ফেরার পর
কেন এলাম? বৃথাই এলাম
বুকের মধ্যে যে বাড়িটা জ্বলছিল খুব
আপন হয়ে, তারা হয়ে
তার নিকটে কেন এলাম? বৃথাই এলাম।
শুধুই কি আজ
আকাশ-ছেঁড়া করুণ আলো
মাখতে এলাম চোখের পাতায়,
স্টেনের ডগায়, শিরন্ত্রাণে?
কবরখনার শূন্যতাকে
ধীরে-সুস্থে চাখতে এলাম
এমন নিঝুম বেলাশেষে?
কেন এলাম? বৃথাই এলাম।
ডালিম গাছের ছায়ায় ঘোরে তরাস-ছাড়া
শুবরেপোকা।
একদা এই গাছতলাতে মোয়া হাতে
চলতো বেজায় হেলেদুলে
টেবো খোকা। এবং ঢাকাই শাড়ি হঠাৎ
উঠতো ভেসে টলমলানো রোদমুকুরে।
দরগা-দোরে মানৎ রাখা, কুমারীদের
পুণ্যি পুকুর-সব কিছুরই চলন ছিলো,
ছিলো মানে গেরস্থালির
এখানে এই মিশ্র পাড়ায়, বলতে পারি।
কেন এলাম? বৃথাই এলাম।
বেলাশেষের রোদ পড়েছে ভাঙা ভিটের
ফজুল ঘাসে। ফুটোফাটা তোরঙ্গটার
অতীত আছে বোকা-সোকা
দৃষ্টি মেলে, ফতুর ফাঁকা।
তালচটকের ঈষৎ জেদি চঞ্চলতায়
চমকে ওঠে গোছালো এই নীরবতার
কোমল কেশর।
ভাবছি যখন আজকে মৃদু সাঁঝ বাতিটা
কাঁপবে না তো কারুর হাতে,
হঠাৎ তখন ভুঁই-কামড়ি এগিয়ে এসে প্রিয়ংবদা
হলো যেন সানুকম্প
লৌকিকতায়।
ঘুঘু-চরা ভিটেয় তবে বৃথাই এলাম?
বস্তুর আড়ালে
শব্দ আছে এই ভুবনে,
শব্দ আছে হরেক রকম। অনেক দিনের
চেনা-জানা। আবার এমন শব্দ আছে
অচিন পাখির মতন যারা
লুকিয়ে থাকে পাতায়-ছাওয়া
ফাঁক-ফোকরে। প্রতিবেশী রোদ্রছায়ায়
বেশ তো আছে শব্দাবলী।
এই যে দেখুন বস্তুগুলো
ছড়িয়ে আছে চতুর্দিকে-সবাই এরা
শব্দ নামে পরিচিত। শব্দ ছাড়া
আর কিছু নয়। ধরুন এটা
কিংবা ওটা, মানে শহর-
তলির গলি, দীর্ঘ সাঁকো-আসলে সব
বাংলা খোঁজে শব্দপুরে।
কবুল করি, এখন আমি
হাঁটতে গিয়ে, ভয়েই থাকি সকল সময়।
সবখানে আজ পা রাখি না, কখন পাছে
আমার দ্রুত পদাঘাতে
ছিটকে পড়ে চতুর্দিকে
যাবতীয় শব্দাবলী। এখন দেখি
পথ চলাটাই বিড়ম্বনা।
এখন আমি এই শহরে
নজর রাখি চতুর্দিকে। সবখানে আর
পা ফেলি না। ঐতো ব্যস্ত পথের মোড়ে
শক্ত পিচের কারা ভেঙে
হঠাৎ ফোটে রক্তগোলাপ
একটু হলেই মাড়িয়ে দিতাম, হায়রে আমি
অমন পেলব শুচিতাকে।
অনেক কিছু ঘটে গেছে
এই শহরে। এমন কিছু যেসব শুধু
শব্দ দিয়ে যায় না বলা। বলতে গেলে
শব্দ যেন বোকা-সোকা
লোকের মতোই থতোমতো।
শব্দ তখন রুগ্ন খোঁড়া হাঁসের মতো
হোঁচট খেয়ে বিড়ম্বিত।
এই যে ক’টি হাড়ের পিছে আমার আপন হৃদয় আছে, সেকি তবে
শব্দ শুধু? কিংবা কোনো দুঃখী বুকের
শূন্যতাকে শব্দ দিয়ে
যায় কি ঘেরা?
বুকের মধ্যে
বুকে মধ্যে একটা কেমন জগত আছে, বুঝতে পারি।
সেখানে মূল পাখি থাকে, থাকেন বৃক্ষ সারি সারি।
রুক্ষ পথে প্রাণে ধু ধু তৃষ্ণা নিয়ে একলা কে যায়?
আবীর মাখা দরজাটাকে কেউ খুলে দেয়, কেউ-বা ভেজায়।
বুকের মধ্যে ছয় ঋতু এক সমন্বিত ভুবন বানায়।
সোমত্থ ঐ মেঘ-মেঘালি কাছে-দূরে গাছের ডানায়
ডুকরে-ওঠা কাজল বেলায় কান্না রাখে শতেক ফোঁটা!
স্বপ্ন-বনে কিছুতে আর ফুরোয় না যে তুমুল ছোটা।
যমুনা বয় কূল ছাপিয়ে লগ্ন তটে হাসা-কাঁদা,
বাজলে বাঁশি কেমন সুরে ঘর ছেড়ে যায় হৃদয়-রাধা।
ভালোবাসার মুখ দেখে সেই চিরকালীন স্বচ্ছ জলে
তর্জনীতে ফুল ফোটানো যায় তো ডুবে খুব অতলে।
বুকের মধ্যে হাত-চিঠি তার সুনীল পাখা দিচ্ছে মেলে,
স্বপ্নগুলো মাতাল যেন, খেলছে শুধু এলেবেলে।
হঠাৎ কখন ভাঙে সাঁকো কিংবা ফোঁসে রুগ্ন খালটা,
কিসের তোড়ে এক নিমেষে সব হয়ে যায় উল্টা-পাল্টা।
ভীতিচিহ্নগুলি
ভীতিচিহ্নগুলি মুছে যাচ্ছে একে একে সুমসৃণ।
ব্যক্তিগত বাড়ির দেয়াল
বস্ত্রালয়, মনোহারি দোকান, স্টেশন, ছাত্রাবাস
ইত্যাদির ক্ষত সেরে যাচ্ছে। করোটির
অক্ষি কোটরের মতো গর্ত
পায় নব্য পলেস্তারা; শহরে ও গ্রামে
ভীতিচিহ্নগুলি মুছে যাচ্ছে একে একে সুমসৃণ।
আবার ইলেকট্রিক পোলে কী ব্যাকুল শ্রমে কাক
নিবিড় জমাচ্ছে খুড়কুটো, কাক-বউ
ডিম দেবে বলে। পুনরায়
জেলের ফাটক ভেঙে বুকের রবীন্দ্রনাথ উদার পথিক
বাংলাময় রৌদ্রালোকে আর খোলা হাওয়ায় হাওয়ায়,
ঐ তো সৌম্য তিনি জ্যোতির্ময় দেয়ালে দেয়ালে।
বহুদিন পর বারান্দায় শূন্য টিয়ের খাঁচাটা
দিয়েছি ঝুলিয়ে
অভ্যাসবশত,
একটি সবুজ পাখি দাঁড়ে এসে ফের বসবে বলে।
ভীতিচিহ্নগুলি মুছে যাচ্ছে একে একে সুমসৃণ;
অথচ আমার বুক, মগজের কোষ
শিরা-উপশিরা
এখনও তো সন্ত্রাসের প্রজা। পেয়ারা গাছের নিচে
মুরগিগুলি হঠাৎ উৎকর্ণ হয়, যেন অন্তরালে ভয়বহ
শব্দে ধমক সুপ্রকট, দূরে খড়ের গাদায় খরগোশ
কম্পমান; রৌদ্রস্নাত পাখির বুকের রোম তীব্র শিহরিত
ইস্পাতি স্পর্শের আশঙ্কায়।
গাছের সজীব পাতাগুলি,
ভদ্র পাতাগুলি
দুঃস্বপ্নের ভস্ম-ওড়া প্রখর শ্মশানে
মনসার মতো আগুনের লকলকে জিভ দেখে
ক্রমাগত কুঁকড়ে যেতে থাকে।
হঠাৎ জানালা থেকে একটি রোমশ হাত ঘরে
ঢুকে পড়ে, বিচূর্ণিত গেরস্থালি। জামবাটি বুড়ো
নাবিকের ফিচেল করোটি হয়ে নৃত্যপর উদোম মেঝেতে।
প্রভুভক্ত কুকুরের মতিভ্রম, অকস্মাৎ আমার গলায়
তার রক্তখেকো দাঁত বসে যায়। আমার ছেলেটা
তার অনুজের মাথা কেটে হো হো হেসে ওঠে, সন্তানের রক্ত
নিজের জঠরে কেলিপরায়ণ! একটি যুবতী, উন্মাদিনী,
ঘাসের মৌসুমী ফুল চিবুচ্ছে কেবল, নাকে তার
লাভাস্রোত। সহোদরা বিষম ঝুলছে কড়িকাঠে। একজন
লোলচর্ম বৃদ্ধ মারহাবা বলে তার নকল সফেদ দাঁতে
কুটি কুটি কাটছেন কিশোরীর মাই। আমার সমস্ত ঘর
চাপ চাপ বরফে আকণ্ঠ ঢাকা, মুর্দাফরাশের
গান ভাসমান সবখানে।
রেখেছি কাকতাড় য়া দিকে দিকে মনের জমিনে,
তবুও ভয়ের প্রেত যাচ্ছে না আমাকে ছেড়ে। রোজ
বেলাশেষে ক্লান্ত লাগে, ক্লান্ত লাগে, ক্লান্ত লাগে; ভয়,
হিস্ হিস্ ভয়
দারুণ হাইড্র্যা ভয় এই
কণ্টকিত সত্তা জুড়ে রয় সারাক্ষণ। তবে কি ধবলী
গোখুরে উড়িয়ে ধুলো, রঙিন বাজিয়ে ঘণ্টা যাবে না গোহালে?