পড়শি
আমার বাড়ির ছোট্র এ পাঙ্গণে
সবত করে একটি ফুলের চারা।
খুরপি দিয়ে মাটি খুঁড়ে, ঢেলে
জলের ধারা লালন করি তাকে।
খুব শুকোলে চারার জিভের ডগা
এক নিমেষে আমার গলা মরু।
যখন চারা জল শুষে নেয় গলায়
তখন আমার ধু-ধু তৃষ্ণা মেটে।
গেলাম চলে সুদূর গণ্ডগ্রামে
ছোট্র আমার চারাটিকে রেখে
গর্জে-ওঠা মেশিনগানের মুখে।
আমরা এমন স্বার্থপরই বটে।
ফিরে এসে অবাক কাণ্ড একি
সেই চারাটি দুলছে দেখি সুখে।
সন্ত্রাসে সে যায়নি কুঁকড়ে মোটে,
বরং তেজী খুব উঠেছে বেড়ে।
বন্দি শিবির থেকে
ঈর্ষাতুর নই, তবু আমি
তোমাদের আজ বড় ঈর্ষা করি। তোমরা সুন্দর
জামা পরো, পার্কের বেঞ্চিতে বসে আলাপ জমাও,
কখনো সেজন্যে নয়। ভালো খাও দাও
ফুর্তি করে সবান্ধব, সে জন্যেও নয়।
বন্ধুরা তোমরা যারা কবি,
স্বাধীন দেশে কবি, তাদের সৌভাগ্যে
আমি বড় ঈর্ষান্বিত আজ।
যখন যা খুশি
মনের মতন শব্দ কী সহজে করো ব্যবহার
তোমরা সবাই।
যখন যে শব্দ চাও, এসে গেলে সাজাও পয়ারে,
কখনো অমিত্রাক্ষরে, ক্ষিপ্র মাত্রাবৃত্তে কখনো-বা।
সে সব কবিতাবলি, যেন রাজহাঁস,
দৃপ্ত ভঙ্গিমায় মানুষের
অত্যন্ত নিকটে যায়, কুড়ায় আদর।
অথচ এ দেশে আমি আজ দমবন্ধ
এ বন্দি শিবিরে,
মাথা খুঁড়ে মরলেও পারি না করতে উচ্চারণ
মনের মতন শব্দ কোনো।
মনের মতন সব কবিতা লেখার
অধিকার ওরা
করেছে হরণ।
প্রকাশ্য রাস্তায় যদি তারস্বরে চাঁদ ফুল পাখি
এমনকি রানী ইত্যাকার শব্দাবলি
করি উচ্চারণ, কেউ করবে না বারণ কখনো।
কিন্তু, কিছু কিছু শব্দকে করেছে
বেইনি ওরা
ভয়ানক বিস্ফোরক ভেবে।
স্বাধীনতা নামক শব্দটি
ভরাট গলায় দীপ্ত উচ্চারণ করে বার বার
তৃপ্তি পেতে চাই। শহরের আনাচে-কানাচে
প্রতিটি রাস্তায়
অলিতে গলিতে
রঙিন সাইনবোর্ড, প্রত্যেক বাড়িতে
স্বাধীনতা নামক শব্দটি
লিখে দিতে চাই
বিশাল অক্ষরে।
স্বাধীনতা শব্দ এত প্রিয় যে আমার
কখনো জানিনি আগে। উঁচিয়ে বন্দুক
স্বাধীনতা, বাংলাদেশ-এই মতো শব্দ থেকে ওরা
আমাকে বিচ্ছিন্ন করে রাখছে সর্বদা।
অথচ জানে না ওরা কেউ
গাছের পাতায়, ফুটপাতে
পাখির পালকে কিংবা নারীর দু’চোখে
পথের ধুলায়
বস্তির দুরন্ত ছেলেটার
হাতের মুঠোয়
সর্বদাই দেখি জ্বলে স্বাধীনতা নামক শব্দটি।
মধুস্মৃতি
দু’দশক পরেও স্ফটিক মনে পড়ে-
বৈশাখের খটখটে স্বেদাক্ত দুপুরে,
প্রথম কদম শিহরিত
আষাঢ়ের জলজ দিবসে
ব্রাউন পাখির মতো অঘ্রাণের রেশমি বিকেলে
ক্যান্টিনে ঢুকেই বলতাম তৃষ্ণাতুর,
মধুদা চা দিন তাড়াতাড়ি,
গরম সিঙাড়া চাই, চাই স্বাদু শীতল সন্দেশ।
ক্লাস শেষ হলে, লাইব্রেরি ঘরে না বসলে মন
আপনার ক্যান্টিনে আশ্রয় খুঁজতাম
বিবর্ণ চেয়ারে
চায়ের তৃষ্ণায় নয় তত
যতটা আড্ডার লোভে আমরা ক’জন।
একে একে অনেকেই জুটত সেখানে-
মদনরাজ্যের অনুগত প্রজা কেউ কেউ, কেউবা নবীন
সামন্ত প্রতাপশালী। কেউ
ক্ষীণকায়, প্রায় রোগী, কবি,
কেউবা বিপ্লবী নেতা, কেউবা বৃত্তিভোগী
মসৃণ দালাল। আমাদের কারো কারো
মনে ছিল ব্যাপ্ত কার্ল মার্কস-এর মহিমা।
টেবিলে টেবিলে কত তর্কের তুফান
যেত বয়ে, আপনি সামলাতেন শেড।
কাউন্টারে বসে হাসতেন মৃদু, নাড়তেন মাথা
মাঝে-মধ্যে। এক কোণে চেয়ারে এলিয়ে
কখনো আওড়াতাম ডানের তির্যক পঙ্ক্তি, সদ্যপড়া, আর
হ্যামলেটি স্বগত ভাষণে
উঠতাম মেতে লরেন্স অলিভিয়ারের মতোই।
নিজের কবিতা
দিতাম ব্যাকুল ঢেকে বন্ধুর শ্রুতিতে কখনো-বা। অন্য কোণে
বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদ অথবা বাঙালি মানসের বিবর্তন
উঠত ঝলমলিয়ে দিব্যি তার্কিকের
জাগর মনস্বিতায়। কখনো আবার
সাম্য মৈত্রী স্বাধীনতা ইত্যাদি শব্দের
কোলাহলে প্রবল উঠত কেঁপে শেড্।
কখনোবা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে, গণ-আন্দোলনে
থরথর শহুরে রাস্তায়
কি আশ্চর্য, যেত উড়ে আপনার অলৌকিক মধুর ক্যান্টিন।
আপনাকে মনে হতো বৃক্ষের মতন,
উদার নিরুপদ্রব ডালে যার কাটায় সময়
নানান পাখির ঝাঁক, তারপর সহসা উধাও
কত যে বিচিত্র দিকে ফেরে না কখনো।
আমতলা এখনও হৃদয়ে
সবুজ দাঁড়িয়ে আছে এখনও রোদ্দুরলিপ্ত পাতা
শিহরিত হয়, প্রতিবাদী সভা, উত্তোলিত হাত,
প্রখর পোস্টার
চকিতে ঝলসে ওঠে এখনও হৃদয়ে। এখনও তো
আমতলা, মোহন টিনের শেড, ক্লাসরুম আর
নিঝুম পুকুর পাড়ে জ্বলে
দামি পাথরের মতো আপনার চক্ষুদ্বয়।
আপনি ছিলেন প্রিয়জন আমাদের
বড় অন্তরঙ্গ নানা ঘটনায়
উৎসব এবং দুর্বিপাকে। বুঝি তাই
আপনার রক্তে ওরা মিটিয়েছে তৃষ্ণা।
আমাদের প্রিয় যা কিছু সবই তো ওরা
হত্যা করে একে একে। শহীদ মিনার
অপবিত্র করে, ভাঙে মর্টারের ঘায়ে,
ফারুকের সমাধিস্থ লাশ খুঁড়ে তোলে
দারুণ আক্রোশে
ছুড়ে ফেলে দেয় দূরে, কে জানে কোথায়।
বটতলা করে ছারখার।
আমাদের প্রিয় যা কিছু সবই তো ওরা
হত্যা করে একে একে।
আপনার নীল লুঙ্গি মিশেছে আকাশে,
মেঘে ভাসমান কাউন্টার। বেলা যায়, বেলা যায়
ত্রিকালজ্ঞ পাখি ওড়ে, কখনো স্মৃতির খড়কুটো
ব্যাকুল জমায়। আপনার স্বাধীন সহিষ্ণু মুখ-
হায়, আমরা তো বন্দি আজও-মেঘের কুসুম থেকে
জেগে ওঠে, ক্যাশবাক্স রঙিন বেলুন হয়ে ওড়ে।
বিশ্বাস করুন,
ভার্সিটি পাড়ায় গিয়ে আজও মধুদা মধুদা বলে খুব
ঘনিষ্ঠ ডাকতে সাধ হয়।