দরজার কাছে
দরজার কাছে দ্বিধাহীন নতজানু হতে পারি,
যদি খুলে যায়।
তার কেঠো বুকে, বন্ধ বুকে,
অন্ধ বুকে ঠুকে
রক্তাক্ত করতে পারি মাথা,
ধূলিম্লান চৌকাঠে হাজারবার চুমো খেতে পারি,
যদি সে অর্গলমুক্ত হয়।
বাইরে রেখো না আর; দেখে যাও, একবার এসে দেখে যাও
ঝঞ্ঝাহত জাহাজের মতো আমি টলছি ভীষণ।
আমাকে দেখলে কেউ এ মুহূর্তে ভাববে নির্ঘাৎ,
ভিক্ষান্ন চাইছি আমি, যদিও আমার
সমস্ত শরীরে
ভালোবাসা তার তপ্ত কাঞ্চনের মতন ফেস্টুন
দিয়েছে উড়িয়ে।
বাইরে রেখো না আর; তোমার মুখের
মধুর নোনতা স্বাদ, ঈষদুষ্ণ সময়-ভোলানো
আলিঙ্গন এ মুহূর্তে একান্ত জরুরি।
দরজা রেখো না বন্ধ করে বারবার, দরজায়
বিরাট ‘না’ দেখে যদি ফিরে যেতে হয়,
আমার ভেতর থেকে এক জলজ্যান্ত হনুমান
পড়বে বেরিয়ে, তারপর, বুঝতেই পারো,
লঙ্কাকাণ্ড বেধে যাবে, তুমি
হতবাক দেখবে আগুন চতুর্দিকে, সে আগুন
হাজার ফায়ারম্যান বারো ঘণ্টা লড়েও নেভাতে পারবে না।
দরজা রেখো না বন্ধ করে,
রেখো না কখনও।
মুখের ওপর বন্ধ দরজা দেখেই
ফিরে যাবো হঠাৎ ছাঁটাই হওয়া চাকুরের মতো?
তুমি অভ্যন্তরে
সুশান্ত নিবাসে
সোফায় এলিয়ে পা নাড়বে ঘন ঘন,
তোমার পায়ের খুব কাছে
ঘুমোবে বেড়াল, তুমি সোনালি আলস্যে বুঁদ হয়ে
হয়তো করবে গুন গুন, হয়তো-বা
ব্রা খুলে দাঁড়াবে স্নানাগারে
গা জুড়ে কোমল নেবে জলের আদর
অথবা ফ্রাইংপ্যানে ভাজবে ইলিশ মাটি-ছোঁয়া
শাড়ির সীমান্তে নিয়ে হলুদ কলঙ্ক।
না, তুমি দরজা বন্ধ রেখো না কখনও।
তোমাকে না দেখে যদি ফিরে যেতে হয়,
তবে আমি স্টিমার ডুবিয়ে দেবো গহন নদীতে,
উপড়ে ফেলবো রেললাইন,
মিউনিসিপ্যালিটির ট্রাকগুলো জাগজের মতো
কুটি কুটি ছিঁড়বো বেবাক
আর জেলখানার দেয়াল
লাথি মেরে করবো লোপাট,
ভীষণ মটকে দেবো ডিআইটির ঘাড়।
বাইরে রেখো না আর; এই পথ উত্তপ্ত কটাহ।
খোঁপায় জড়াচ্ছো মালা? না কি
প্রোষিতভর্তিকা প্রতিবেশিনীর সঙ্গে জমিয়েছো রঙ্গ?
তুমি কি ঘুমিয়ে আছো? তোমার শিয়রে
কেউ কি দাঁড়ালো লুব্ধ দৃষ্টি মেলে, যেমন অম্লান
গঁগার ছবিতে আছে সান্দ্র চিরদিন?
দরজাকে বারবার আমার শক্রতা
সাধতে বলো না কোনোদিন।
মগজে, হৃদয়ে
তোমার মদির তাপ শিরায় শিরায়
না নিয়ে আমাকে যদি ফিরে যেতে হয়,
তবে আমি হাতবোমা ছুড়ে দেবো গণতরঙ্গিত
চৌরাস্তায় দিনদুপুরেই,
‘আজ চাকা বন্ধ’ বলে ডাকবো পল্টনে জনসভা;
জবরদখল করে বেতার ভবন
তুমুল রটিয়ে দেবো আকাশে আকাশে,
বস্তিতে বস্তিতে, ঘরে ঘরে-
আমি ফিরে যাবো না হে শক্র
হে রুদ্ধ দরজা
যাবো না কক্ষণও।
পরশুরামের মতো কুঠারের আঘাতে আঘাতে
আমিও একুশবার নিশ্চিত মেটাবো জাতক্রোধ।
দুই তীর
বাস্তব ভেলকিবাজি দেখাচ্ছে বলেই স্বপ্নময়
একান্ত প্রহর খঁজি। তুমি তো ওঠো না ভেসে দিনের মুকুরে,
আমার চোখের আলো-লাগা পথে-কী যে বিপর্যয়
জীবনে এসেছে নেমে-তোমার তো দেখা নেই। কীট কুরে কুরে
খাচ্ছে হৃদয়ের গুল্মলতাগুলো। সারারাত তোমাকে স্বপ্নের আঙিনায়
ব্যাকুল চেয়েছি পেতে; তুমি যাবে হেঁটে যেন তরুণী মহিমা
অবিকল; কানায় কানায়
উঠবে ভরে জ্যোৎস্নায় ঘুমের পঞ্চবটী। স্বপ্নে সুযোগের সীমা
যতই বিস্তৃত হোক, তোমারই যে নেই দেখা-
দুচোখে শিশির নিয়ে মূক নীলাভায় ঘুরি একা।
অথচ সকালবেলা খুব নিরালায়
নিদ্রার ছিন্ন পাড়ে সদ্য
কী আশ্চর্য, উঠলো ভেসে চকিতে তোমার মুখ, যেন জলপদ্ম,
হস্তলগ্ন চায়ের জাগর পেয়ালায়।
প্রমাণ
তুমি বারবার বলো ঘুরে ফিরে সেই একই কথা-
‘তাহলে প্রমাণ দাও, সত্যি ভালোবাসো কিনা’। বুঝি ব্যাকুলতা
কেন যে দখল করে তোমাকে এভাবে।
বলো, কে নেভাবে
তোমার বুকের এই অধীর আগুন?
যখন ফাল্গুন
আসে, নিমেষেই
চাদ্দিক পুষ্পিত হয়। ফুল কি প্রমাণ করে এই
চরাচরে আপন সৌরভ
ইনিয়ে-বিনিয়ে? ফোটে, শুধু ফোটে, তার উন্মীলনেই গৌরব।
ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা
ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা
গোলাপ নেবো।
গুলবাগিচা বিরান বলে, হরহামেশা
ফিরে যাবো,
তা হবে না দিচ্ছি বলে।
ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা
গোলাপ নেবো।
ফিরতে হলে বেলাবেলি হাঁটতে হবে
অনেকখানি।
বুক-পাঁজরের ঘেরাটোপে ফুচ্কি মারে
আজব পাখি।
পক্ষী তুমি সবুর করো,
শ্যাম-প্রহরে ডোবার আগে, একটু শুধু
মেওয়া খাবো।
শিরায় শিরায় এখনও তো রক্ত করে
অসভ্যতা।
বাচাল কণা খিস্তি করে, হাফ গেরস্ত
প্রেমের টানে;
হঠাৎ দেখি, চক্ষু টেপে
গন্ধবণিক কালাচাঁদের, মিষ্টি মিষ্টি
হ্রস্ব পরী।
বিষ ছড়ালো কালনাগিনী বুকের ভেতর
কোন্ সকালে।
হচ্ছি কালো ক্রমাগত, অলক্ষুণে
বেলা বাড়ে।
সর্পিণী তুই কেমনতরো?
বিষ-ঝাড়ানো রোজা ডেকে রক্ষা পাওয়া
কঠিন হলো।
ছিলাম পড়ে কাঁটাতারে বিদ্ধ হয়ে
দিনদুপুরে,
রাতদুপুরে, মানে আমি সব দুপুরে
ছিলাম পড়ে।
বাঁচতে গিয়ে চেটেছিলাম
রুক্ষ ধুলো; জব্দ নিজের কষ-গড়ানো
রক্তধারায়।
ইতিমধ্যে এই মগজে, কয়খানা হাড়
জমা হলো?
ইতিমধ্যে এই হৃদয়ে, কয়খানা ঘর
ধ্বংস হলো?
শক্ত পাক্কা হিসাব পাওয়া।
টোফ-ফর্দের পাতাগুলো কোন্ পাতালে
নিমজ্জিত?
তালসুপুরি গাছের নিচে, সন্ধ্যা নদীর
উদাস তীরে,
শান-বাঁধানে পথে পথে, বাস ডিপোতে,
টার্মিনালে,
কেমন একটা গন্ধ ঘোরে।
আর পারি না, দাও ছড়িয়ে পদ্মকেশর
বাংলাদেশে।
ঘাতক তুমি সরে দাঁড়াও, এবার আমি
লাশ নেবো না।
নই তো আমি মুর্দাফরাশ। জীবন থেকে
সোনার মেডেল,
শিউলিফোটা সকাল নেবো।
ঘাতক তুমি বাদ সেধো না, এবার
আমি গোলাপ নেবো।