কতদিন
কতদিন দু’দিন তিন দিন কেটে যায়, কেটে যায়, কেটে যায়
এবং আমাকে কাটে রেজরের ভীষণ শীতল
তীক্ষ্ণতায়। একদিন দু’দিন তিন দিন কেটে যায়, তবু তুমি
আসো না এখানে, দাড়াও না দরজা ঘেঁষে অথবা কপাল থেকে
সরিয়ে বেয়াড়া চুল বলো না, কেমন আছো? তুমি কি কখনও
আসবে না আর? দ্যাখো, নিঃসঙ্গতা সকৌতুক দেয়
বাড়িয়ে আমার দিকে পানপত্র তার আর আমি
আকণ্ঠ করছি পান। এই তো এখানে হাত রাখি, তপ্ত হাত,
শয্যায় চেয়ারে কিংবা দেয়ালে, উঠোনে চারাগাছে-
কোথাও পাই না খুঁজে ঝলসিত তোমার শরীর।
হতাশার কিরিচের মুখোমুখি রয়েছি দাঁড়িয়ে,
যেন-বা তরুণ কোনো পাতে বুক অত্যাচারী সঙিনের মুখে।
এখানে আসে না বলে এ ঘর কবর আরম ঘাসে
ঘাসে ছাওয়া, রিক্ত হাওয়া কেবলি মর্শিয়া গায়, প্রাচীন কঙ্কাল
অদ্ভুত স্লোগান হাঁকে। পাঁজরে উইয়ের ঝাঁক কী ব্যস্তবাগীশ।
যখন এ ঘরে পড়ে তোমার পায়ের ছাপ, পুরনো চৌকাঠ
খিল খিল হেসে ওঠে, নিমেষে নর্তকী হয় জানালার পর্দা,
আমি নিজে হয়ে যাই জন্মদিন-দীপাবলি, চন্দ্রিল সোনাটা,
বানায় উদ্যান এক অগোচরে। অথচ যখন চলে যাও
আমার হৃদয় হয় শীতাক্রান্ত সন্ধ্যার শ্মশান।
কেন তুমি
কেন তুমি মুখ নিচু করে থাকো সারাক্ষণ? কেন
লোকলোচনের অন্তরালে থাকতে চাও?
তোমার কিসের লজ্জা? কোন্ পাপবোধে আজকাল
তোমাকে অমন দীন ছায়াচ্ছন্ন করে রাখো? কোন্
অপরাধে নতজানু হয়ে থাকো সারা দিনমান?
কেন তুমি ম্লান মুখচোরা হয়ে থাকো সর্বদাই?
না বললেও বুঝি
গলায় কলস বেঁধে নদীর গহনে ভয়ানক চুপিসারে
চলে যেতে চাও তুমি অথবা হঠাৎ
আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ে ভস্ম হতে চাও
কিংবা ভয়-প্রদায়িনী আঁধারে ঘুমের বড়ি খেয়ে
অনবোলা ক্রুর যন্ত্রণার থেকে মুক্তি পেতে চাও।
জানি তুমি পিপাসার্ত পথিকের মুখে
কখনও পারোনি দিতে এক ফোঁটা জলও,
ক্ষুধার্তের ভিড়
তোমার দরোজা থেকে ফিরে গেছে। এমনকি হায়
ঝুলিয়ে হার্মোনিয়াম সুরপরায়ণ
গলায় কখনও বন্যার্তের জন্য পথে ঘুরে ঘুরে
চাঁদা তোলা হলো না তোমাকে দিয়ে। ক্যাম্পে
আহত ব্যক্তির ক্ষতে কোনোদিন বাঁধোনি ব্যাণ্ডেজ।
পাতোনি মাইন ব্রিজে, ওড়াওনি কনভয়
দুদ্দাড় গ্রেনেড ছড়ে, ফ্রগম্যান সেজে
বঙ্গোপসাগরে পারোনিকো ক্ষিপ্র ডোবাতে জাহাজ,
অথবা দখলদার সৈনিকের বুকে
বন্দুকের নল চেপে তার
হৃৎপিণ্ড ঝাঁঝরা করে দেয়া
সাধ্যাতীত জেনেছিলে মুখ ঢেকে অন্ধকারে একা।
কতদিন স্পষ্টত তোমারই
চোখের সম্মুখে শিশু হারিয়েছে প্রাণ, নারী তার
যৌবনের সলাজ আরক্ত মাধুরিমা;
তুমি কাকতাড় যার ভূমিকাও করোনি পালন।
না,তুমি লজ্জায় মুখ আঁধার-নিবাসে
রেখো না লুকিয়ে আর থেকো না অমন
নতজানু হয়ে,
যেমন ভয়ার্ত পাপী ধর্মযাজকের প্রকোষ্ঠের
সম্মুখে একাকী হাঁটু গেড়ে বসে কাঁপায় অধর।
বরং সহজ হও, সমুন্নত হোক গ্রীবা মরালের মতো,
অত্যন্ত উজ্জ্বল হোক চোখ
আবার মোহন অন্ধকারে। হে আমার
কবিতা কল্পনালতা তুমি
ধিক্কারে ঘৃণায় ক্ষোভে কখনও যেয়ো না বনবাসে।
ভয়ানক মারের সাগরে
ভেলা যে ভাসিয়েছিলে, ছিলে
আমার মগজে, ছিলে সর্বদাই রক্তকণিকায়,
অপ্সরার মতো নেচেছিলে
খাতার নিভৃত মাইফেলে সন্ত্রাসের
প্রহরে প্রহরে,
তাই হে আমার সিন্ডারেলা,
বেলা-অবেলায়
তোমারই উদ্দেশে শ্লোকরাজি আজও করি উচ্চারণ।
তোমারই উদ্দেশে
কেমন পুষ্পিত হয় অলৌকিক জমিজমা কিছু
তোমারই উদ্দেশে
আমার হৃদয়ে অন্তহীন শোভাযাত্রা
শূন্যতায়, জড় আর চৈতন্যের মধুচন্দ্রিমায়।
গুপ্তধন
সবাই এমন ব্যবহার করে, ইচ্ছে হয় সংবারের দিকে
পিঠ দিয়ে পাশ-বালিশ বুকে ঝাড়া বাহাত্তর ঘণ্টা শুয়ে থাকি,
ইচ্ছে হয়, পুলিশ ফাঁড়িতে ঢুকে বসে থাকি দিন-রাত কিংবা
উন্মাদকে দীনবন্ধু বলে বুকে ধরি চেপে, করি বিড়বিড় সারাক্ষণ;
সবাই এমন ব্যবহার করে আজকাল, যেন আমি কারো
মাথায় দিয়েছি বাড়ি, যেন সদ্য কোনো বিয়েবাড়িতে হঠাৎ
ঢুকে পড়ে লাল চেলী দিয়েছি পুড়িয়ে কিংবা গোরস্তানগামী
লাশ দেখে ফিক করে হেসে ট্রাউজার খুলে করেছি পেচ্ছাব
চৌরাস্তায়। আমি তো করিনি লুট কোনো ব্যাংক, দুপুর রাত্তিরে
হাইজ্যাক করিনি মোটরগাড়ি। তবু কেন সবাই এভাবে
তাকায় আমার দিকে? দ্যাখো, ভালো করে দ্যাখো, জড় ল-টড় ল
কিচ্ছু নেই ললাটে আমার। হায়, তবে কি কোয়াসিমোদো আমি?
পিঠজোড়া কুঁজ নিয়ে বিব্রত সর্বদা, ঘণ্টা বাজিয়ে বাজিয়ে ক্লান্ত।
চোর বাটপাড় নই, মিছেমিছি আমার পেছনে কেউ, শোনো,
লাগিও না ফেউ, কাঠগড়া রাখো দূরে, টুকে নাও স্বীকারোক্তি-
রেখেছি লুকিয়ে বুকে এক বিরল সম্পদ, মুখচ্ছবি তার।
তুমি কে হে?
কখনও চঞ্চল ছিলো অতিশয় চক্ষুদ্বয়, এখন কেমন
ভয়ানক স্থির,
অচিন পাথর যেন, শ্যাওলায় হবে আচ্ছাদিত বৃষ্টি হলে।
ভয়ানক স্থির, রোদের তুমুল সুঁচ
ঠোকরাচ্ছে অবিরাম, তবু অক্ষিপক্ষ নিরুদ্যম,
হাতও উঠে আসে না কখনও। পড়ে আছো
রাস্তার কিনারে, ক্রুশকাঠ। ভনভনে
মাছি নাক-মুখ ঘেঁষে বুঝি জিজ্ঞাসায় অত্যন্ত চঞ্চল-
বেওয়ারিশ রয়েছো ঘুমিয়ে তুমি কে হে?
হাতের যজম মুঠো বিয়াবান, হৃদ্ ঠিকানার
তল্লাটে কোথাও কোনো ঘর নেই, সাঁকো নেই, ফোটে না চকিতে
স্বর্ণচাঁপা মফস্বলি স্টেশনের রাত
রাখে না শিশির তার বুকে রক্তে ঝিঁঝিঁ
ভুলেও দেয় না
মদির স্লোগান।
পৈশাচী খরায় আজ তাকে ঘিরে জীবনের হা-হা হরতাল।
দেখে কৃপা হয়? ইচ্ছা হয়, মাথাটা বুলিয়ে দিই,
চিবুকের কাটা দাগ করি অনুভব
তর্জনী অথবা অনামিকা ডগায়। খুলে নেবো
বিবর্ণ জুতোর পাটি? মিটবে কি সাধ রৌদ্রস্নানে?
যিনিই করান স্নান, তার
চুল রুক্ষ থেকে যাবে, হবে না কোমল
বুকের নিথর রোমারাজি।
কোথায় যাচ্ছিলে তুমি? বাজারের পথে? না কি হাওয়া
খেতে মাঠে? পোস্টাপিসে গিয়েছিলে কিনতে টিকিট?
হয়তো-বা সুগন্ধি নিঃশ্বাসে তৃপ্তি পেতে চেয়েছিলে
সূর্যাস্তের ছোপ-লাগা বারান্দায় লুকিয়ে-চুরিয়ে।
তপ্ত পিচে বিস্তৃত রোদ্দুরে,
কেমন নিঃশ্বাসহীন আছো পড়ে। কী তোমার গোত্র,
জাতধর্ম? কোন সে ভাষায় বলতে গাঢ়, ‘বাড়ি যাবো’,
বলতে ‘চাই, তোমাকেই চাই?’