মানবাবধিকার
এটা-সেটা নেই বলে হাপিত্যেশ করি না তেমন
যখন-তখন কিংবা দুর্দশায় হারমোনিয়াম
সোৎসাহে ঝুলিয়ে কাঁধে গাইনে কাঁদুনি। এখনও তো
ওপরে আছে চন্দ্র-সূর্য, তাদের দাক্ষিণ্যে পাই
রৌদ্র জ্যোৎস্না এবং দিচ্ছেন ছায়া বৃক্ষ যথারীতি।
একটু-আধটু স্বপ্ন অথবা দুঃস্বপ্ন নিয়ে কাটে
রাত্রিদিন। চুপাচাপই থাকি, অধিকার চেতনায়
দেয়ালে দেয়ালে আমি সাঁটি না পোস্টার। ইস্তাহার
নিষিদ্ধ পুস্তিকা ইতস্তত করি নাকো বিলি কিংবা
পুলিশের টুপি পদদলিত করি না, চৌরাস্তায়
পোড়াই না বাস আর গুম খুনে অনাগ্রহী খুবই।
পিঁপড়েও নিশ্চিন্ত ঘোরে, নইতো সশস্ত্র নিধিরাম।
জীবনকে বিশদ চড় ইভাতি ভেবে কোজাগরি
পূর্ণিমায় চাইনে বাংলোয় করতে নরক গুলজার
অথবা মুরগির ঠ্যাং চিবুতে চিবুতে অকস্মাৎ
ভাবাবেশে চাইনে লুটিয়ে পড়তে টেবিলের নিচে
কিংবা হুররে পারমিটের জোয়ারে পালতোলা মাতোয়ারা
পানসি ভাসাতে কোনোদিন। রাতরাতি ঘোর কালো।
বাজারে চমকপ্রদ লাল হতে চাইনে কখনও।
চাইনে শাওয়ার খুলে চন্দন সাবানে প্রতিদিন
গা ধুয়ে ফুরফুরে ফুলবাবু সেজে বাগান বাড়ির
ফটক পেরিয়ে যেতে- এইসব চাইনে কিছুই।
শুধু চাই বংশানুক্রমিকভাবে নির্বিঘ্নে আকাট
মূর্খ হয়ে থাকার কৃপণ ডাস্টবিনে কুকুরের
অস্থিসার প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ার এবং অনাহারে
যত্রতত্র মরণ করবার অধিকার।
মাৎস্যন্যায়
সে জলে স্বচ্ছছন্দ, কেলিপরায়ণ খোলা চোখে দ্যাখে
শামুক, নিথর নুড়ি, অন্য মাছ-জলের ভুবন।
সাঁতারে আরাম, লেজ নেড়ে হয়তো কাউকে ডাকে,
অগোচরে হতে চায় ক্ষণিক-প্রেমিক। টলটলে
জলজ দুপুরে কিংবা টইটম্বুর রাত্তিরে নদী
যখন সঙ্গীতময় হয়, সে আপন অন্তরালে
ভাসমান খুশি যেন। তবু ভয়, কাঁটাতার-ভয়
তার এই মাঝারি সত্তায় লেগে থাকে সারাক্ষণ
কেমন রহস্যময় বিষাক্ত গুল্মোর মতো। বড়ো
মাছ তাকে দেখলেই ধেয়ে আসে, লোভাতুর; আর
সে পালায় ঊর্ধ্বশ্বাসে, যেন বা দেহের কাঁটাজাল
আসবে বেরিয়ে ত্বক ফুঁড়ে, খোঁজে স্বগোত্রের ব্যুহ
এখানে-সেখানে শক্র-তাড়িত, সন্ত্রস্ত, দিক ভুলে
হায়, এসে যায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ক্ষুধার্ত মাছের সংঘে।
আক্রমণে মত্ত ওরা। সে অত্যন্ত একা, মীনরাজ্যে
অভিমন্যু, আর্ত, ক্লান্ত সাঁতার-রহিত, নিরুপায়।
যখন তোমার কথা ভাবি
যখন তোমার কথা ভাবি,
হৃদয়ে মাধবীকুঞ্জলতা
লাস্যময়ী হয় অচিরাৎ।
যখন তোমার কথা ভাবি,
একটি নদীর
জলজ আদর পেয়ে যাই।
ডালে ডালে নিষ্কলুষ প্রগল্ভ পলাশ,
হাওয়া নম্র, লেডি হ্যামিল্টন। শৈশবের,
কৈশোরের সীমাছেঁড়া থোকা থোকা আমের বউল
মঞ্জরিত আদিগন্ত বাগানবাড়িতে। পুলিশের
শাদা হাত ভাস্কর্যর মধুর; পথচারী,
ভিখিরি, কেরানি, ছাত্র অথবা মজুর
সবাই স্বজন।
শহুরে বাগানে বসন্তের ফুল্ল টেলিগ্রাম। পাখি
বারান্দার বার-এ তীব্র রৌদ্র করে পান। ত্রিজগৎ
লাল বল, আমি ব্যগ্র বালক সতৃষ্ণ চোখে মেলে
রাখি হস্তমুদ্রা।
আমার শরীর মেঘ, টলটলে জল
অথবা বাতাস।
যখন তোমার কথা ভাবি,
ব্যাপ্ত আমি শহরের আনাচে-কানাচে।
আমার পায়ের নিচে, দু’তিন মাইল নিচে ব্যাংক,
বীমা কোম্পানির
মৃত্যুগন্ধময়
নিরক্ত দপ্তর
সিনেমা দোকানপাট, ডিআইটির চুড়ো
রঙিন সাইনবোর্ড ছাওয়া পথঘাট,
উদ্বাস্তুর ডেরা,
দ্রুত ধাবমান যান, এভিনিউ, এরোড্রাম, পোর্ট
আর রাজহাঁসের মতন ইস্টিমার।
পড়শী নদীর তুলে-ধরা আর্শিতে ভাসলে মুখ,
ফুলের গোপন অন্তঃস্থলে দুটি চোখ
দেখতে পাওয়া কিংবা
সূর্যোদয়ে নির্জন টিলায় বক্ষচূড়া, তোমাকেই ভাবা।
যখন তোমার কথা ভাবি,
রাখাল বাজায় বাঁশি সনাতন বটের ছায়ায়
সুরে ঝলসিত
বেহেস্তি প্রহর। কারখানার
ধোঁয়াচ্ছন্ন ভেঁপু
ফোটায় ছুটির ফুল কালিঝুলিময়
কর্মিষ্ঠ সংসারে।
চাইনে রাজার বাড়ি, ঝুলন্ত উদ্যান। দিগ্বিজয়ে,
অশ্বমেধে লাভ নেই, আমি
মাথা উঁচু করে ঘণ্টার সোনালি ধ্বনি
শুনতে শুনতে
পাখিদের সঙ্গে কথাচ্ছলে
প্রায় দেহহীন
শহরের প্রস্ফুটিত হৃদয়ে সটান চলে যাবো।
যখন তোমার কথা ভাবি,
জনাকীর্ণ বাস দিব্যি ফাঁকা মনে হয়,
রেশনের দোকানের সুদীর্ঘ লাইন
নিমেষে ফুরিয়ে যায়, ডাকঘর থেকে
সহজেই রঙিন টিকিট নিয়ে ফিরে আসে ঘরে।
যখন তোমার কথা ভাবি,
অলৌকিক একটি ঘরের
চাবি এসে যায় হাতে, উড়ন্ত সোনালি।
যখন তোমার কথা ভাবি,
পাথর, শেকড়, ডালপালা, খড়কুটো, পুরনো কবর,
হাড়গোড়, পোড়া কাঠ ইত্যাদি কবিতা হয়ে যায়-
পুষ্পিত ল্যাবরেটরি, চৈতন্যমথিত ত্র্যালকেমি।
যদি তুমি
নিরুপমা, যদি তুমি মৃত্যুর গহ্বরে যাও, তবে
বাগানের সবগুলো ফুল ভীষণ বিবর্ণ হবে,
সবচেয়ে রক্তিম গোলাপ
সারাক্ষণ বকবে প্রলাপ।
খাঁচার পাখিটা অনাদরে
নিমেষে বুড়িয়ে যাবে, কালো এক অদৃশ্য চাদরে
একদিন পড়বে ঢাকা। পোষা বিড়ালটা শূন্য ঘরে দিনরাত
নির্বাণের লোভে একা ঝিমুতে ঝিমুতে অকস্মাৎ
নিজেই হবে সে এক খণ্ড অন্ধকার।
ভেবো না আমার কথা, অস্তত গোলাপ, পাখি আর
বেড়ালের কথা মনে রেখে এই তরুণী প্রহরে
যেও না, যেও না তুমি মৃত্যুর গহ্বরে।
রক্তসেচ
কী আমরা হারিয়েছিলাম সেই সন্ত্রস্ত বেলায়
নিজ বাসভূমে?
কী আমরা হারিয়েছিলাম?
নৌকোর গলুইয়ের শান্তি, দোয়েলের সুরেলা দুলুনি,
ফসলের মাঠের সম্ভ্রম,
শহুরে পথের পবিত্রতা,
আর গাঙচিলের সৌন্দর্য
আর অভিসারের প্রহর,
কবিতার রাত,
দিগন্ত-ছোপানো
গোধূলির রঙ
-সবকিছু, হারিয়েছিলাম।
কখনও জানি না আগে, এত যীশু ছিলেন এখানে
আমাদের নগরে ও গ্রামে। সন্ধ্যার মতন কালো
ভীষণ মধ্যাহ্নে
আমরা কয়েক লক্ষ যেসাসকে হারিয়ে ফেলছি।
তখন প্রত্যহ মৃত্যু এসে বসতো আমাদের আর্ত ড্রইং রুমে,
সোফায় মাদুরে ফ্ল্যাটে কি পর্ণ কুটিরে
মাননীয় অতিথির মতো।
নির্জন পথের মোড়ে বাসস্টপে কিংবা গলির ভেতর
হঠাৎ এগিয়ে দিতো হাত, যেন বন্ধু বহুদিন পর
এসেছে নিদেশ থেকে অথবা বুকের ভেতরে নিপুণ
চালিয়ে বিশীর্ণ হাত দেখে নিতো হৃৎপিণ্ড কেমন
চলছে কি তালে।
যে পাখির ঝাঁক নামতো আমার উঠোনে,
হলো তারা নিরুদ্দেশ, যে-বেড়াল সবুর বিহনে
কুড়াতো আদর, খাদ্য আমার কন্যার
সেও তো উধাও হলো কে জানে কোথায়।
রক্তের মতন রক্ত বয়ে যেতে দেখে,
লাশের মতন লাশ পচে যেতে দেখে
হয়তো-বা শহরবিমুখ
হয়েছিলো ওরা।
জানতাম, সেই রক্ত বড়ো প্রতিশোধপরায়ণ,
জানতাম, সেই লাশ বড়ো প্রতিশোধপরায়ণ।
আমরা সবাই সেই সন্ত্রস্ত বেলায়
বন্ধুর হাতেও হাত রাখতে পারিনি,
অথবা দু’চোখ ভরে পারিনি দেখতে কৃষ্ণচূড়া।
বুকের ভেতর
নিষিদ্ধ কবিতা গান নিয়ে হেঁটে গেছি
মাথা হেঁট করে,
আমার বাংলার মাটি করেছি চুম্বন মনে মনে।
টিক্কার ইউনিফর্মে শিশুর মগজ,
যুবকের পাঁজরের গুঁড়ো,
নিয়াজির টুপিতে রক্তের প্রস্রবণ,
ফরমান আলীর টাইয়ের নটে ঝুলন্ত তরুণী…
তুমি কি তাদের
কখনও করবে ক্ষমা?–সেদিন সমস্ত গাছপালা,
নদীনালা, ফুটপাত, এমনকি বন্য পশুপাখি
এই প্রশ্ন দিয়েছিলো ছুড়ে চরাচরে।
ভদ্র মহোদয়গণ, এই যে আমাকে দেখছেন
পরনে পাঞ্জাবি, চুল মসৃণ ওলটানো, এই আমার মধ্যেই
ছিলো বিস্ফোরণ,
আমার মধ্যেই
ট্যাংকের ঘর্ঘর
জননীর আর্তনাদ, পিতার স্তম্ভিত শোক, বিধবার ধু ধু
দৃষ্টি আর কর্দমাক্ত বুট, সৈনিকের কাটা হাত,
ভাঙা ব্রিজ, মুক্তিবাহিনীর জয়োল্লাস,
আমার মধ্যেই ছিলো সব।
তোমরা নিহত যারা তাদের উদ্দেশে আজ মর্শিয়ায়
কালো করবো না চতুর্দিক, কেঁদে ভাসাবো না বুক।
তোমরা তো স্তব
এখন, পবিত্র
স্তোত্র কণ্ঠে কণ্ঠে,
জীবিতের চেয়েও তোমরা বেশি জীবন্ত এখন। তোমাদের
রক্তসেচে আমাদের প্রত্যেকের গহন আড়ালে
জেগে থাকে একেকটি অনুপম ঘনিষ্ঠ গোলাপ।