তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা
তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা,
তোমাকে পাওয়ার জন্যে
আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়?
আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন?
তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা,
সকিনা বিবির কপাল ভাঙলো,
সিঁথির সিঁদুর মুছে গেল হরিদাসীর।
তুমি আসবে বলে হে স্বাধীনতা,
শহরের বুকে জলপাই রঙের ট্যাঙ্ক এলো
দানবের মত চিৎকার করতে করতে,
তুমি আসবে বলে হে স্বাধীনতা,
ছাত্রাবাস, বস্তি উজাড় হল। রিকয়েললেস রাইফেল
আর মেশিনগান খই ফোটালো যত্রতত্র।
তুমি আসবে বলে ছাই হল গ্রামের পর গ্রাম।
তুমি আসবে বলে বিধ্বস্ত পাড়ায় প্রভুর বাস্তুভিটার
ভগ্নস্তূপে দাঁড়িয়ে একটানা আর্তনাদ করল একটা কুকুর।
তুমি আসবে বলে হে স্বাধীনতা
অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের উপর।
তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা, তোমাকে পাওয়ার জন্যে
আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়?
আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন?
স্বাধীনতা, তোমার জন্যে এক থুত্থুরে বুড়ো
উদাস দাওয়ায় বসে আছেন-তাঁর চোখের নিচে অপরাহ্নের
দুর্বল আলোর ঝিলিক, বাতাসে নড়ছে চুল।
স্বাধীনতা, তোমার জন্যে
মোল্লাবাড়ির এক বিধবা দাঁড়িয়ে আছে
নড়বড়ে খুঁটি ধরে দগ্ধ ঘরের।
স্বাধীনতা, তোমার জন্যে
হাড্ডিসার এক অনাথ কিশোরী শূন্য থালা হাতে
বসে আছে পথের ধারে।
তোমার জন্যে,
সগীর আলী, শাহাবাজপুরের সেই জোয়ান কৃষক,
কেষ্ট দাস, জেলেপাড়ার সবচেয়ে সাহসী লোকটা,
মতলব মিয়া, মেঘনা নদীর দক্ষ মাঝি,
গাজী গাজী বলে যে নৌকো চালায় উদ্দাম ঝড়ে,
রুস্তম শেখ, ঢাকার রিক্শাওয়ালা, যার ফুসফুস
এখন পোকার দখলে
আর রাইফেল কাঁধে বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানো
সেই তেজী তরুণ যার পদভারে
একটি নতুন পৃথিবীর জন্ম হতে চলেছে-
সবাই অধীর প্রতীক্ষা করছে তোমার জন্যে, হে স্বাধীনতা।
পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত জ্বলন্ত
ঘোষণার ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলে,
নতুন নিশান উড়িয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগ্ধিদিক
এই বাংলায়
তোমাকে আসতেই হবে, হে স্বাধীনতা।
দখলি স্বত্ব
টিলার ওপর নয়, নদী তীরে নয়, এমনকি
পুকুর পাড়েও নয়, গলিতেই দাঁড়ানো আমার
একতলা বাড়ি।
হরিণ পাবে না খুঁজে বাড়ির তল্লাটে
অথবা কুকুর হতে সাবধান নামক নোটিশ
দেখবে না গেটে যদি আসো
হঠাৎ এখানে কোনো দিন। আসবাব-
পত্র জমকালো নয় মোটে, আছে শুধু
যা না থাকলেই নয়। তবু
আমার অত্যন্ত প্রিয় এই জীর্ণ বাড়ি। ভালো লাগে
এর সব ক’টি ঘর। একরত্তি উঠোনে যখন
শিশুরা উজ্জ্বল খেলে কিংবা
করে ছোটাছুটি
মিনিটে মিনিটে, ভালো লাগে,
বড় ভালো লাগে আর বাড়ির কোণের
সেই ছোট ঘর,
যেখানে রয়েছে পাতা খাট, বইময় একটি টেবিল,
যেখানে ঘুমাই, পড়ি, লিখি,
প্রুফ দেখি ইত্যাদি, ইত্যাদি,
সেই ঘর ছেড়ে অন্য কোনো ঘরে-
হোক তা যতই চোখ-ধাঁধানো, আয়েশী-
কখনো করব বসবাস, কিছুতেই
পারি না ভাবতে
অথচ আমার
বাড়ির দখলি স্বত্ব হারিয়ে ফেলেছি।
সব ক’টি ঘর জুড়ে বসে আছে দেখি
বিষম অচেনা এক লোক-
পরনে পোশাক খাকি, হাতে কারবাইন।
ধ্বস্ত দ্বারকায়
আবার ঘর ছেড়ে তুমি তো আসবে না।
বাইরে নীল শাড়ি যাবে না দেখা রাতে।
মধ্যরাতে আজ তোমার শয্যায়
তীব্র আগুনের ফুলকি নেই কোনো,
এখন তুমি ঘরে নিভাঁজ ঘুমে কাদা।
তোমার বুকে আর যমুনা দুলবে না?
দুয়ারে মঙ্গল কলস দুটি শুধু
প্রতীক্ষায় থাকে। রয়েছি আমি দূরে
পথের ধারে একা, নিসর্গেরই কেউ?
হয়তো আরেকটি বৃক্ষ বনানীর।
ঘুমের বনে মুখ রেখেছ ঢেকে তুমি,
আমার শিরা উপশিরায় টর্নেডো।
দৃশ্য থেকে চোখ ফেরানো দায় তবু।
কাঁপছে থর থর শেমিজ জ্যোৎস্নার-
মর্ত ঘাতকের অট্রহাসি বাজে
ঠেকাতে অক্ষম নানীর লাঞ্ছনা
ব্যর্থতার এই দারুণ দংশন
লুকিয়ে চলে যাব, ফেরারি যেন কেউ।
এখনও আঙুলের শীর্ষভূমি আর
দীর্ণ হৃদয়ের গুপ্ত তটরেখা
সুরের নন্দিত জোয়ারে যায় ভেসে।
অথচ অপারগ তুলতে কোনো সুর;
আমার বাঁশি এই ধুস্ত দ্বারকায়
নিয়েছে কেড়ে সেই দস্যু বর্বর।
না, আমি যাব না
না, আমি যাব না
অন্য কোনোখানে।
আমিও নিজেকে ভালোবাসি
আর দশজনের মতন। সকালের
টাটকা মাখন-রোদে জেগে ওঠা, প্রাতরাশ সেরে
তুমুল আড্ডায় মাতা, চেনা রাস্তা দিয়ে
হেঁটে যাওয়া, রাত্রি জেগে বই পড়া, আলাপ জমানো
বন্ধুদের সাথে
আমারও অত্যন্ত ভালো লাগে।
আমিও নিজেকে ভালোবাসি
আর দশজনের মতন। ঘাতকের
অস্ত্রের আঘাত
এড়িয়ে থাকতে চাই আমিও সর্বদা।
অথচ এখানে রাস্তাঘাটে
সবাইকে মনে হয় প্রচ্ছন্ন ঘাতক।
মনে হয়, যে কোনো নিশ্চুপ পথচারী
জামার তলায়
লুকিয়ে রেখেছে ছোরা, অথবা রিভলবার, যেন
চোরাগোপ্তা খুনে
পাকিয়েছে হাত সকলেই।
জানি, গুপ্তচর
করছে অনুসরণ সারাক্ষণ। কখনো নিজেরই
ছায়া দেখে ভীষণ চমকে উঠি। রাজাকার, পুলিশ, জওয়ান
যারা খুশি তুলে নিয়ে যেতে পারে মধ্যরাতে অথবা দুপুরে
আমার সামান্য মৃতদেহ
বুকে নিয়ে বুড়িগঙ্গা বয়ে যেতে পারে নিরবধি।
তবু আমি যাব না কখনো
অন্য কোনোখানে। খুঁজব না
নিশ্চিন্ত আশ্রয়
অন্য কোনো আকাশের নিচে।
এখন পড়ে না চোখে চেনা মুখ কোথাও তেমন
কোনোখানে। কখনো চমকে উঠি দেখে
কাউকে নির্জন বাসস্টপে। মনে হয়,
চিনি তাকে, সান্নিধ্যে গেলেই
ভাঙে ভুল, মাথা হেঁট করে
পথ চলি পুনর্বার। বন্ধুরা অনেকে
দেশান্তরী, বস্তুত প্রত্যহ
হচ্ছে বাস্তুত্যাগী
সন্ত্রাসতাড়িত
হাজার হাজার লোক, এমনকি অসংখ্য কৃষক
আদি ভিটা জমিজমা ছেড়ে
খোঁজে ঠাঁই যেমন-তেমন ভিন দেশে।
তবু আমি যাব না কখনো
অন্য কোনোখানে
থাকব তাদের সঙ্গে এখানেই, বাজেয়াপ্ত হয়েছে যাদের
দিনরাত্রি, যন্ত্রণায় বিদ্ধ হয়ে সকল সময় সারিবদ্ধ
মৃত্যুর প্রতীক্ষা করা যাদের নিয়তি।