড়ো
উদাস দাওয়ায় বসে আছেন-তাঁর চোখের নিচে অপরাহ্নের
দুর্বল আলোর ঝিলিক, বাতাসে নড়ছে চুল।
স্বাধীনতা, তোমার জন্যে
মোল্লাবাড়ির এক বিধবা দাঁড়িয়ে আছে
নড়বড়ে খুঁটি ধরে দগ্ধ ঘরের।

স্বাধীনতা, তোমার জন্যে
হাড্ডিসার এক অনাথ কিশোরী শূন্য থালা হাতে
বসে আছে পথের ধারে।
তোমার জন্যে,
সগীর আলী, শাহাবাজপুরের সেই জোয়ান কৃষক,
কেষ্ট দাস, জেলেপাড়ার সবচেয়ে সাহসী লোকটা,
মতলব মিয়া, মেঘনা নদীর দক্ষ মাঝি,
গাজী গাজী বলে যে নৌকো চালায় উদ্দাম ঝড়ে,
রুস্তম শেখ, ঢাকার রিক্‌শাওয়ালা, যার ফুসফুস
এখন পোকার দখলে
আর রাইফেল কাঁধে বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানো
সেই তেজী তরুণ যার পদভারে
একটি নতুন পৃথিবীর জন্ম হতে চলেছে-
সবাই অধীর প্রতীক্ষা করছে তোমার জন্যে, হে স্বাধীনতা।

পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত জ্বলন্ত
ঘোষণার ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলে,
নতুন নিশান উড়িয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগ্ধিদিক
এই বাংলায়
তোমাকে আসতেই হবে, হে স্বাধীনতা।

দখলি স্বত্ব

টিলার ওপর নয়, নদী তীরে নয়, এমনকি
পুকুর পাড়েও নয়, গলিতেই দাঁড়ানো আমার
একতলা বাড়ি।
হরিণ পাবে না খুঁজে বাড়ির তল্লাটে
অথবা কুকুর হতে সাবধান নামক নোটিশ
দেখবে না গেটে যদি আসো
হঠাৎ এখানে কোনো দিন। আসবাব-
পত্র জমকালো নয় মোটে, আছে শুধু
যা না থাকলেই নয়। তবু
আমার অত্যন্ত প্রিয় এই জীর্ণ বাড়ি। ভালো লাগে
এর সব ক’টি ঘর। একরত্তি উঠোনে যখন
শিশুরা উজ্জ্বল খেলে কিংবা
করে ছোটাছুটি
মিনিটে মিনিটে, ভালো লাগে,
বড় ভালো লাগে আর বাড়ির কোণের
সেই ছোট ঘর,
যেখানে রয়েছে পাতা খাট, বইময় একটি টেবিল,
যেখানে ঘুমাই, পড়ি, লিখি,
প্রুফ দেখি ইত্যাদি, ইত্যাদি,
সেই ঘর ছেড়ে অন্য কোনো ঘরে-
হোক তা যতই চোখ-ধাঁধানো, আয়েশী-
কখনো করব বসবাস, কিছুতেই
পারি না ভাবতে
অথচ আমার
বাড়ির দখলি স্বত্ব হারিয়ে ফেলেছি।
সব ক’টি ঘর জুড়ে বসে আছে দেখি
বিষম অচেনা এক লোক-
পরনে পোশাক খাকি, হাতে কারবাইন।

ধ্বস্ত দ্বারকায়

আবার ঘর ছেড়ে তুমি তো আসবে না।
বাইরে নীল শাড়ি যাবে না দেখা রাতে।
মধ্যরাতে আজ তোমার শয্যায়
তীব্র আগুনের ফুলকি নেই কোনো,
এখন তুমি ঘরে নিভাঁজ ঘুমে কাদা।
তোমার বুকে আর যমুনা দুলবে না?

দুয়ারে মঙ্গল কলস দুটি শুধু
প্রতীক্ষায় থাকে। রয়েছি আমি দূরে
পথের ধারে একা, নিসর্গেরই কেউ?
হয়তো আরেকটি বৃক্ষ বনানীর।
ঘুমের বনে মুখ রেখেছ ঢেকে তুমি,
আমার শিরা উপশিরায় টর্নেডো।

দৃশ্য থেকে চোখ ফেরানো দায় তবু।
কাঁপছে থর থর শেমিজ জ্যোৎস্নার-
মর্ত ঘাতকের অট্রহাসি বাজে
ঠেকাতে অক্ষম নানীর লাঞ্ছনা
ব্যর্থতার এই দারুণ দংশন
লুকিয়ে চলে যাব, ফেরারি যেন কেউ।
এখনও আঙুলের শীর্ষভূমি আর
দীর্ণ হৃদয়ের গুপ্ত তটরেখা
সুরের নন্দিত জোয়ারে যায় ভেসে।
অথচ অপারগ তুলতে কোনো সুর;
আমার বাঁশি এই ধুস্ত দ্বারকায়
নিয়েছে কেড়ে সেই দস্যু বর্বর।

 না, আমি যাব না

না, আমি যাব না
অন্য কোনোখানে।

আমিও নিজেকে ভালোবাসি
আর দশজনের মতন। সকালের
টাটকা মাখন-রোদে জেগে ওঠা, প্রাতরাশ সেরে
তুমুল আড্ডায় মাতা, চেনা রাস্তা দিয়ে
হেঁটে যাওয়া, রাত্রি জেগে বই পড়া, আলাপ জমানো
বন্ধুদের সাথে
আমারও অত্যন্ত ভালো লাগে।

আমিও নিজেকে ভালোবাসি
আর দশজনের মতন। ঘাতকের
অস্ত্রের আঘাত
এড়িয়ে থাকতে চাই আমিও সর্বদা।
অথচ এখানে রাস্তাঘাটে
সবাইকে মনে হয় প্রচ্ছন্ন ঘাতক।
মনে হয়, যে কোনো নিশ্চুপ পথচারী
জামার তলায়
লুকিয়ে রেখেছে ছোরা, অথবা রিভলবার, যেন
চোরাগোপ্তা খুনে
পাকিয়েছে হাত সকলেই।
জানি, গুপ্তচর
করছে অনুসরণ সারাক্ষণ। কখনো নিজেরই
ছায়া দেখে ভীষণ চমকে উঠি। রাজাকার, পুলিশ, জওয়ান
যারা খুশি তুলে নিয়ে যেতে পারে মধ্যরাতে অথবা দুপুরে
আমার সামান্য মৃতদেহ
বুকে নিয়ে বুড়িগঙ্গা বয়ে যেতে পারে নিরবধি।

তবু আমি যাব না কখনো
অন্য কোনোখানে। খুঁজব না
নিশ্চিন্ত আশ্রয়
অন্য কোনো আকাশের নিচে।

এখন পড়ে না চোখে চেনা মুখ কোথাও তেমন
কোনোখানে। কখনো চমকে উঠি দেখে
কাউকে নির্জন বাসস্টপে। মনে হয়,
চিনি তাকে, সান্নিধ্যে গেলেই
ভাঙে ভুল, মাথা হেঁট করে
পথ চলি পুনর্বার। বন্ধুরা অনেকে
দেশান্তরী, বস্তুত প্রত্যহ
হচ্ছে বাস্তুত্যাগী
সন্ত্রাসতাড়িত
হাজার হাজার লোক, এমনকি অসংখ্য কৃষক
আদি ভিটা জমিজমা ছেড়ে
খোঁজে ঠাঁই যেমন-তেমন ভিন দেশে।

তবু আমি যাব না কখনো
অন্য কোনোখানে
থাকব তাদের সঙ্গে এখানেই, বাজেয়াপ্ত হয়েছে যাদের
দিনরাত্রি, যন্ত্রণায় বিদ্ধ হয়ে সকল সময় সারিবদ্ধ
মৃত্যুর প্রতীক্ষা করা যাদের নিয়তি।

 পথের কুকুর

অবশ্য সে পথের কুকুর। সারাদিন
এদিকে ওদিকে ছোটে, কখনোবা ডাস্টবিন খুঁটে
জুড়ায় উঠরজ্বালা, কখনো আবার প্রেমিকার
মনোরঞ্জনের জন্য দেয় লাফ হরেক রকম।
হাড় নিয়ে মুখে বসে গাছের ছায়ায়,
লেজ নাড়ে মাঝে-মধ্যে ফুর্তিবাজ প্রহরের, কখনো
ধুলায় গড়ায়। কখনো সে
শূন্যতাকে সাজায় চিৎকারে

আমি বন্দি নিজ ঘরে। শুধু
নিজের নিঃশ্বাস শুনি, এত স্তব্ধ ঘর।
আমরা কজন শ্বাসজীবী।
ঠায় বসে আছি
সেই কবে থেকে। আমি, মানে
একজন ভয়ার্ত পুরুষ,
সে, অর্থাৎ সন্ত্রস্ত মহিলা,
ওরা, মানে কয়েকটি অতি মৌন বালক-বালিকা-
আমরা ক’জন
কবুরে স্তব্ধতা নিয়ে বসে আছি। নড়ি না চড়ি না
একটুকু, এমনকি দেয়াল-বিহারী টিকটিকি
চকিতে উঠলে ডেকে, তাকেও থামিয়ে দিতে চাই,
পাছে কেউ শব্দ শুনে ঢুকে পড়ে ফালি ফালি চিরে মধ্যবিত্ত
নিরাপত্তা আমাদের! সমস্ত শহরে
সৈন্যেরা টহল দিচ্ছে, যথেচ্ছ করছে গুলি, দাগছে কামান
এবং চালাচ্ছে ট্যাঙ্ক যত্রতত্র। মরছে মানুষ
পথে ঘাটে ঘরে, যেন প্লেগবিদ্ধ রক্তাক্ত ইঁদুর।
আমরা ক’জন শ্বাসজীবী-
ঠায় বসে আছি
সেই কবে থেকে। অকস্মাৎ কুকুরের
শাণিত চিৎকার
কানে আসে, যাই জানলার কাছে, ছায়াপ্রায়। সেই
পথের কুকুর দেখি বারংবার তেড়ে যাচ্ছে জলপাইরঙ
একটি জিপের দিকে, জিপে
সশস্ত্র সৈনিক কতিপয়। ভাবি, যদি
অন্তত হতাম আমি পথের কুকুর।

প্রতিটি অক্ষরে

আমার মগজে ছিল একটি বাগান, দৃশ্যাবলিময়।
কখনো তরুণ রৌদ্রে কখনোবা ষোড়শীর যৌবনের মতো
জ্যোৎস্নায় উঠত ভিজে। জ্যোৎস্নাভুক পাখি
গাইত সুস্নিগ্ধ গান, আমার মগজে ছিল একটি বাগান।
মদির অভিনিবেশে পাখি গান গেয়ে উঠলেই
শিরায় শিরায় সব দিকে
উঠত ঝিকিয়ে
নতুন কবিতাবলি মগজের রঙিন নিকুঞ্জে।
আমার সে সব কবিতায়
থাকত জড়িয়ে সেই উদ্যানের স্মৃতি।
এখন যা কিছু লিখি, কবিতা অথবা
একান্ত জরুরি কোনো চিঠি
কিংবা দিনলিপি,
এখন যা কিছু লিখি সব কিছুতেই
ভর করে লক্ষ লক্ষ গুলিবিদ্ধ লাশ।
প্রতিটি অক্ষরে আজকাল
প্রতিটি শব্দের ফাঁকে শুয়ে তাকে লাশ। কখনোবা
গোইয়ার চিত্রের মতো দৃশ্যাবলি খুব
অন্তরঙ্গ হয়ে মেশে প্রতিটি অক্ষরে।
প্রতিটি পঙ্‌ক্তির রন্ধ্রে রন্ধ্রে
বিধবার ধু-ধু আর্তনাদ
জননীর চোখের দু’কূলভাঙা জল
হু হু বয়ে যায়। প্রতি ছত্রে
নব্য হিরোশিমা, দাউ দাউ
কত মাই লাই।

আমার প্রতিটি শব্দ পিষ্ট ফৌজি ট্রাকের তলায়,
প্রতিটি অক্ষরে
গোলা বারুদের
গাড়ির ঘর্ঘর,
দাঁতের তুমুল ঘষ্টানি,
প্রতিটি পঙ্‌ক্তিতে শব্দে প্রতিটি অক্ষরে
কর্কশ সবুজ ট্যাঙ্ক চরে, যেনবা ডাইনোসর।
প্রতিটি পঙ্‌ক্তির সাঁকো বেয়ে
অক্ষরের সরু আল বেয়ে উদ্বাস্তুরা যাচ্ছে হেঁটে
সারি সারি, বিষম পা-ফোলা শুকনো গলা,
লক্ষ লক্ষ যাচ্ছে তো যাচ্ছেই,
প্রতিজন একেকটি হু হু দীর্ঘশ্বাস।
এখন আমার কবিতার
প্রতিটি অক্ষরে
বনবাদাড়ের গন্ধ, গেরিলার নিঃশ্বাস এবং
চরাচরব্যাপী পতাকার আন্দোলন।

 প্রতিশ্রুতি

কথা দিচ্ছি, তোমার কাছেই যাব, গেলে
তুমি খুশি হবে খুব, মেলে
দেবে ধীর অনাবিল আপন গ্রহণ সত্তা। আজ
আমাকে ডেকো না বৃথা। তোমার সলাজ
সান্নিধ্যে যাওয়ার মতো মন নেই। শহুরে বাগান
রাখুক দরজা খুলে, তোমার ত্বকের মৃদু ঘ্রাণ
পারব না নিতে। যখন সময় হবে দিচ্ছি কথা,
অঞ্জলিতে নেব তুলে মুখ-হে রঙিন কোমলতা।

আমাদের বুকে জ্বলে টকটকে ক্ষত,
অনেকে নিহত আর বিষম আহত
অনেকেই। প্রেমালাপ সাজে না বাগানে
বর্তমানে আমাদের। ভ্রমরের গানে
কান পেতে থাকাও ভীষণ বেমানান
আজকাল। সৈন্যদল অদূরেই দাগছে কামান।

আমাদের ক্ষত সেরে গেলে
কোনো এক বিনম্র বিকেলে
তোমার কাছেই যাবে হে আমার সবচেয়ে আপন গোলাপ,
করবো না কথার খেলাপ।

 প্রবেশাধিকার নেই

প্রবেশাধিকার নেই। এখন আমার আনন্দের
দুঃখের ক্রোধের
ক্ষোভের প্রেমের
প্রবেশাধিকার নেই মনুষ্যসমাজে।
আগে আমি আনন্দিত হলে
একটি কবিতা লিখে খাতার পাতায়
সেই আনন্দের ছায়াটিকে রাখতাম ধরে।
আমার শয্যার পাশে দুঃখ কোনো দিন
হাঁটু মুড়ে বসলে নিঃশব্দে
আমি তার ছবি শব্দে ছন্দে আঁকতাম খুব
বিষাদে আচ্ছন্ন হয়ে। ক্রোধান্বিত হলে,
ক্রোধের গরগরে চিহ্নগুলি থাকত ছড়িয়ে
দুর্বাসার মতো জেদী পয়ারের প্রতিটি সারিতে।
ভালোবাসা পল্লবিত বৃক্ষের মতন
কেমন দাঁড়াত ঋজু শব্দের অরণ্যে।

আমার আনন্দ, দুঃখ, ক্রোধ, ক্ষোভ, ভালোবাসা
নানান কবিতা হয়ে মানুষের কাছে
পৌঁছে যেত যথারীতি, এখন আমার আনন্দের
দুঃখের ক্রোধের
ক্ষোভের প্রেমের
প্রবেশাধিকার নেই মনুষ্যসমাজে।

এখন আমার ক্রোধ দুঃখ
আনন্দ অথবা ভালোবাসা কবিতার ছদ্মবেশে
কেবলি লুকায়
দেরাজের একান্ত কোটরে
নিভৃত আলমারি কিংবা সুটকেসে। যেন
ওরা পার্টিকর্মী,
গোয়েন্দা এবং পুলিশের
চোখে ধুলো দিয়ে
আড়ালে থাকতে চায় ধরপাকড়ের মরসুমে।

যথারীতি বিষম নিয়মপরায়ণ
কাক চেরে ঘুম ভোরে। শয্যাত্যাগী আমি
দাঁত মাজি, করি পায়চারি, মাঝে-মধ্যে
আওড়াই তর্জমায় এলিয়টি পঙ্‌ক্তি-
এপ্রিল নিষ্ঠুরতম মাস। প্রাতরাশ
যৎসামান্য, চা আর বাকরখানির গন্ধে
অভ্যস্ত গার্হস্থ্য দিন। সংবাদপত্রের মিথ্যা গেলি
একরাশ, তাকাই কখনো
আকাশের দিকে। অকস্মাৎ জঙ্গি জেট
ছিঁড়ে খুঁড়ে যায় নীলিমাকে।

নিরানন্দ ডালভাত নাকে মুখে গুঁজে
মন দিই আপিস যাত্রায়
বেলা দশটায়।
মুখের প্রতিটি খাঁজে সন্ত্রাস কাঁকড়া হয়ে আছে।
পথে দেখি,
ধাঁ করে একটি ট্রাক যাচ্ছে ছুটে, আরোহী ক’জন
চোখ-বাঁধা, হাত-বাঁধা আবছা মানুষ,
পাশে রাইফেলধারী পাঞ্জাবি সৈনিক।

ছাত্র নই, মুক্তিসেনা নই কোনো, তবু
হঠাৎ হ্যান্ডস আপ বলে
পশ্চিমা জোয়ান আসে তেড়ে
স্টেনগান হাতে আর প্রশ্ন দেয় ছুড়ে ঘাড় ধরে-
বাঙালি হো তুমি। আমি রুদ্ধবাক, কি দেব জবাব?

জ্যোতির্ময় রৌদ্রালোকে বীরদর্পী সেনা
নিমেষেই হয়ে যায় লুটেরা, তস্কর।
খুইয়ে সামান্য টাকা কড়ি,
শ্বশুর প্রদত্ত হাতঘড়ি কোনোমতে
প্রাণপক্ষী নিয়ে ফিরি আপিস-কন্দরে।

এদিকে বিষম
পানাসক্ত প্রেসিডেন্ট-ইনিও সৈনিক-
দিচ্ছেন ভাষণ
বেতার টেলিভিশনে, ঢুলু ঢুলু গলায় কেমন

গাইছেন গণ-
হত্যার সাফাই।
বিদেশী সংবাদদাতাগণ মিছেমিছি করছেন বাড়াবাড়ি
অর্থাৎ তিলকে তাল। লক্ষ লক্ষ নিরস্ত্র লোককে
নাকি তাঁর বীর সৈনিকেরা
কখনো করেনি হত্যা, পোড়ায়নি শহর ও গ্রাম।
সব ঝুট হ্যায়, সব ফালতু গুজব।
সত্যের মৌরসীপাট্রা একা তাঁরই। একেই তো বলে
কসাইখানার হেকমত। মাইরি হুজুর বটে
ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির।

দুনিয়ার সব শৃঙ্খলিত কৃষক মজুর শোনো,
সর্বহারা নিধনের জন্যে অবিরাম
আসছে বারুদ বোমা স্বৈরাচারী শাসকের
হাতে,
কখনো-বা, বলিহারি যাই, গুঁড়া দুধ।
খাসা কূটনীতি,
চীনা ও মার্কিন কালোরাতি।
বড় আটপৌরে এ জীবন,
প্রশংসা অথবা নিন্দা কিছুই জোটে না
এ পোড়া কপালে।
সত্যের বলাৎকার দেখে, নিরপরাধের হত্যা
দেখেও কিছুতে মুখ পারি না খুলতে।
বুটের তলায় পিষ্ট সারাদেশ, বেয়নেটবিদ্ধ
যাচ্ছে বয়ে রক্তস্রোতে, কত যে মায়ের অশ্রুধারা।

পাড়ায় পাড়ায় খাল কেটে
কুমির আনছে কেউ কেউ। রাত হলে,
এমনকি দিনদুপুরেই
কেবলি দৌরাত্ম্য বাড়ে রাজাকার, পুলিশ এবং
সৈনিকের। ধরপাকড়ের নেই শেষ। মাঝে-মাঝে
মধ্য রাতে নারীর চিৎকারে ভাঙে ঘুম,
তাকাই বিহ্বলা গৃহিণীর দিকে। ভাবি,
জান দিয়ে মান রাখা যাবে তা আখের?
তুমুল গাইছে গুণ কেউ কেউ কুণ্ঠাহীন খুনি
সরকারের, কেউ কেউ ইসলামী বুলি ঝেড়ে তোফা
বুলবুল হতে চায় মৃতের বাগানে।
কেউবা জমায় দোস্তি নিবিড় মস্তিতে
ভ্রাতৃঘাতকের সাথে। গদগদে দালাল,
বখাটে যুবক আর ভাড়াটে গুণ্ডারা
রটাচ্ছে শান্তির বাণী লাঠিসোটা নিয়ে।
অলিতে গলিতে দলে দলে
মোহাম্মদী বেগ ঘোরে, ঝলসিত নাঙা তলোয়ার।

নেপথ্যে মীরজাফর বঙ্কিম গোঁফের নিচে মুচকি হাসেন।

পড়শি

আমার বাড়ির ছোট্র এ পাঙ্গণে
সবত করে একটি ফুলের চারা।
খুরপি দিয়ে মাটি খুঁড়ে, ঢেলে
জলের ধারা লালন করি তাকে।

খুব শুকোলে চারার জিভের ডগা
এক নিমেষে আমার গলা মরু।
যখন চারা জল শুষে নেয় গলায়
তখন আমার ধু-ধু তৃষ্ণা মেটে।

গেলাম চলে সুদূর গণ্ডগ্রামে
ছোট্র আমার চারাটিকে রেখে
গর্জে-ওঠা মেশিনগানের মুখে।
আমরা এমন স্বার্থপরই বটে।

ফিরে এসে অবাক কাণ্ড একি
সেই চারাটি দুলছে দেখি সুখে।
সন্ত্রাসে সে যায়নি কুঁকড়ে মোটে,
বরং তেজী খুব উঠেছে বেড়ে।

 বন্দি শিবির থেকে

ঈর্ষাতুর নই, তবু আমি
তোমাদের আজ বড় ঈর্ষা করি। তোমরা সুন্দর
জামা পরো, পার্কের বেঞ্চিতে বসে আলাপ জমাও,
কখনো সেজন্যে নয়। ভালো খাও দাও
ফুর্তি করে সবান্ধব, সে জন্যেও নয়।

বন্ধুরা তোমরা যারা কবি,
স্বাধীন দেশে কবি, তাদের সৌভাগ্যে
আমি বড় ঈর্ষান্বিত আজ।
যখন যা খুশি
মনের মতন শব্দ কী সহজে করো ব্যবহার
তোমরা সবাই।
যখন যে শব্দ চাও, এসে গেলে সাজাও পয়ারে,
কখনো অমিত্রাক্ষরে, ক্ষিপ্র মাত্রাবৃত্তে কখনো-বা।
সে সব কবিতাবলি, যেন রাজহাঁস,
দৃপ্ত ভঙ্গিমায় মানুষের
অত্যন্ত নিকটে যায়, কুড়ায় আদর।

অথচ এ দেশে আমি আজ দমবন্ধ
এ বন্দি শিবিরে,
মাথা খুঁড়ে মরলেও পারি না করতে উচ্চারণ
মনের মতন শব্দ কোনো।
মনের মতন সব কবিতা লেখার
অধিকার ওরা
করেছে হরণ।

প্রকাশ্য রাস্তায় যদি তারস্বরে চাঁদ ফুল পাখি
এমনকি রানী ইত্যাকার শব্দাবলি
করি উচ্চারণ, কেউ করবে না বারণ কখনো।
কিন্তু, কিছু কিছু শব্দকে করেছে
বেইনি ওরা
ভয়ানক বিস্ফোরক ভেবে।
স্বাধীনতা নামক শব্দটি
ভরাট গলায় দীপ্ত উচ্চারণ করে বার বার
তৃপ্তি পেতে চাই। শহরের আনাচে-কানাচে
প্রতিটি রাস্তায়
অলিতে গলিতে
রঙিন সাইনবোর্ড, প্রত্যেক বাড়িতে
স্বাধীনতা নামক শব্দটি
লিখে দিতে চাই
বিশাল অক্ষরে।
স্বাধীনতা শব্দ এত প্রিয় যে আমার
কখনো জানিনি আগে। উঁচিয়ে বন্দুক
স্বাধীনতা, বাংলাদেশ-এই মতো শব্দ থেকে ওরা
আমাকে বিচ্ছিন্ন করে রাখছে সর্বদা।

অথচ জানে না ওরা কেউ
গাছের পাতায়, ফুটপাতে
পাখির পালকে কিংবা নারীর দু’চোখে
পথের ধুলায়
বস্তির দুরন্ত ছেলেটার
হাতের মুঠোয়
সর্বদাই দেখি জ্বলে স্বাধীনতা নামক শব্দটি।

 মধুস্মৃতি

দু’দশক পরেও স্ফটিক মনে পড়ে-
বৈশাখের খটখটে স্বেদাক্ত দুপুরে,
প্রথম কদম শিহরিত
আষাঢ়ের জলজ দিবসে
ব্রাউন পাখির মতো অঘ্রাণের রেশমি বিকেলে
ক্যান্টিনে ঢুকেই বলতাম তৃষ্ণাতুর,
মধুদা চা দিন তাড়াতাড়ি,
গরম সিঙাড়া চাই, চাই স্বাদু শীতল সন্দেশ।

ক্লাস শেষ হলে, লাইব্রেরি ঘরে না বসলে মন
আপনার ক্যান্টিনে আশ্রয় খুঁজতাম
বিবর্ণ চেয়ারে
চায়ের তৃষ্ণায় নয় তত
যতটা আড্ডার লোভে আমরা ক’জন।
একে একে অনেকেই জুটত সেখানে-
মদনরাজ্যের অনুগত প্রজা কেউ কেউ, কেউবা নবীন
সামন্ত প্রতাপশালী। কেউ
ক্ষীণকায়, প্রায় রোগী, কবি,
কেউবা বিপ্লবী নেতা, কেউবা বৃত্তিভোগী
মসৃণ দালাল। আমাদের কারো কারো
মনে ছিল ব্যাপ্ত কার্ল মার্কস-এর মহিমা।
টেবিলে টেবিলে কত তর্কের তুফান
যেত বয়ে, আপনি সামলাতেন শেড।

কাউন্টারে বসে হাসতেন মৃদু, নাড়তেন মাথা
মাঝে-মধ্যে। এক কোণে চেয়ারে এলিয়ে
কখনো আওড়াতাম ডানের তির্যক পঙ্‌ক্তি, সদ্যপড়া, আর
হ্যামলেটি স্বগত ভাষণে
উঠতাম মেতে লরেন্স অলিভিয়ারের মতোই।
নিজের কবিতা
দিতাম ব্যাকুল ঢেকে বন্ধুর শ্রুতিতে কখনো-বা। অন্য কোণে
বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদ অথবা বাঙালি মানসের বিবর্তন
উঠত ঝলমলিয়ে দিব্যি তার্কিকের
জাগর মনস্বিতায়। কখনো আবার
সাম্য মৈত্রী স্বাধীনতা ইত্যাদি শব্দের
কোলাহলে প্রবল উঠত কেঁপে শেড্‌।
কখনোবা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে, গণ-আন্দোলনে
থরথর শহুরে রাস্তায়

কি আশ্চর্য, যেত উড়ে আপনার অলৌকিক মধুর ক্যান্টিন।

আপনাকে মনে হতো বৃক্ষের মতন,
উদার নিরুপদ্রব ডালে যার কাটায় সময়
নানান পাখির ঝাঁক, তারপর সহসা উধাও
কত যে বিচিত্র দিকে ফেরে না কখনো।

আমতলা এখনও হৃদয়ে
সবুজ দাঁড়িয়ে আছে এখনও রোদ্দুরলিপ্ত পাতা
শিহরিত হয়, প্রতিবাদী সভা, উত্তোলিত হাত,
প্রখর পোস্টার
চকিতে ঝলসে ওঠে এখনও হৃদয়ে। এখনও তো
আমতলা, মোহন টিনের শেড, ক্লাসরুম আর
নিঝুম পুকুর পাড়ে জ্বলে
দামি পাথরের মতো আপনার চক্ষুদ্বয়।

আপনি ছিলেন প্রিয়জন আমাদের
বড় অন্তরঙ্গ নানা ঘটনায়

উৎসব এবং দুর্বিপাকে। বুঝি তাই
আপনার রক্তে ওরা মিটিয়েছে তৃষ্ণা।

আমাদের প্রিয় যা কিছু সবই তো ওরা
হত্যা করে একে একে। শহীদ মিনার
অপবিত্র করে, ভাঙে মর্টারের ঘায়ে,
ফারুকের সমাধিস্থ লাশ খুঁড়ে তোলে
দারুণ আক্রোশে
ছুড়ে ফেলে দেয় দূরে, কে জানে কোথায়।
বটতলা করে ছারখার।
আমাদের প্রিয় যা কিছু সবই তো ওরা
হত্যা করে একে একে।

আপনার নীল লুঙ্গি মিশেছে আকাশে,
মেঘে ভাসমান কাউন্টার। বেলা যায়, বেলা যায়

ত্রিকালজ্ঞ পাখি ওড়ে, কখনো স্মৃতির খড়কুটো
ব্যাকুল জমায়। আপনার স্বাধীন সহিষ্ণু মুখ-
হায়, আমরা তো বন্দি আজও-মেঘের কুসুম থেকে
জেগে ওঠে, ক্যাশবাক্স রঙিন বেলুন হয়ে ওড়ে।

বিশ্বাস করুন,
ভার্সিটি পাড়ায় গিয়ে আজও মধুদা মধুদা বলে খুব
ঘনিষ্ঠ ডাকতে সাধ হয়।

 মৃতেরা

কোথায় সে যুবা? কোথায় সে নির্ভীক?
কোথায় নাট্যবিলাসী অধ্যাপক?
কোথায় আত্মভোলা সে দার্শনিক?
কোথায় সে যার মাছ ধরা ছিল শখ?
খাকির ছাউনি শহরের মোড়ে মোড়ে,
মৃত্যু চালায় সুনিপুণ হারপুন।
ভীষণ ভাসছি ঘাতক ঢেউয়ের তোড়ে।
কে জানে কখন বয়ে যাবে কার খুন।

জেলায় জেলায় হত্যা ছড়িয়ে পড়ে,
যেমন প্লেগের বীজাণু চতুর্দিকে।
শহর উজাড়, গ্রামের প্রতিটি ঘরে
কালো পরোয়ানা মৃত্যু দিচ্ছে লিখে।
অথচ এখনও রাস্তায় চলে লোক।
দপ্তরও খোলা; বেশ্যা, গুপ্তচর
করে গিজগিজ। ভয়-আঁটা চোখ
অনেকের মুখে, শোকের তেপান্তর।
মৃতেরা সুশীল, মৃতেরা দয়ালু খুবই;
বড়ো ক্ষমাশীল। নইলে নিমেষে সব
গুঁড়ো হয়ে যেত, হত, হায়, ভরাডুবি;
নিভে যেত ঠিক নকল এ উৎসব।

যে-পথে আমার পদধ্বনি

যে-পথে আমার পদধ্বনি,
সে-পথ পুষ্পিত নয়। সে-পথ কণ্টকাবৃত বড়,
খানা-খন্দময়।
সে-পথে কখনো বুলবুলি
ওঠে না অমর্ত্য সুরে মেতে,
অথবা পাপিয়া।

যে-পথে আমার পদধ্বনি,
সে-পথে বাজে না দিলরুবা,
দামামাই বাদ্য একা সর্বদা সেখানে।

যে-পথে আমার পদধ্বনি,
সে-পথে বাজে না দিলরুবা,
ভয়াল ঘর্ঘর, ভগ্ন সেতু, আহতের চিৎকার,
পোড়া মাংস, কর্দমাক্ত জুতো আর উন্মত্ত আগুন।

দ্যাখো জীবকুল,
কী ভীষণ হিংস্র আমি, কী প্রকার ভয়ানক। দ্যাখো
আমার দু-হাত রক্তে লাল,
ধোঁয়াচ্ছে আমার নাক ঘন ঘন,
আমার চেয়ালে দ্যাখো ঝুলছে অসংখ্য মৃতদেহ,
আমার প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অঙ্কিত
কী বিচিত্র শব্দাবলি, করো পাঠ-
হত্যা প্রতিরোধ,
বিস্ফোরণ, দগ্ধ মাঠ, হাহাকার, উজাড় বসতি।

অথচ আমারই প্রতীক্ষায়
তোমরা বিছিয়ে রাখো দৃষ্টি
গ্রাম ও শহরে। পথে পথে
সাজাও তোরণ, করো নিবিড় বন্দনা।

যখনই প্রবল আমি আসি,
আমার দু-চোখে জ্বলজ্বল
ধ্বংস আর সৃষ্টি
কাঁপে পাশাপাশি;
আমি স্বাধীনতা।

রক্তাক্ত প্রান্তরে

এখন চরে না ট্যাঙ্ক ভাটপাড়া, ভার্সিটি পাড়ায়
দাগে না কামান কেউ লক্ষ্য করে ছাত্রাবাস আর।
এখন বন্দুক
ভানালার ভেতরে হঠাৎ
দেয় না বাড়িয়ে গলা অন্ধকারে জীবনানন্দীয়
উটের মতন। ফৌজি ট্রাক কিংবা জিপ
রাস্তায় রাস্তায়
পাগলা কুকুরের মতো দেয় না চক্কর। এখন তো
হেলমেটকে মানুষের মস্তকের চেয়ে
বেশি মূল্যবান বলে ভুলেও ভাবি না।

এখন বিজয়ানন্দে হাসছে আমার বাংলাদেশ
লাল চেলী গায়ে, কি উদ্দাম। গমগমে
রাস্তাগুলো সারাক্ষণ উজ্জ্বল বুদ্বুময়। শুধু আপনাকে,
হ্যাঁ, আপনাকে, মুনীর ভাই,
ডাইনে অথবা বাঁয়ে, কোথাও পাচ্ছি না খুঁজে আজ।
আপনার গলার চিহ্নিত স্বর কেন
এ শহরে প্রকাশ্য উৎসবে
শুনতে পাব না আর? সেই চেনা স্বর? ঝরা পাতার ওপর
খরগোশের মৃদু পদশব্দের মতন?
আপনার মতো আরও কতিপয় মুখ
চেনা মুখ আর
এখানে যাবে দেখা, যাবে না কখনো।

মনে পড়ে, জুনে জলে-ঘোলা পচা ডিমের বিশদ
কুসুমের মতো এক ঘোলাটে বিকেলে
এই শক্র প্লাবিত শহরে হ’ল দেখা।

আপনার সঙ্গে পথপার্শ্বে। দেখলাম,
আপনি যেনবা সেই জলচর পাখি,
ডাঙ্গায় চলতে গিয়ে ব্যর্থ,
হোঁচটে হোঁচটে
বিষম ক্ষতবিক্ষত, পরাজিত, দারুণ নিষ্প্রভ।
আমাদের সবার জীবনে
নেমেছে অকালসন্ধ্যা, হয়েছিল মনে,
আপনার চোখে চোখ রেখে।
তখন সে চোখে কবরের পরগাছার কী কর্কশ
বিষণ্ণতা আর হানাবাড়ির আঁধার
লেপ্টে ছিল, বারুদের গন্ধ ছিল সত্তায় ছড়ানো।

‘এই যে, কেমন আছ শামসুর রাহমান, তুমি?
খবর আছে কি কিছু?’-যেন আপনারই ছায়া কোনো
করল প্রশ্ন রক্তাক্ত প্রান্তরে। অসামান্য
বাগ্মীও কেমন আর্ত হন, হায়, বাক্যের দুর্ভিক্ষে,
বুঝেছি সেদিন।

আপনার চোখে বুঝি ফুটেছে অজস্র বনফুল,
নেমেছে জ্যোৎস্নার ঢল মুখের গহ্বরে, প্রজাপতি
পেলব আসন পাতে বৃষ্টি ধোয়া ললাটের মাঠে,
আপনাকে ঘিরে দৈনন্দিন
ঘাস আর পোকামাকড়ের গেরস্থালি।

আপনি মুনীর ভাই কুকুর কি শেয়ালের পায়ের ছাপের
অন্তরালে ঢাকা পড়ে থাকবেন, হায়,
কী করে আপোষ করি এমন ভীষণ অত্যাচারী
ভাবনার সাথে?
বলুন মুনীর ভাই, আপনি কি আগাছার কেউ?
আপনি কি ক্রীড়াপরায়ণ প্রজাপতিটার কেউ?
আপনি কি শেয়ালের? কুকুরের? ঘাসের? পিঁপড়ের?
শকুনের? আপনি কি ক্রূর ঘাতকের?

শুনুন মুনীর ভাই, আপনার বারান্দার নিভৃত বাগান
কেমন উদগ্রীব হয়ে আছে গৃহস্বামীর প্রকৃত
শুশ্রূষার লোভে আজও। একটি বিশুষ্ক ঠোঁট বৈধব্যের ষাটে
জেগে থাকে আপনার উষ্ণ চুম্বনের প্রতীক্ষায়,
একটি টাইপরাইটার আপনার একান্ত স্পর্শের জন্যে
নিঝুম নীরব হয়ে থাকে। ফের কবে
পাতা উল্টাবেন বলে সকালে দুপুরে মধ্যরাতে
পথ চেয়ে থাকে শেল্‌ফময় গ্রন্থাবলি
আপনার পদধ্বনি আবার শুনবে বলে ঐ তো
এখনও ফ্ল্যাটের সিঁড়ি কান পেতে রয় সারাক্ষণ। কোনো কোনো
সভাগৃহ আপনার ভাষণের জন্যে আজও কেমন উৎকর্ণ
হয়ে পড়ে। আপনার অভ্যস্ত ছায়ার জন্যে এখনও পড়ে না
দর্পণের চোখের পলক।

‘আছে কি খবর কিছু?’-আপনার ব্যাকুল জিজ্ঞাসা
সাঁতরে বেড়ায় আজও আমার মগজে ক্ষান্তিহীন।
কেলিপরায়ণ
মাছের মতন কোন সংবাদে লেজ ধরে সেদিন বিকেলে
রক্তাক্ত প্রান্তরে
আপনাকে পারিনি দেখাতে।
অথচ এখন নানারঙা পাখি হয়ে ডেকে যায়
খবরের ঝাঁক ইতস্তত। শুনুন মুনীর ভাই
কালো জঙ্গি পায়ের তলায় চাপা-পড়া
আপনার বাংলাদেশ লক্ষ লক্ষ বুটের চেয়েও
বহু ক্রোশ বড় বলে বর্গীরা উধাও। বহুদিন
পরে আজ আমাদের মাতৃভূমি হয়েছে স্বদেশ,
ইত্যাদি ইত্যাদি
খবর শুনুন।

শুনুন মুনীর ভাই, খবর শুনুন বলে আজ
ছুটে যাই দিগ্ধিদিক, কিন্তু, কই কোথাও দেখি না আপনাকে।
খুঁজছি ডাইনে বাঁয়ে, তন্ন তন্ন, সবদিকে, ডাকি
প্রাণপণে বার-বার। কোথাও আপনি নেই আর।

আপনি নিজেই আজ কী দুঃসহ বিষণ্ন সংবাদ।

 ললাটে নক্ষত্র ছিল যার

বস্তিতেই আবির্ভাব,সংকীর্ণ বাথানে না হলেও
পুরানো টিনের ঘরে সময়ের সাথে
প্রথম সাক্ষাৎ তার। পড়শিরা কেউ কেউ খুশি
হয়েছিল দেখে ফুটফুটে শিশুটিকে।
ভিনদেশী প্রাজ্ঞজন আনেনি
উপঢৌকন সেদিন,
ওঠেনি দিগন্তে কোনো জ্বলজ্বলে তারা।

ঘর ছেড়ে বারান্দায়, একদিন উঠোনে,
পেয়ারা গাছের নিচে রঙিন বৃক্ষের দিকে, ফের
গ্রন্থের প্রান্তরে তীর্থযাত্রী। ক্রমশ মনের ঘাটে
স্মৃতির শ্যাওলা ভাসমান। বিস্মিত সবাই দেখে,
ললাটে নক্ষত্র জ্বলে তার।
অথচ নিজে সে
দেখে না তারার দীপ্তি। কেউ
সহজে ঘেঁষে না তার ত্রিসীমায়, যেন
প্লেগের বীজাণু বয়ে বেড়াচ্ছে সে, লাজুক তরুণ।

সর্বদা পেছনে তার ঘোরে ফেউ। কেউ
চকিতে লেলিয়ে দেয় ডালকুত্তা, কেউবা ক্ষুধার্ত
নেকড়ের পাল, কেউ কেউ
নিয়ে যেতে চায় মধ্যভূমিতে কেবলি। বোঝে না সে
কী যে তার অপরাধ। সর্বক্ষণ পালিয়ে বেড়ায়
বর্শা, ছোরা, রাইফেল থেকে দূরে দূরে।

যায় না হাওয়ার লোভে পার্কে, নদীতীরে
কিংবা মাঠে, ওঠে না ভুলেও বাসে, এড়িয়ে অজস্র
কৌতূহলী চোখ পথ চলে কোনো মতে, বিশেষত
অন্ধকারে। অথচ আঁধারেও
ললাটের নিভৃত নক্ষত্রটিকে তার
পারে না লুকোতে কিছুতেই।

ললাটস্থ নক্ষত্রের রক্তিম স্ফুলিঙ্গে
আলোকিত চিলেকোঠা, পথঘাট, নিস্তব্ধ উদ্যান
অথবা কোমল সরোবর। বিপ্লবেরই
নিরুপম অরুণিমা বুঝি চতুর্দিকে।

ঝাঁক ঝাঁক খাকি টুপি, দারুণ ইস্পাতি গন্ধ ভাসে
শহরে ও গ্রামে। গোলা বারুদের গাড়ির ঘর্ঘরে
নিষিদ্ধ রাতের ঘুম। রাইফেলধারী ওরা সব,
হুলিয়া ছাড়াই ধরে তাকে,
ললাটে নক্ষত্র ছিল ষার।
গুলির ধমকে হাত ভুলণ্ঠিত পতাকা যেনবা,
জানু দেহচ্যুত নিমেষেই, ঝাঁঝরা বুক।
মাটিতে গড়ায় ছিন্ন মাথা
মুকুটের মতো,
অথচ ললাট থেকে কিছুতেই নক্ষত্র খসে না।

শমীবৃক্ষ

হাওয়ায় হাওয়ায় দুঃসংবাদ প্রতিদিন, প্রতিরাত্রি
শব্দহীন মর্শিয়ায় কেমন শীতল
সমাচ্ছন্ন, অত্যন্ত বিধুর। কে কোথায় গুম খুন
হয়ে যায়, মেলে না হদিস। লোকজন
পথ চলে, অবনত মাথা, যেন মৃতের মিছিল
সকাল সন্ধ্যায়। প্রত্যেকেই প্রত্যেকের সন্দেহভাজন অকস্মাৎ
কখনো গভীর রাতে যাত্রাবাড়ী, গ্রিন রোডগুলির ধমকে
কেঁপে ওঠে, কখনো-বা বুড়িগঙ্গা নদীর সুশান্ত
প্রতিবেশী গ্রাম দন্ধ, আহত গাছের
ডালে ঝোলে বৃদ্ধ মৃতদেহ। আলে রক্তরাঙা শাড়ি। বন্দুকের
নলের হুকুমে গ্রাম্যজন নেয় মেনে অবরুদ্ধ যন্ত্রণায়
যান্ত্রিক কাতারবন্দি মৃত্যু।

সহসা শহরে কারফিউ, সবখানে
সন্ত্রাস দেখলদার। পাড়ায় পাড়ায় ঢুকে পড়ে
নরকের ডালকুত্তাগুলো; সঙ্গে নেড়ী
কুকুরের দল, ধার-করা তেজে আপাত-তুখোড়।
ঘরে ঘরে জোর
চলেছে তল্লাশি। মারণাস্ত্র খোঁজে ওরা
অলিতে গলিতে, গাছতলায়, আড়তে,
ছায়াচ্ছন্ন প্রাঙ্গণে, পুকুরে এমনকি
বনেদী ভবনে
খোঁজে রাইফেল
গ্রেনেড, মেশিনগান, মুক্তিফৌজ, বিদ্রোহী তরুণ।

খাঁচার টিয়েটা
সবুজ চিৎকারে দিচ্ছে গুঁড়িয়ে অদ্ভুত
স্তব্ধতার ঘাঁটি; টবে উদ্ভিন্ন গোলাপ
ভীষণ ফ্যাকাশে ভয়ে। হঠাৎ কপাটে
বুটের বেদম লাথি, হাঁক-ডাক। তুই-তোকারির
ডাকে বান, নিমেষে উঠোনে
খাকি উর্দি কতিপয়; মরণলোলুপ রাকবাইন
গচ্ছিত সবার কাঁধে, কারোবা বাহুতে
চওড়া সবুজ ব্যাজ। ভয়-পাওয়া জননী তাকান
তরুণ পুত্রের দিকে, লাফাচ্ছে বাঁ চোখ
ঘন ঘন; বিমূঢ় জনক প্রস্তরিত
তরুণী কন্যার হাত ধরে ত্রস্ত খুব,
ঘরের চেয়েও বেশি নিরাপদ আশ্রয় খোঁজেন
দিগ্ধিদিক। যদি পারতেন
আত্মজ ও আত্মজাকে
রাখতেন লুকিয়ে পাতালে
নক্ষত্রবীথির অন্তরালে কিংবা রক্তকণিকায়,
হৃদয়ের গহন স্পন্দনে।

পাড়ায় পাড়ায় ওরা মাতে অস্ত্রোদ্ধারে,
নিত্য করে তছনছ যখন যা খুশি।
শহরের খাঁ খাঁ বুকে চেপে ধরে বুট,
ঘাতক সঙ্গিন।
লুকানো অস্ত্রের লোভে ওরা বার বার
দেয় হানা মহল্লায় মহল্লায়, খোঁজে
শস্ত্রপাণি যত্রতত্র শমীবৃক্ষ
বাংলাদেশের হৃদয়ে হৃদয়ে
ঝলকিত। চোখগুলো গ্রেনেডের চেয়ে
বিস্ফোরক বেশি আর শূন্য কোটি হাত
যতটা বিপজ্জনক, ক্রূর মারণাস্ত্র নয় তত।

সংবর্ধনা

হে বিদেশী প্রতিনিধিবর্গ, মাননীয় আপনারা
এলে এদেশের জনসাধারণ কাড়া ও নাকাড়া
বাজাবে এবং লাল শালুর ওপর শুভ্র লিখে
তুলোর সুহাস সুবিশাল স্বাগতম দিকে দিকে
সাজাবে তোরণ এ শহরে। গণ্ডগ্রামে হয়তোবা
যাবেন না আপনারা; সেখানে তো কাদা, পচা ডোবা
এবং মাথার হুল। সংবর্ধনা পাবেন সবাই
যথারীতি; সাম্য মৈত্রী, অমুক তমুক ভাই ভাই

ইত্যাদি স্লোগানে হবে সচকিত সুসজ্জিত মঞ্চ।
বক্তৃতামালায় গানে যাবে ভেসে রাতের মালঞ্চ।
আপনারা এলে পথে ঘাটে নামাতে হবে না আর
লাল গালিচার ঢল। ইয়াহিয়া, নব্য অবতার
হিটলারের, আগেই রেখেছে মুড়ে বড় ক্ষিপ্রতায়
কী এলাহি কাণ্ড, সারা বাংলাদেশ রক্ত গালিচায়।

সম্পত্তি

দাঁড়ালে দেয়ালে পড়ে ছায়া,
আমার নিজেরই ছায়া। চশমার আড়ালে
আছে দুটি চোখ, দেখি খাকির মিছিল
শহরে প্রত্যহ।
ঘাড়ে মাথা আছে,
মাথাভরা কাঁচাপাকা চুল। যথারীতি
নাকের টানেলে হাওয়া বয়।

আমার একটি মুখ আছে,
আছে দুটি হাত, আর এই তো আমার
শার্ট, ট্রাউজার, হাতঘড়ি।
এই তো আমার বুক আছে,
বুকের তলায় হৃৎপিণ্ডের টিকটিক
অবিরাম। আছে
একটি কলম আছে, ক্যাপবন্দি। আর এখন তো
হাওয়ায় হাওয়ায় লিখি, পাতায় পাতায়।
এবং আমার
একটি শনাক্তপত্র আছে, নিত্যসঙ্গী,
যেমন শহুরে সব পোষা কুকুরের
গলায় ঝোলানো থাকে চাকতি রুপালি।

সান্ধ্য আইন

এ শহরে কি আজ কেউ নেই? কেউ নেই?
এই তো প্রতিটি নীরব বারান্দায়
বিষাদ দাঁড়ানো কবির মতন একা।

এ শহরে কি আজ কেউ নেই? কেউ নেই?
আমার সমান-বয়সী দুঃখ দেখি
বসে আছে চুপ নিথর আঁধার ঘরে।
এ শহর আজ মৃতের নগরী নাকি?
মৃতেরা এবং গোরখোদকের দল
একটি ভীষণ নকশায় নিষ্প্রাণ।

এ শহরে কি আজ কেউ নেই? কেউ নেই?
আশেপাশে পাছে গাছ-গাছালির শোভা।
পাতার আড়ালে জ্বলছে সে কার চোখ?

সারস

মাঝে মাঝে দেখতাম তাকে দূরবর্তী
বাড়ির চূড়ায় কিংবা সাদা মেঘভর্তি
আকাশের মাঠে, যেন স্বপ্নের নিঝুম বিল থেকে
এসেছে সে কী প্রকার গোপনতা নিয়ে। ওকে দেখে
সারস হওয়ার বড় সাধ
হতো কোনো কোনো দিন। রেশমি অবাধ
ডানা মেলে সাধ হতো চঞ্চুর ডগায় আনি ছেঁকে
অনন্তের ক্ষীর, যা অনেকে
চেয়ে চেয়ে ক্লান্ত হয়। অনেক সময়
কোনো কোনো সাধ বড় দীর্ঘস্থায়ী হয়।

কখনো আঁতুড় ঘরে, কখনোবা সমাধি ফলকে
পাখার ঝলকে
নেচে ওঠে রাঙা তালে কেমন ভুবন। পক্ষী গূঢ় প্রত্যাশায়
আমার ছায়ায় ঘোরে, কখনো ঘুমায়।
ছড়ায় পাণ্ডুর জ্যোৎস্না মাথার ভিতর
পাখার বিস্তারে আর হঠাৎ ইতর
বাসনার রোখে অগোচরে
নাৎসি গোয়েন্দার মতো পথচারী হৃৎপিণ্ডের চরে।

এখন সে ছেঁড়া কাগজের মতো রুক্ষতায়
বিদ্ধ কালো, অন্ধ কাঁটাতারে নিরুপায়।

স্বাধীনতা তুমি

স্বাধীনতা তুমি
রবিঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান।
স্বাধীনতা তুমি
কাজী নজরুল, ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো
মহান পুরুষ, সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কাঁপা-
স্বাধীনতা তুমি
শহীদ মিনারে অমর একুশে ফেব্রুয়ারির উজ্জ্বল সভা,
স্বাধীনতা তুমি
পতাকা-শোভিত স্লোগান-মুখর ঝাঁঝালো মিছিল,
স্বাধীনতা তুমি ফসলের মাঠে কৃষকের হাসি।
স্বাধীনতা তুমি
রোদেলা দুপুরে মধ্যপুকুরে গ্রাম্য মেয়ের অবাধ সাঁতার।
স্বাধীনতা তুমি
মজুর যুবার রোদে ঝলসিত দক্ষ বাহুর গ্রন্থিল পেশি।
স্বাধীনতা তুমি
অন্ধকারের খাঁ-খাঁ সীমান্তে মুক্তিসেনার চোখের ঝিলিক,
স্বাধীনতা তুমি
বটের ছায়া তরুণ মেধাবী শিক্ষার্থীর
শাণিত কথার ঝলসানি-লাগা সতেজ ভাষণ।
স্বাধীনতা তুমি
চা-খানায় আর মাঠে-ময়দানে ঝোড়ো সংলাপ।
স্বাধীনতা তুমি
কালবোশেখীর দিগন্ত জোড়া মত্ত ঝাপটা।
স্বাধীনতা তুমি
শ্রাবণে অকূল মেঘনার বুক,
স্বাধীনতা তুমি পিতার কোমল জায়নামাজের উদার জমিন।
স্বাধীনতা তুমি উঠানে ছড়ানো মায়ের শুভ্র শাড়ির কাঁপন,
স্বাধীনতা তুমি
বোনের হাতে নম্র পাতায় মেহেদির রঙ।
স্বাধীনতা তুমি
বন্ধুর হাতে তারার মতন জ্বলজ্বলে এক রঙা পোস্টার।
স্বাধীনতা তুমি
গৃহিণীর ঘন খোলা কালোচুলে,
হাওয়ায় হাওয়ায় বুনো উদ্দাম।
স্বাধীনতা তুমি
খোকার গায়ের রঙিন কোর্তা,
খুকির অমন তুলতুলে গালে রৌদ্রের খেলা।
স্বাধীনতা তুমি
বাগানের ঘর, কোকিলের গান,
বয়েসী বটের ঝিলিমিলি পাতা,
যেমন ইচ্ছে লেখার আমার কবিতার খাতা।

Exit mobile version