পথের কুকুর
অবশ্য সে পথের কুকুর। সারাদিন
এদিকে ওদিকে ছোটে, কখনোবা ডাস্টবিন খুঁটে
জুড়ায় উঠরজ্বালা, কখনো আবার প্রেমিকার
মনোরঞ্জনের জন্য দেয় লাফ হরেক রকম।
হাড় নিয়ে মুখে বসে গাছের ছায়ায়,
লেজ নাড়ে মাঝে-মধ্যে ফুর্তিবাজ প্রহরের, কখনো
ধুলায় গড়ায়। কখনো সে
শূন্যতাকে সাজায় চিৎকারে
আমি বন্দি নিজ ঘরে। শুধু
নিজের নিঃশ্বাস শুনি, এত স্তব্ধ ঘর।
আমরা কজন শ্বাসজীবী।
ঠায় বসে আছি
সেই কবে থেকে। আমি, মানে
একজন ভয়ার্ত পুরুষ,
সে, অর্থাৎ সন্ত্রস্ত মহিলা,
ওরা, মানে কয়েকটি অতি মৌন বালক-বালিকা-
আমরা ক’জন
কবুরে স্তব্ধতা নিয়ে বসে আছি। নড়ি না চড়ি না
একটুকু, এমনকি দেয়াল-বিহারী টিকটিকি
চকিতে উঠলে ডেকে, তাকেও থামিয়ে দিতে চাই,
পাছে কেউ শব্দ শুনে ঢুকে পড়ে ফালি ফালি চিরে মধ্যবিত্ত
নিরাপত্তা আমাদের! সমস্ত শহরে
সৈন্যেরা টহল দিচ্ছে, যথেচ্ছ করছে গুলি, দাগছে কামান
এবং চালাচ্ছে ট্যাঙ্ক যত্রতত্র। মরছে মানুষ
পথে ঘাটে ঘরে, যেন প্লেগবিদ্ধ রক্তাক্ত ইঁদুর।
আমরা ক’জন শ্বাসজীবী-
ঠায় বসে আছি
সেই কবে থেকে। অকস্মাৎ কুকুরের
শাণিত চিৎকার
কানে আসে, যাই জানলার কাছে, ছায়াপ্রায়। সেই
পথের কুকুর দেখি বারংবার তেড়ে যাচ্ছে জলপাইরঙ
একটি জিপের দিকে, জিপে
সশস্ত্র সৈনিক কতিপয়। ভাবি, যদি
অন্তত হতাম আমি পথের কুকুর।
প্রতিটি অক্ষরে
আমার মগজে ছিল একটি বাগান, দৃশ্যাবলিময়।
কখনো তরুণ রৌদ্রে কখনোবা ষোড়শীর যৌবনের মতো
জ্যোৎস্নায় উঠত ভিজে। জ্যোৎস্নাভুক পাখি
গাইত সুস্নিগ্ধ গান, আমার মগজে ছিল একটি বাগান।
মদির অভিনিবেশে পাখি গান গেয়ে উঠলেই
শিরায় শিরায় সব দিকে
উঠত ঝিকিয়ে
নতুন কবিতাবলি মগজের রঙিন নিকুঞ্জে।
আমার সে সব কবিতায়
থাকত জড়িয়ে সেই উদ্যানের স্মৃতি।
এখন যা কিছু লিখি, কবিতা অথবা
একান্ত জরুরি কোনো চিঠি
কিংবা দিনলিপি,
এখন যা কিছু লিখি সব কিছুতেই
ভর করে লক্ষ লক্ষ গুলিবিদ্ধ লাশ।
প্রতিটি অক্ষরে আজকাল
প্রতিটি শব্দের ফাঁকে শুয়ে তাকে লাশ। কখনোবা
গোইয়ার চিত্রের মতো দৃশ্যাবলি খুব
অন্তরঙ্গ হয়ে মেশে প্রতিটি অক্ষরে।
প্রতিটি পঙ্ক্তির রন্ধ্রে রন্ধ্রে
বিধবার ধু-ধু আর্তনাদ
জননীর চোখের দু’কূলভাঙা জল
হু হু বয়ে যায়। প্রতি ছত্রে
নব্য হিরোশিমা, দাউ দাউ
কত মাই লাই।
আমার প্রতিটি শব্দ পিষ্ট ফৌজি ট্রাকের তলায়,
প্রতিটি অক্ষরে
গোলা বারুদের
গাড়ির ঘর্ঘর,
দাঁতের তুমুল ঘষ্টানি,
প্রতিটি পঙ্ক্তিতে শব্দে প্রতিটি অক্ষরে
কর্কশ সবুজ ট্যাঙ্ক চরে, যেনবা ডাইনোসর।
প্রতিটি পঙ্ক্তির সাঁকো বেয়ে
অক্ষরের সরু আল বেয়ে উদ্বাস্তুরা যাচ্ছে হেঁটে
সারি সারি, বিষম পা-ফোলা শুকনো গলা,
লক্ষ লক্ষ যাচ্ছে তো যাচ্ছেই,
প্রতিজন একেকটি হু হু দীর্ঘশ্বাস।
এখন আমার কবিতার
প্রতিটি অক্ষরে
বনবাদাড়ের গন্ধ, গেরিলার নিঃশ্বাস এবং
চরাচরব্যাপী পতাকার আন্দোলন।
প্রতিশ্রুতি
কথা দিচ্ছি, তোমার কাছেই যাব, গেলে
তুমি খুশি হবে খুব, মেলে
দেবে ধীর অনাবিল আপন গ্রহণ সত্তা। আজ
আমাকে ডেকো না বৃথা। তোমার সলাজ
সান্নিধ্যে যাওয়ার মতো মন নেই। শহুরে বাগান
রাখুক দরজা খুলে, তোমার ত্বকের মৃদু ঘ্রাণ
পারব না নিতে। যখন সময় হবে দিচ্ছি কথা,
অঞ্জলিতে নেব তুলে মুখ-হে রঙিন কোমলতা।
আমাদের বুকে জ্বলে টকটকে ক্ষত,
অনেকে নিহত আর বিষম আহত
অনেকেই। প্রেমালাপ সাজে না বাগানে
বর্তমানে আমাদের। ভ্রমরের গানে
কান পেতে থাকাও ভীষণ বেমানান
আজকাল। সৈন্যদল অদূরেই দাগছে কামান।
আমাদের ক্ষত সেরে গেলে
কোনো এক বিনম্র বিকেলে
তোমার কাছেই যাবে হে আমার সবচেয়ে আপন গোলাপ,
করবো না কথার খেলাপ।
প্রবেশাধিকার নেই
প্রবেশাধিকার নেই। এখন আমার আনন্দের
দুঃখের ক্রোধের
ক্ষোভের প্রেমের
প্রবেশাধিকার নেই মনুষ্যসমাজে।
আগে আমি আনন্দিত হলে
একটি কবিতা লিখে খাতার পাতায়
সেই আনন্দের ছায়াটিকে রাখতাম ধরে।
আমার শয্যার পাশে দুঃখ কোনো দিন
হাঁটু মুড়ে বসলে নিঃশব্দে
আমি তার ছবি শব্দে ছন্দে আঁকতাম খুব
বিষাদে আচ্ছন্ন হয়ে। ক্রোধান্বিত হলে,
ক্রোধের গরগরে চিহ্নগুলি থাকত ছড়িয়ে
দুর্বাসার মতো জেদী পয়ারের প্রতিটি সারিতে।
ভালোবাসা পল্লবিত বৃক্ষের মতন
কেমন দাঁড়াত ঋজু শব্দের অরণ্যে।
আমার আনন্দ, দুঃখ, ক্রোধ, ক্ষোভ, ভালোবাসা
নানান কবিতা হয়ে মানুষের কাছে
পৌঁছে যেত যথারীতি, এখন আমার আনন্দের
দুঃখের ক্রোধের
ক্ষোভের প্রেমের
প্রবেশাধিকার নেই মনুষ্যসমাজে।
এখন আমার ক্রোধ দুঃখ
আনন্দ অথবা ভালোবাসা কবিতার ছদ্মবেশে
কেবলি লুকায়
দেরাজের একান্ত কোটরে
নিভৃত আলমারি কিংবা সুটকেসে। যেন
ওরা পার্টিকর্মী,
গোয়েন্দা এবং পুলিশের
চোখে ধুলো দিয়ে
আড়ালে থাকতে চায় ধরপাকড়ের মরসুমে।
প্রাত্যহিক
যথারীতি বিষম নিয়মপরায়ণ
কাক চেরে ঘুম ভোরে। শয্যাত্যাগী আমি
দাঁত মাজি, করি পায়চারি, মাঝে-মধ্যে
আওড়াই তর্জমায় এলিয়টি পঙ্ক্তি-
এপ্রিল নিষ্ঠুরতম মাস। প্রাতরাশ
যৎসামান্য, চা আর বাকরখানির গন্ধে
অভ্যস্ত গার্হস্থ্য দিন। সংবাদপত্রের মিথ্যা গেলি
একরাশ, তাকাই কখনো
আকাশের দিকে। অকস্মাৎ জঙ্গি জেট
ছিঁড়ে খুঁড়ে যায় নীলিমাকে।
নিরানন্দ ডালভাত নাকে মুখে গুঁজে
মন দিই আপিস যাত্রায়
বেলা দশটায়।
মুখের প্রতিটি খাঁজে সন্ত্রাস কাঁকড়া হয়ে আছে।
পথে দেখি,
ধাঁ করে একটি ট্রাক যাচ্ছে ছুটে, আরোহী ক’জন
চোখ-বাঁধা, হাত-বাঁধা আবছা মানুষ,
পাশে রাইফেলধারী পাঞ্জাবি সৈনিক।
ছাত্র নই, মুক্তিসেনা নই কোনো, তবু
হঠাৎ হ্যান্ডস আপ বলে
পশ্চিমা জোয়ান আসে তেড়ে
স্টেনগান হাতে আর প্রশ্ন দেয় ছুড়ে ঘাড় ধরে-
বাঙালি হো তুমি। আমি রুদ্ধবাক, কি দেব জবাব?
জ্যোতির্ময় রৌদ্রালোকে বীরদর্পী সেনা
নিমেষেই হয়ে যায় লুটেরা, তস্কর।
খুইয়ে সামান্য টাকা কড়ি,
শ্বশুর প্রদত্ত হাতঘড়ি কোনোমতে
প্রাণপক্ষী নিয়ে ফিরি আপিস-কন্দরে।
এদিকে বিষম
পানাসক্ত প্রেসিডেন্ট-ইনিও সৈনিক-
দিচ্ছেন ভাষণ
বেতার টেলিভিশনে, ঢুলু ঢুলু গলায় কেমন
গাইছেন গণ-
হত্যার সাফাই।
বিদেশী সংবাদদাতাগণ মিছেমিছি করছেন বাড়াবাড়ি
অর্থাৎ তিলকে তাল। লক্ষ লক্ষ নিরস্ত্র লোককে
নাকি তাঁর বীর সৈনিকেরা
কখনো করেনি হত্যা, পোড়ায়নি শহর ও গ্রাম।
সব ঝুট হ্যায়, সব ফালতু গুজব।
সত্যের মৌরসীপাট্রা একা তাঁরই। একেই তো বলে
কসাইখানার হেকমত। মাইরি হুজুর বটে
ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির।
দুনিয়ার সব শৃঙ্খলিত কৃষক মজুর শোনো,
সর্বহারা নিধনের জন্যে অবিরাম
আসছে বারুদ বোমা স্বৈরাচারী শাসকের
হাতে,
কখনো-বা, বলিহারি যাই, গুঁড়া দুধ।
খাসা কূটনীতি,
চীনা ও মার্কিন কালোরাতি।
বড় আটপৌরে এ জীবন,
প্রশংসা অথবা নিন্দা কিছুই জোটে না
এ পোড়া কপালে।
সত্যের বলাৎকার দেখে, নিরপরাধের হত্যা
দেখেও কিছুতে মুখ পারি না খুলতে।
বুটের তলায় পিষ্ট সারাদেশ, বেয়নেটবিদ্ধ
যাচ্ছে বয়ে রক্তস্রোতে, কত যে মায়ের অশ্রুধারা।
পাড়ায় পাড়ায় খাল কেটে
কুমির আনছে কেউ কেউ। রাত হলে,
এমনকি দিনদুপুরেই
কেবলি দৌরাত্ম্য বাড়ে রাজাকার, পুলিশ এবং
সৈনিকের। ধরপাকড়ের নেই শেষ। মাঝে-মাঝে
মধ্য রাতে নারীর চিৎকারে ভাঙে ঘুম,
তাকাই বিহ্বলা গৃহিণীর দিকে। ভাবি,
জান দিয়ে মান রাখা যাবে তা আখের?
তুমুল গাইছে গুণ কেউ কেউ কুণ্ঠাহীন খুনি
সরকারের, কেউ কেউ ইসলামী বুলি ঝেড়ে তোফা
বুলবুল হতে চায় মৃতের বাগানে।
কেউবা জমায় দোস্তি নিবিড় মস্তিতে
ভ্রাতৃঘাতকের সাথে। গদগদে দালাল,
বখাটে যুবক আর ভাড়াটে গুণ্ডারা
রটাচ্ছে শান্তির বাণী লাঠিসোটা নিয়ে।
অলিতে গলিতে দলে দলে
মোহাম্মদী বেগ ঘোরে, ঝলসিত নাঙা তলোয়ার।
নেপথ্যে মীরজাফর বঙ্কিম গোঁফের নিচে মুচকি হাসেন।