আত্মজীবনী বিষয়ক
একেকটি দিন ঘাড় ধরে বিষম বুঝিয়ে দিচ্ছে
এখানে সময় বসে নেই
শান্ত রাখালের মতো পা মেলে ছায়ায়।
চোখ বুজলেই দেখি চারটি দশক
মানে পুরো চল্লিশ বছর গেছে উটে,
যেমন হাওয়ার তোড়ে মেঘ। কখনও-বা মনে হয়
বেকুর দাঁড়িয়ে আছি বেখাপ্পা মিনারে, সঙ্গীহীন।
কালের মাজাকি, প্রীতি, খুনসুটি, হিংস্রতা ইত্যাদি
সয়ে সয়ে কেমন গণ্ডার হয়ে গেছি।
গভীর গাড্ডায় পড়লেও আজকাল
সহজে ছাড়ি না হাল, আপ্রাণ ত্রাণের পথ খুঁজি।
চারটি দশক আমি দিলাম কাটিয়ে
নিদ্রা-অনিদ্রায়।
মাঝে-মধ্যে ব্যক্তিগত নীরবতা আর মুখরতা
নিয়ে আত্মজীবনী লেখার রমণীয় সাধ জাগে।
আত্মজীবনী কি ছায়াচ্ছন্ন চিলেকোঠা?
দুপুরের গলি
নিঝুম, উদাস?
আত্মজীবনী কি তরুণীর ত্বকের মতন
চৌবাচ্চার জল?
অথবা পুকুর?
আত্মজীবনী কি শাদা দেয়ালে বিবর্ণ ফটোগ্রাফ?
কতদিন আমি আত্মজীবনী লেখার নিভৃত ইচ্ছাটাকে
খড়ের আড়ালে কোনো কোমল শশক ভেবে খেলায় মেতেছি।
যখনি টেবিলে ঝুঁকে আত্মকথনের
মদে বুঁদ হই, দেখি, আমার নিজের মুখ দ্রুত
কেমন বদলে যায়, আমার মুখের ভাঁজে ভাঁজে
বসে যায় সুগভীর অজস্র মুখের রেখাবলী।
ভাবিনি কখনও আগে আমার জীবন
এতই জটিল এত কোলাহলময়।
আত্মজীবনীর পক্ষে কি বিপক্ষে আমি,
আজও তো জানি না।
আমার উঠোন আমাকে
এই যে কোথায় যাচ্ছো, সাতসকালে চাপিয়ে পাঞ্জাবি?
আরেকটু বসো, গল্প করো, আরেক কাপ চা খাও বরং, এই
তাকাও আমার দিকে। তাকানোর প্রয়োজন নেই?
বড়ো বেশি বাইরে তোমার মন। কতো হাবিজাবি
কাজে যে তোমার বেলা কাটে।
যদি বারান্দায় বসে পড়তে বই কিংবা খাটে
থাকতে শুয়ে, আমার অত্যন্ত লাগতো ভালো, সত্যি আমি
আনন্দ পেতাম, দেখতাম তোমাকেই দূর থেকে।
তোমার সুখ্যাতি হতো, বলতো ওরা, এই তো যথার্থ গৃহস্বামী।
রোদ-চশমায় চোখ ঢেকে
সারা দিনমান করো টো টো;
সময় বইয়ে দাও চা-খানায়, মাঠে, পার্কে, আঠার মতন
লেগে থাকো গুলজার আড্ডায় কিংবা ছোটো
যখন-তখন
পাড়া থেকে পাড়ান্তরে। তবে কি তোমার দেশোদ্ধারে
মন? না কি রক্তে কোনো বিবাগী পূর্বপুরুষ পদ-
চারণা করেন সর্বদাই? এদিকে তোমার দ্বারে
আমার অবোধ স্বপ্ন, ইচ্ছা, ব্যাকুলতা এবং সুখদ
কিছু স্মৃতি করে সত্যাগ্রহ। রাত্রি পাকে, কখন ফিরবে তুমি?
প্রতীক্ষায় কখন যে তেতে ওঠে, আবার জুড়িয়ে যায় ঠিক
চায়ের জলের মতো আমার উদাস এই শরীরের ভূমি!
তুমি তো আমার বুকে রাখোনি কখনও রক্তজবা
ভালোবেসে। অথচ তোমার মৃত্যু হলে আকস্মিক,
কেউ বুঝুক না বুঝুক, হয়ে যাবো আমি তো বিধবা।
আমি তো মেলারই লোক
আমি কি মেলারই লোক? বেলাবেলি এসে গেছি রঙিন চাঞ্চল্যে
এই মুক্তাঙ্গনে আজ? নাগরদোলায় দুলে কিংবা
সবুজ বাদামি শাদা ঘোড়া দেখে দেখে,
মাদল করতাল শুনতে শুনতে,
কোর্তাপরা বাঁদর নাচিয়ে
কেটে যাবে বেলা
অথবা পথের ধারে বেচবো পুতুল,
ঘটিবাটি সূর্যাস্ত অবধি।
আপনার যারা এসেছেন কাছ থেকে দূর থেকে
তারা কি আমার কোনো ইন্দ্রজাল দেখার আশায়
ব্যাকুল উড়িয়েছেন ধুলো পথেঘাটে, ঠেলেছেন ভিড়?
হে দর্শকবৃন্দ
বাঘের মুখের
ভেতর গচ্ছিত রেখে মাথা ফের আনবো নিপুণ
ফিরিয়ে অক্ষত, যদি ভেবে থাকেন তাহলে
প্রতারিত হবেন নিশ্চিত।
না, আমি সে খেলা
শিখিনি কখনও। এমনকি কালো গোল-
টুপির ভেতর থেকে শাদা কবুতর
ওড়ানোর কৌশল অথবা আঙুলের
ডগায় গোলাপ ফোটানোর
মায়াবী কায়দা জানা নেই।
আমার রঙিন তাস নেই, টিনের কৃপাণ নেই,
মুখোশ ইত্যাদি নেই। হে দর্শকবৃন্দ,
শুনুন, আপনাদের কোনো প্রমোদের
আশ্বাস পারি না দিতে। বিশ্বাস করুন,
এই দুঃখে মাথা নিচু করে সরাসরি নির্বাসনে
যেতে ইচ্ছে হয়।
তা বলে এক্ষুণি মেলা দেবেন না ভেঙে
রেগে-মেগে, ‘তুমি আজেবাজে পদ্য লেখো হে বিস্তর,’
বলে গোবেচারী
সীনার মতন আমাকেও অচিরাৎ
দেবেন না ঠেলে
যমের দুয়ারে। যদি অপেক্ষা করেন
কিছুক্ষণ, এই ব্যর্থ আমি, এই অক্ষম আমিও
পারবো দেখাতে কিছু। এই যে দেখুন,
আমার দু’চোখে দগ্ধ গ্রাম বেশুমার,
আমার ললাটে
আহত শহরগুলো ব্যাণ্ডেজসমেত
শুয়ে আছে। দেখুন আমার বুকে রক্তে ভেসে-যাওয়া
মরিয়ম নিঃস্পন্দ কেমন,
আমার বাহুর কোণে ভয়ানক ছিন্নভিন্ন শীতল বাবলু
অচঞ্চল; আমার পাঁজরে
শচীন শাঁখারি, রাজমিস্ত্রী জাবেদালি
মুখ থুবড়ে পড়ে আছে; শরীরে ভীষণ ফুটোগুলো
নগ্ন চক্ষুময়!
আমার চিবুকে কতো ভগ্ন সেতু বারুদের গন্ধে
ভরপুর কতো যে পরিখা,
আমার চোয়ালে লগ্ন লক্ষ্মীবাজারের
সুহাসিনী দেবীর রক্তিম শাড়ি, যেন স্বাধীনতার পতাকা।
আমি তো মেলারই লোক, বেলাবেলি এসে গেছি এই
মণ্ডপের কাছে;
ঘুরবো, থাকবো
নৌকো আর পুতুলের ভিড়ে,
নাগরদোলার কাছে, ঘোড়াদের কাছে।
ঘুরবো, থাকবো
কিছুকাল, চন্দ্রমল্লিকার
ডাকে দেবো সাড়া,
ঘুরবো, থাকবো
তুলে নেবো হাতে জ্যোৎস্নার রুপালি রাখি।
আমি তো মেলারই লোক, দৃশ্যবলী দেখতে দেখতে
কখন হারিয়ে যাবো এক বুক হাহাকার নিয়ে।
ইন্দ্রজাল
তুমি তো জানোই বছরের পর বছর ফুরোলে
কালের দারুণ কলরোলে
কেমন পাকিয়ে যায় তালগোল চতুর্দিকে। তিব্বতের পুঁতি
বাগান, বসতবাড়ি, ক্যালেণ্ডতার, পুঁথি,
যাবতীয় খবরাখবর,
শিশুর দোলনা কিংবা স্নিগ্ধ ঘাস-সমৃদ্ধ কবর,
সবি তো পুরনো হয়। আমারও ওপর ঘন সর
সুবিস্তৃত সময়ের, বাস্তবিক হয়ে গেছি কেমন ধূসর।
মনে পড়ে এক যুগ আগে
গাঢ় অনুরাগে
তোমাকে দৃষ্টির জ্যোতির্লোকে
তুলে নিয়েছিলাম বলেই আজও আমার এ চোখে
আকাশ নক্ষত্র বন-সমস্ত কিছুর চেয়ে
এমন নতুন তুমি মেয়ে।