এখানে দরজা ছিল
এখানে দরজা ছিল, দরজার ওপর মাধবী-
লতার একান্ত শোভা। বারান্দায় টব, সাইকেল
ছিল, তিন চাকা-অলা, সবুজ কথক একজন
দ্বারবন্দি। রান্নাঘরে থেকে উঠত রেশমী ধোঁয়া।
মখমল গায়ে কেউ, এঁটোকাঁটাজীবী, অন্ধকারে
রাখত কখনো জ্বেলে এক জোড়া চোখ। ভোরবেলা
খবর কাগজে মগ্ন কে নীরব বিশ্ব-পর্যটক
অকস্মাৎ তাকাতেন কাকময় দেয়ালের দিকে।
ভাবতেন শৈশবের মাঠ, বল-হারানোর খেদ
বাজত নতুন হয়ে। মুহূর্তে মুহূর্তে শুধু বল
হারাতেই থাকে, কোনো হুইসিল পারে না রুখতে।
ক্ষতির খাতায় হিজিবিজি অঙ্কগুলি নৃত্যপর।
এখানে দরজা ছিল, দরজায় ওপর মাধবী-
লতার একান্ত শোভা। এখন এখানে কিছু নেই,
কিচ্ছু নেই। শুধু এক বেকুর দেয়াল, শেল-খাওয়া,
কেমন দাঁড়ানো, একা। কতিপয় কলঙ্কিত ইট
আছে পড়ে ইতস্তত। বাঁ দিকে তাকালে ভাঙাচোরা
একটি পুতুল পাবে, তা ছাড়া এখানে কিছু নেই।
ভগ্নস্তূপে স্থির আমি ধ্বংসচিহ্ন নিজেই যেনবা;
ভস্ম নাড়ি জুতো দিয়ে, যদি ছাই থেকে অকস্মাৎ
জেগে ওঠে অবিনাশী কোনো পাখি, যদি দেখা যায়
কাবুর হাসির ছটা, উন্মীলিত স্নেহ, ভালোবাসা।
এরপরও
এরপরও আর ক’জন থাকবে টিকে?
ক’জন পারবে মৃত্যুকে দিতে ফাঁকি?
বিদ্বজ্জন দেশে নেই আর বাকি।
একি হত্যার তাণ্ডব চৌদিকে!
বন্ধুরা ক্রমে যাচ্ছেন দূরে সরে-
কেউ কেউ মৃত, অনেকে দেশান্তরী।
এই দুর্যোগে আমি কোন পথ ধরি?
কাঁটাতারে মুখ থুবড়ে থাকব পড়ে?
মৃত্যুর সাথে দাবা খেলি প্রায়-মৃত।
কোথাও একটি চেনা মুখ যদি দেখি,
বিস্মিত ভাবি, সত্যি ঘটনা একি?
করি সন্দেহ কাউকে দেখলে প্রীত।
আতংকময় শহরে অবিশ্রাম
মানুষ ঝরছে, যেন সব পচা ফল!
এখন ব্যক্তিগত চিঠি ঝলমল
করলে স্বস্তি, পেলে কোন টেলিগ্রাম।
কাঁটাতার
কাঁটাতার, কাঁটাতার।
ড্রাগনের বিষদাঁতের মতন
চৌদিকে কী যে সন্ত্রাস ছোড়ে
কাঁটাতার, কাঁটাতার।
কালো কাঁটাতারে, হায়,
বাঁধা পড়ে আছি আষ্টেপৃষ্ঠে;
চোখে-মুখে-হাতে, ক্ষণিক স্বপ্নে
কাঁটাতার, কাঁটাতার।
কাঁটাতারময় খুন।
যৌথ রক্ত ঝরছে কেবল,
চোখগুলো কাঁটাতারের আড়ালে
অন্য চোখের মতো।
এ ব্যাপক কাঁটাতারে
জীবন ঝুলছে, যেন ক্রুশকাঠ;
শহরে শহরে, ধু-ধু প্রান্তরে
কাঁটাতার, কাঁটাতার।
কাঁটাতারে বাঁধা চোখ।
ঘাসের ডগায়, এমনকি ঐ
তুচ্ছ কাকের দিকেও এখন
তাকাই না কিছুতেই।
কাঁটাতার, কাঁটাতার।
শুধু চেয়ে থাকি পায়রা রঙের
ভবিষ্যতের দিকে অপলক্ষ।
মুছবে কি কাঁটাতারে?
কাক
গ্রাম্য পথে পদচিহ্ন নেই। গোঠে গরু
নেই কোনো, রাখাল উধাও,রুক্ষ সরু
আল খাঁ-খাঁ, পথপার্শ্বে বৃক্ষেরা নির্বাক
নগ্ন রৌদ্র চতুর্দিকে, স্পন্দমান কাক, শুধু কাক।
কিছুই নেই
কী আছে আমার আজ? এমন কিছুই নেই যার
হিরন্ময়তায় দেবতার
দ্যুতি হবে ম্লান আর বিত্তবানগণ
হবেন আমার প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ।
বান্ধববর্জিত আমি, গুণীরা করেন অবহেলা
সর্বক্ষণ, ইতর সংসর্গে কাটে বেলা
এখন আমার। কেউ ডুগডুগি বাজায়,
করতালি দেয় আমার চান্দিকে, কেউ যায়
চলে বাঁকা দৃষ্টি ছুড়ে, কেউ দেয় শিস
যেন জাদুকরের বানর আমি আছি অহর্নিশ
খেলার দড়িতে বাঁধা। ভুল
খেলা দেখোনোর ফলে সারাক্ষণ দিতেছি মাশুল।
কী আছে আমার আজ? কিছু নেই, শুধু
বিভারিক্ত ধু-ধু,
পথপ্রান্তে আছি পড়ে, পরিত্যক্ত একা;
প্রার্থিত জনের দেখা
মেলে না কখনো। এমনকি কবিতাও
নিয়েছে ফিরিয়ে দৃষ্টি। নেই যেন কোথাও
সান্ত্বনার অমল উদ্যান। আমি আজ
আবহক্কুট প্রায়, কম্পমান, বাতাস বড়ই জাঁহাবাজ।
গেরিলা
দেখতে কেমন তুমি? কী রকম পোশাক-আশাক
পরে করো চলাফেরা? মাথায় আছে কি জটাজাল?
পেছনে দেখতে পাব জ্যোতিশ্চক্র সন্তের মতন?
টুপিতে পালক গুঁজে অথবা জবরজং ঢোলা
পাজামা কামিজ গায়ে মগডালে একা শিস দাও
পাখির মতন কিংবা চাখানায় বসো ছায়াচ্ছন্ন।
দেখতে কেমন তুমি?-অনেকেই প্রশ্ন করে, খোঁজে
কুলুজি তোমার আঁতিপাঁতি। তোমার সন্ধানে ঘোরে
ঝানু গুপ্তচর, সৈন্য, পাড়ায় পাড়ায়। তন্ন তন্ন
করে খোঁজে প্রতি ঘর। পারলে নীলিমা চিরে বের
করত তোমাকে ওরা, দিত ডুব গহন পাতালে।
তুমি আর ভবিষ্যৎ যাচ্ছ হাত ধরে পরস্পর।
সর্বত্র তোমার পদধ্বনি শুনি, দুঃখ-তাড়ানিয়া;
তুমি তো আমার ভাই, হে নতুন, সন্তান আমার।
গ্রামীণ
কেন তবে রক্তে উঠেছিল ঝড় উথাল পাথাল?
আমি তো ছিলাম দূরে অতিশয় শান্ত গ্রামে তাল-
তমালের ভিড়ে, মাঠে, নিসর্গের উদার ডেরায়।
কখনো দেখেছি আর্ত চোখে, হায়, ঘরের বেড়ায়
বেজায় ধরেছে ঘুণ, খুঁটি নড়বড়ে। তবু শক্ত
মুঠোয় লাঙল ধরে চষেছি কাজল জমি, রক্ত।
অবাধ্য শিশুর মতো হ’ত নতুন শস্যের ঘ্রাণে।
নোলক উঠত দুলে যার চিড়ে-কোটা তালে, প্রাণে
যে জন ফোটাত ফুল চম্পক আঙুলে, তার মুখ
ইঁদারার পাশে, ঘাটে দেখলেই হৃদয় কিংশুক।
হে রাখাল, হে দোতারা তোমাদের কাছ থেকে দূরে
কখনো পারিনি যেতে। আলুথালু পরাণ বধূরে
ফেলে রেখে গৃহকোণে বিরান কোথাও দরবেশী
আস্তানায় কম্বলে ঢাকিনি দেহ কিংবা পরদেশী
হইনি কড়ির লোভে। কেন তবে সহস্র বাসুকি
তুলল ফণা আমার তরুণ রক্তে? কেন ঠোকাঠুকি
অস্ত্রোশস্ত্রেও মগজের কোষে কোষে? আমিও হঠাৎ
কেন গণ্ডগ্রামে অস্ত্রাগারে ক্ষিপ্র বাড়ালাম হাত?
কখনো শুনিনি কোনো নেতার বক্তৃতা, কোনো দিন
যাইনি মিছিলে, হাতে তুলিনি নিশান। গণচীন,
মার্কিন মুল্লুক কার কেবা শক্র-মিত্র, এই তথ্যে
ঘামাইনি মাথা। আমার কী কাজ কূট তর্কে, তত্ত্বে?
যাকে ভালোবাসি সে যেন পুকুরে ঘাটে ঘড়া রোজ
নিঃশঙ্ক ভাসাতে পারে, যেন এই দুরন্ত ফিরোজ,
আমার সোদর, যেতে পারে হাটে হাওয়ায় হাওয়ায়,
বাজান টানতে পারে হুঁকো খুব নিশ্চিন্তে দাওয়ায়,
তাই মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও এই এঁদো গণ্ডগ্রামে
ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম কী দূর্বার সশস্ত্র সংগ্রামে।